চারটি মহাদেশ জুড়ে বিস্তৃত আটলান্টিক মহাসাগর বিশ্ববাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের পাঁচটি মহাদেশ ও শতাধিক দেশ আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে অবস্থিত। আটলান্টিক মহাসাগরের রহস্যময় বৈচিত্র্যতা বিজ্ঞানী ও গবেষকদের কাছে এখনও এক বিস্ময়। আটলান্টিক তীরে ইউরোপ-আমেরিকার মতো বিশ্ব পরাশক্তিদের অবস্থান হওয়ায়, এই সাগরের রাজনৈতিক ও অর্থনীতির গুরুত্ব অপরিসীম।
আমাদের আজকের প্রতিবেদনে জানাবো পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাসাগর আটলান্টিক সম্পর্কে কিছু অদ্ভুত, অজানা ও বিস্ময়কর তথ্য।
ধারণা করা হয় জুরাসিক যুগ থেকেই আটলান্টিক মহাসাগরের গঠন শুরু হয়। এর আয়তন ১০ কোটি ৬৪ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার। আটলান্টিক পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাসাগর। আটলান্টিক মহাসাগর পৃথিবীপৃষ্ঠের প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ জায়গা জুড়ে অবস্থিত। উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকা ;এই পাঁচটি মহাদেশের ১৩৩ টি দেশ আটলান্টিক মহাসাগরের তটরেখায় অবস্থিত। এই মহাসাগরে উপকূলীয় এলাকার আয়তন প্রায় ১ লক্ষ ১১ হাজার ৮৬৬ কিলোমিটার। আটলান্টিক মহাসাগরের পশ্চিমে রয়েছে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ, এবং পূর্বদিকে ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশ। মহাসাগরটি উত্তর-দক্ষিণে উত্তর মহাসাগর থেকে দক্ষিণ মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। দক্ষিণ আমেরিকার কেপ হর্নের কাছে আটলান্টিক মহাসাগর প্রশান্ত মহাসাগরের সাথে একত্রিত হয়েছে, এবং আফ্রিকার দক্ষিনে কেপ আগুলহাস এর কাছে আটলান্টিক মহাসাগর মিশেছে ভারত মহাসাগরের সাথে। এই মহাসাগর ডেনমার্ক প্রণালী, গ্রীনল্যান্ড সাগর, নরওয়েজিয়ান সাগর ও বারেন্টস সাগরের মধ্য দিয়ে আর্কটিক মহাসাগরের সাথে সংযুক্ত হয়েছে।
আটলান্টিক মহাসাগরের গড় গভীরতা প্রায় ১২ হাজার ফুট। পুয়ের্তো রিকো’র ট্রেঞ্চে অবস্থিত আটলান্টিক মহাসাগরের গভীরতম এলাকার নাম ‘মিলওয়াকি ডিপ’। এই স্থানের গভীরতা প্রায় ২৮ হাজার ফুট। আটলান্টিক মহাসাগরের সবচেয়ে বড় দ্বীপ গ্রীনল্যান্ড। গ্রীনল্যান্ডের আয়তন বাংলাদেশের আয়তনের প্রায় ১৫ গুন বড়। সরাসরি আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে থাকা ১৩৩ টি দেশের বাইরেও আরো বেশ কিছু দেশ এই মহাসাগর ব্যবহার করে যাতায়াত ও বানিজ্য করে থাকে। আটলান্টিক মহাসাগরে প্রবেশের জন্য কৌশলগত জলপথ হিসেবে উল্লেখযোগ্য হলো জার্মানির কিয়েল খাল, ডেনমার্ক ও সুইডেন এর মধ্যবর্তী ওরেসুন্ড প্রণালী, তুরস্কের বসফরাস প্রণালী, স্পেন ও মরক্কো’র মধ্যবর্তী জিব্রাল্টার প্রণালী এবং কানাডার সেন্ট লরেন্স সমুদ্রপথ।
আটলান্টিক মহাসাগরই প্রথম কোন মহাসাগর যা জাহাজের সাহায্যে অতিক্রম করা হয়েছিল। তার আগে আর কোন মহাসাগর অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে বিমান আবিষ্কার হবার পর, বিমানের সাহায্যে পাড়ি দেওয়া প্রথম কোন মহাসাগরও আটলান্টিক। ১৯১৯ সালের জন আল কক ও আর্থার ব্রাউন নামের দুই বৈমানিক আটলান্টিকের উপর দিয়ে উড়ে কানাডা থেকে আয়ারল্যান্ডে যাবার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো বিমানযোগে কোন মহাসাগর পাড়ি দেন।
