বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামরিক শক্তির এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান প্রশান্ত মহাসাগর। বিশ্বের পাঁচটি মহাদেশ এই মহাসাগরের তীরে অবস্থিত। প্রশান্ত মহাসাগরের আয়তন সমগ্র বিশ্বের তিন ভাগের এক ভাগ। পৃথিবীর গভীরতম এই মহাসাগরে ছড়িয়ে আছে বহু রহস্যময় বৈচিত্র। প্রশান্ত মহাসাগর তীরে আমেরিকা, চীন ও উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলো অবস্থিত হওয়ায় এই সমুদ্রসীমায় সবচেয়ে বেশি সামরিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে।
আমাদের এই প্রতিবেদনে জানাবো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মহাসাগর ‘প্রশান্ত মহাসাগর’ সম্পর্কে কিছু অজানা ও বিস্ময়কর তথ্য।
প্রশান্ত মহাসাগরের আয়তন পৃথিবীর সমগ্র স্থলভাগের আয়তনের চেয়েও বেশি। প্রশান্ত মহাসাগর উত্তর ও দক্ষিণ দুই ভাগে বিভক্ত। ভূমধ্যরেখা একে উত্তর ও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে ভাগ করেছে। উত্তর গোলার্ধে প্রশান্ত মহাসাগর বেরিং সাগরের মধ্য দিয়ে উত্তর মহাসাগরের সাথে মিলিত হয়েছে। অন্যদিকে দক্ষিণ গোলার্ধে কেপ হর্নের কাছে প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগর সম্মিলিত হয়েছে। প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিমে রয়েছে এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ ;এবং এই মহাসাগরের পূর্বে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের অবস্থান। প্রশান্ত মহাসাগরে মোট আয়তন ১৬ কোটি ৯২ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার। যা পৃথিবীর মোট আয়তনের প্রায় ৩২ ভাগ এবং সমস্ত জলভাগের আয়তনের প্রায় ৪৬ ভাগ। প্রশান্ত মহাসাগরের গড় গভীরতা প্রায় ১৪ হাজার ফুট। পৃথিবীর সবচেয়ে গভীরতম অংশ ‘মারিয়ানা ট্রেঞ্চ’ উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় অবস্থিত। মারিয়ানা ট্রেঞ্চ -এর গড় গভীরতা প্রায় ৩৫ হাজার ৮০০ ফুট। পৃথিবীর টেকটনিক প্লেটের গতিশীলতার কারণে প্রশান্ত মহাসাগর প্রতিবছর প্রায় এক সেন্টিমিটার করে সংকুচিত হচ্ছে।
প্রশান্ত মহাসাগরে প্রায় ২৫ হাজার দ্বীপ রয়েছে, যা বাকি চারটি মহাসাগরের সম্মিলিত দ্বীপ সংখ্যার চেয়েও অনেক বেশি। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ গুলো মাইক্রোনেশিয়া, মেলানেশিয়া ও পলিনেশিয়া নামের তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত। মাইক্রোনেশিয়ান দ্বীপপুঞ্জ গুলো তুলনামূলক ক্ষুদ্রাকৃতির। এই দ্বীপ গুলোর মধ্যে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ, ক্যারোলিন দ্বীপপুঞ্জ ও কিরিবাতি অন্যতম। মেলানেশিয় দ্বীপগুলোর মধ্যে প্রশান্ত মহাসাগরের সর্ববৃহৎ দ্বীপ ‘নিউ গায়ানা’ অবস্থিত। এছাড়াও এই অঞ্চলের মধ্যে ফিজি, ভানুয়াতু, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ এবং সান্তাক্রুজ দ্বীপ উল্লেখযোগ্য। প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে সর্ববৃহৎ অঞ্চল পলিনেশিয়া। ১৩০ টি দ্বীপ নিয়ে এই অঞ্চল গঠিত। যা উত্তরে হাওয়াই দ্বীপ থেকে দক্ষিণে নিউজিল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রশান্ত মহাসাগরের প্রায় মাঝখানে থাকা এ অঞ্চলের দ্বীপ গুলোর মধ্যে সামোয়া, টুভালু, টোংগা, পূর্ব দ্বীপপুঞ্জ এবং কুব দ্বীপপুঞ্জ অন্যতম।
বিশ্ব বাণিজ্যের প্রায় ৯৫ শতাংশ সমুদ্রপথেই সম্পাদিত হয়। সমুদ্রপথে আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে প্রশান্ত মহাসাগরের ভূমিকা অপরিসীম। উত্তর আমেরিকার পশ্চিম উপকূল ও পানামা থেকে এশিয়ার পূর্ব উপকূল ও ওশেনিয়া অঞ্চল পর্যন্ত এই মহাসাগরে সুবিস্তৃত সমুদ্রপথ রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এই সমুদ্রপথ সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। এই সমুদ্র পথ দিয়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্য সম্পন্ন হয়। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং চীন প্রশান্ত মহাসাগর ব্যবহার করেই মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিপুল পরিমাণ তেল আমদানি করে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে বহু বৃহৎ বন্দর ও পোতাশ্রয় গড়ে উঠেছে। সিঙ্গাপুর, হংকং, ম্যানিলা, পানামা, ইয়োকোহামা, সিডনি, সান ফ্রান্সিস্কো, ভ্যাংকুভার ও লস অ্যাঞ্জেলস প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত সর্ববৃহৎ বন্দর গুলোর মধ্যে অন্যতম।
প্রশান্ত মহাসাগরে বেশকিছু রহস্যময় বৈচিত্র্যতা রয়েছে। আলাস্কা উপসাগর হলো এই মহাসাগরের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক স্থান। আলাস্কা উপসাগর এর যে জায়গায় বেরিং সাগর আর প্রশান্ত মহাসাগর মিলিত হয়েছে, সেখানে এই দু’টি জলরাশির পার্থক্য খুব সহজেই ধরা পড়ে। একদিকে হাল্কা আকাশী রঙের পানি, আর অন্যদিকের পানি গাঢ় নীল। খালি চোখে দেখলে মনে হবে দু’টি সাগর পাশাপাশি বয়ে চলেছে, কিন্তু কারো জল একে অপরের সাথে মিশছে না। এর কারণ হলো, বেরিং সাগরের হিমবাহ গলা স্বচ্ছ পানি প্রশান্ত মহাসাগরের পানির চেয়ে অনেক কম লবণাক্ত। তাই পানির উপাদান ও ঘনত্বের পার্থক্য থাকায় দু’টি উৎসের পানি সহজে মিশতে পারে না। তবে খালি চোখে ধরা না পড়লেও, এই দুই সাগরের জল যে একেবারেই মিশে না তা কিন্তু নয়। বিভিন্ন সময়ে সাগর দু’টির মিলনের সীমানায় পরিবর্তন দেখা যায়।
প্রশান্ত মহাসাগরের আরেকটি রহস্যময় স্থান হল জাপান, বনিন দ্বীপের মধ্যবর্তী ‘ড্রাগন ট্রায়াঙ্গেল’। সাগরের যে এলাকায় ড্রাগন ট্রায়াঙ্গেল অবস্থিত তাকে বলা হয় ‘Devils Sea’ বা শয়তানের সাগর। এখানে বহু জাহাজ ও বিমান হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। যেসবের হদিস পরবর্তীতে আর পাওয়া যায়নি।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রশান্ত মহাসাগরে অগ্ন্যুৎপাতের ফলে টোঙ্গা দ্বীপপুঞ্জের কাছে একটি নতুন দ্বীপ তৈরি হয়েছে। স্যাটেলাইট প্রযুক্তির এই যুগে দ্বীপটি সৃষ্টির শুরু থেকেই এর গঠন পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। অগ্ন্যুৎপাতের ফলে অতীতে বহু দ্বীপের সৃষ্টি হলেও বিজ্ঞানীদের দাবী এই দ্বীপ নানা কারণেই সেসবের চেয়ে আলাদা। নতুন এই দ্বীপ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মঙ্গল গ্রহের ভূমি গঠন সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য পাওয়া যাবে বলেও বিজ্ঞানীদের ধারণা।
অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চর্চা সুদৃঢ় হবার কারণে বিশ্বের প্রায় সব পরাশক্তি সমুদ্র নিরাপত্তার ক্ষেত্রে শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করেছে। আর এক্ষেত্রে প্রশান্ত মহাসাগরের অবস্থান শীর্ষে। প্রশান্ত মহাসাগরের একদিকে যেমন আমেরিকার অবস্থান, তেমনি অন্যদিকে রয়েছে চীন, জাপান ও উত্তর কোরিয়ার মতো দেশগুলো। কৌশলগত কারণেই প্রশান্ত মহাসাগরকে ঘিরে অত্যন্ত কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রশান্ত মহাসাগরের গুয়াম দ্বীপপুঞ্জে মার্কিনীরা বড় ধরনের সামরিক ঘাঁটি তৈরি করেছে। যেখানে প্রায় ১৪ হাজার গণবিধ্বংসী অস্ত্রের মজুত রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এছাড়াও হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটিতে প্রস্তুত রয়েছে অত্যাধুনিক সক্রিয় মিসাইল ব্যবস্থা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এই অঞ্চলে অন্তত ২৫০ টি যুদ্ধজাহাজ ও বহু নৌ-সেনা মোতায়েন করতে যাচ্ছে।
প্রশান্ত মহাসাগরের দক্ষিণ চীন সাগর -কে ঘিরে বিশ্ব পরাশক্তিদের মাঝে বেশ উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। আমেরিকার সাথে পাল্লা দিয়ে চীনও এই অঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় মরিয়া হয়ে উঠেছে। সাগরের বুকে কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করে এই অঞ্চলে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তুলেছে চীন। এছাড়া সেনকাকু দ্বীপ নিয়ে জাপানের সাথে চীনের বিরোধিতা রয়েছে। আরেকদিকে পরমাণু শক্তিধর উত্তর কোরিয়া মার্কিন গুয়াম দ্বীপে মার্কিন নৌ ঘাঁটিতে হামলার হুমকি দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তায় বড় ধরনের উত্তেজনা তৈরি করেছে।
প্রশান্ত মহাসাগরে দূষণের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক অনুসন্ধানে দেখা যায় প্রশান্ত মহাসাগরে ১১০০ কোটি কেজিরও বেশি প্লাস্টিক রয়েছে। ২০২৫ সাল নাগাদ এই সংখ্যা ১৫০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এসব প্লাস্টিক বর্জ্যের তিন ভাগের এক ভাগ ভূমি থেকে সরাসরি সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে প্রশান্ত মহাসাগরের বেশকিছু দ্বীপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একাধিক ভয়াবহ পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা চালায়। সেসব পারমাণবিক পরীক্ষার তেজস্ক্রিয় বর্জ্য আমেরিকা অত্যন্ত দায়সারাভাবে ফেলে রেখেছে। ভবিষ্যতে সামান্য কোনো দুর্ঘটনায় এসব বর্জ্য যদি উন্মুক্ত হয়, তাহলে তা সমগ্র মানব জাতির জন্য অত্যন্ত ভয়ঙ্কর এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে।
প্রশান্ত মহাসাগরের মতোই নানাধরনের মানবসৃষ্ট দূষণের শিকার আটলান্টিক মহাসাগর। আটলান্টিক মহাসাগরকে ঘিরে গড়ে ওঠা বিশ্ববাণিজ্য ও নিরাপত্তা কৌশল সুদৃঢ় করতে গিয়ে মহাসাগরের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাসাগর আটলান্টিক সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমাদের এই প্রতিবেদনটি পড়ুন।