আটলান্টিক মহাসাগরে বেশকিছু সাগর ও উপসাগর রয়েছে। এদের মধ্যে বাল্টিক সাগর, কৃষ্ণসাগর, উত্তর সাগর, নরওয়েজিয়ান সাগর, ভূমধ্যসাগর, ক্যারিবীয় সাগর এবং মেক্সিকো উপসাগর অন্যতম। আমাজন নদী, মিসিসিপি নদী, রিও দে প্লাতা নদী, নাইজার নদী, কঙ্গো নদী, ও রাইন নদীর মতো প্রধান প্রধান নদীগুলোর পানি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই মহাসাগরে পতিত হয়। দু’টি সাগর অথবা দুটি বিশাল জলরাশিকে সংযুক্তকারী সরু জলপথকে প্রণালী বলা হয়। আটলান্টিক মহাসাগরে একাধিক প্রণালী রয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ডেনমার্ক প্রণালী, ম্যাজালান প্রণালী, ফ্লোরিডা প্রণালী, ও ডোভার প্রণালী। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যবর্তী ডোভার প্রণালী বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ততম সমুদ্র প্রণালী। এখানে প্রতিদিন প্রায় ৪০০ বাণিজ্যিক জাহাজ যাতায়াত করে।
অতলান্তিকের জল সময় ও স্থানভেদে বরফেও পরিণত হয়। অক্টোবর থেকে জুন মাস পর্যন্ত আটলান্টিক মহাসাগরের ল্যাব্রাডর সাগর, বাল্টিক সাগর ও ডেনমার্ক প্রণালী বরফে ঢাকা থাকে।
আটলান্টিক মহাসাগর প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যতার জন্য বিখ্যাত। আটলান্টিক তীরবর্তী দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে মহাসাগরটি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। উত্তর সাগর, ক্যারিবিয়ান সাগর ও মেক্সিকো উপসাগরের প্রাকৃতিক গ্যাস, অপরিশোধিত তেল এবং মূল্যবান পাথরের প্রাচুর্যতা রয়েছে। কিউবা ও ফ্লোরিডা কিস দ্বীপপুঞ্জের মধ্যবর্তী ফ্লোরিডা প্রণালী পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য বিখ্যাত। ফ্লোরিডা প্রণালীর উত্তর কিউবা অববাহিকায় প্রায় ৮৭ কোটি ঘনমিটার পেট্রোলিয়াম, ৯.৮ ট্রিলিয়ন ঘনমিটার প্রাকৃতিক গ্যাস থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। আটলান্টিক মহাসাগরে সোনার খনিও আছে। কিন্তু তা উত্তোলনের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়ার কার্যকর পদ্ধতি এখনো আবিষ্কার হয়নি। মৎস্য সম্পদের প্রাচুর্যতার জন্য আটলান্টিক মহাসাগরের বেশ সুখ্যাতি রয়েছে। সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের দিক থেকে আটলান্টিক মহাসাগরের অবস্থান দ্বিতীয়। বিশ্বে মোট মাছের প্রায় ২৫ শতাংশ আটলান্টিক মহাসাগর থেকে আসে। অতলান্তিকের সৌন্দর্য কে কেন্দ্র করে ক্যারিবিয়ান উপকূল, ফ্লোরিডা বিচ এবং মিয়ামি বিচে বিরাট লাভজনক পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটেছে।
অন্যান্য মহা সাগরের পানি নীল দেখালেও আটলান্টিকের পানি দেখতে অনেকটাই সবুজ রঙের। আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশে মৃত জলজ উদ্ভিদ থেকে এক ধরণের হলুদ রঙের রঞ্জক পদার্থ নিঃসরিত হয়ে সমুদ্রের সাথে মিশে পানির রং সবুজাভ করে তোলে। এছাড়া আটলান্টিকের পানিতে সূর্যের সাতটি রঙের মধ্যে সবুজ রঙটি বেশি বিচ্ছুরিত হয়। ফলে আটলান্টিক মহাসাগরের পানির রং নীল এর পরিবর্তে সবুজ দেখায়। আটলান্টিকের পানি অত্যন্ত লবণাক্ত। এর জলের পৃষ্ঠদেশের তাপমাত্রা -4 ডিগ্রি থেকে 30 ডিগ্রি পর্যন্ত ওঠানামা করে।
আটলান্টিক মহাসাগর শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির অন্যতম উৎস হিসেবে পরিচিত। গ্রীষ্ম ও শরৎকালে উত্তর আটলান্টিকের পশ্চিম অংশে ঘূর্ণিঝড় হারিকেন এর প্রবণতা অধিকহারে লক্ষ্য করা যায়। ঘূর্ণিঝড়সমূহ সাধারণত আফ্রিকার কেপ ভার্দে উপকূল থেকে বিস্তৃতি লাভ করে পশ্চিমে ক্যারিবিয়ান সাগরের দিকে ধাবিত হয়। উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে সবচেয়ে বেশি ঘূর্ণিঝড় দেখা যায় সেপ্টেম্বর মাসে।
বিশ্ব বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আটলান্টিক মহাসাগর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমুদ্রপথে ইউরোপের সাথে আমেরিকার পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে আটলান্টিকের বিকল্প নেই। একইভাবে এশিয়া এবং আফ্রিকার সাথে আমেরিকার বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আটলান্টিক মহাসাগর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আন্তঃমহাদেশীয় সমুদ্র বাণিজ্য চালু হবার পর থেকেই পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে আটলান্টিক মহাসাগরের ব্যবহার প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর তাই আটলান্টিক মহাসাগর কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বহু বন্দর ও পোতাশ্রয়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া, স্পেনের বার্সেলোনা, ডেনমার্কের কোপেনহেগেন, জার্মানির হামবুর্গ, গ্রেট বৃটেনের লন্ডন, ফ্রান্সের লে হার্ভে, পর্তুগালের লিসবন, নরওয়ের অসলো, নেদারল্যান্ডের রটারডার্ম, রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ, কানাডার মন্ট্রিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ও নিউ অর্লিন্স, ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিও, আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্স ইত্যাদি। এখানেই শেষ নয়, এছাড়াও আরও ছোট-বড় বহু বন্দর আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে গড়ে উঠেছে।
অধিক পরিমাণে জাহাজ চলাচলের কারণে অতলান্তিকের জলে মিশছে বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য। যা মহাসাগরের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য প্রত্যক্ষ হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আটলান্টিক মহাসাগরের বাণিজ্যিক গুরুত্বের পাশাপাশি বেড়েছে এ জলের নিরাপত্তা ঝুঁকি। সাম্প্রতিক সময়ে জলদস্যুতা আটলান্টিকের সমুদ্রপথকে বিপদজনক করে তুলেছে। ২০১৪ সালে গিনি উপসাগরে প্রায় ৪১ টি বাণিজ্যিক জাহাজ জলদস্যু কতৃক আক্রমণের শিকার হয়েছে। ২০০০ সাল থেকে আন্তর্জাতিক রুটে চলাচলকারী জাহাজগুলোর জন্য রীতিমতো হুমকি হয়ে ওঠে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। সোমালিয়ান জলদস্যুদের প্রধান বিচরণ ক্ষেত্র ভারত মহাসাগর ও আরব মহাসাগর হলেও, আটলান্টিক মহাসাগর গামী জাহাজগুলোও তাদের শিকারে পরিণত হয়।