পূর্ব ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ার মধ্যে অবস্থিত একটি বিশেষ সামুদ্রিক অঞ্চল ‘কৃষ্ণ সাগর’। প্রাচীন বিশ্বের বহু সমুদ্র বাণিজ্যে এই সাগরের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কৃষ্ণ সাগরের তলদেশে প্রাপ্ত হাজার বছরের পুরনো জাহাজের ধ্বংসাবশেষ থেকে তার প্রমাণ মিলেছে।
ইউরোপ ও এশিয়ার একাধিক সমুদ্র এবং প্রণালীর সাথে যুক্ত কৃষ্ণ সাগর সম্পর্কে জানাবো আমাদের এই প্রতিবেদনে।
কৃষ্ণ সাগর পূর্ব ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়া অঞ্চল -কে পৃথক করেছে। এই সাগরের তীরবর্তী দেশগুলো হলো- বুলগেরিয়ার, রোমানিয়া, জর্জিয়া, রাশিয়া, তুরস্ক এবং ইউক্রেন। এই সাগরটি বহুপথ পাড়ি দিয়ে একাধিক প্রণালী এবং সাগরের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে অবশেষে আটলান্টিক মহাসাগরের সাথে মিশেছে। তবে কৃষ্ণ সাগরের সাথে আটলান্টিক মহাসাগরের সংযোগ অতটা সরল নয়। কৃষ্ণ সাগর প্রথমে বসফরাস প্রণালীর মাধ্যমে মর্মর সাগরের সাথে যুক্ত হয়েছে। এরপর দার্দানেলিস প্রণালীর মাধ্যমে এই সাগর সংযুক্ত হয়েছে এজিয়ান সাগরের সাথে। আর সেখান থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে সবশেষে জিব্রাল্টার প্রণালীর মাধ্যমে কৃষ্ণ সাগর আটলান্টিক মহাসাগরের সাথে সংযুক্ত হয়। এছাড়া কৃষ্ণ সাগরের সাথে যুক্ত আরেকটি সাগর হল আজভ সাগর। কের্চ প্রণালীর মাধ্যমে সাগর দু’টি সংযুক্ত রয়েছে। কৃষ্ণ সাগরের আয়তন ৪ লক্ষ ৩৬ হাজার ৪০০ বর্গ কিলোমিটার। সাগরটির গড় গভীরতা প্রায় ৪১১১ ফুট এবং সর্বোচ্চ গভীরতা ৭২৫০ ফুট।
কৃষ্ণ সাগরের নামকরণ কিভাবে হয়েছে সে বিষয়ে কেউই ঐক্যমতে আসতে পারেনি। অতীতে বিভিন্ন সময়ে এই সাগরকে বিভিন্ন নামে ডাকা হতো। একসময় এর নাম ছিল ‘আতিথেয়তাশুন্য সাগর’। কারণ তখন এর তীরে বসবাসকারী বিভিন্ন বর্বর উপজাতি সাগরে চলাচলকারি জাহাজে আক্রমণ চালাতো। পরবর্তীতে গ্রীকরা এই সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল বিজয় করার পর এর নাম দেয় ‘আতিথিয়তাপূর্ণ সাগর’। তবে ধারণা করা হয়, বর্তমানে প্রচলিত নামটি এসেছে মধ্যযুগের অটোমান সাম্রাজ্যের আমলে। তুরস্কের লোকেরা এই সাগরটিকে ‘বাহর ই সিয়াহ্’ অথবা ‘কারাডেনিজ’ নামে ডাকত, যার অর্থ ‘কৃষ্ণ সাগর’। অতীতে শীতকালে এই সাগরে সামুদ্রিক ঝড় উঠলে সাগরের পানি অত্যন্ত কালো দেখাতো। তখন নাবিকেরা সাগরটির এমন নামকরণ করেন।
প্রায় সাত হাজার বছর আগে বর্তমান কৃষ্ণ সাগর ছিল একটি মিঠাপানির হ্রদ। পরবর্তীতে ভূমধ্যসাগর থেকে লবণাক্ত পানি কৃষ্ণ সাগরে প্রবেশ করে। তখন কৃষ্ণ সাগরের মিঠাপানির জলজ প্রাণী গুলো মারা যায়, এবং লোনাপানির সামুদ্রিক জীব এখানে বসবাস করতে শুরু করে।
কৃষ্ণ সাগরের আশেপাশে একাধিক পার্বত্য অঞ্চল রয়েছে। ফলে এসব পাহাড় থেকে সৃষ্ট বহু নদী কৃষ্ণ সাগরে পতিত হয়। নদী গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দানিয়ুব নদী, নিপার নদী, ডিওনী নদী এবং পিভডেনিই বাহ নদী। একাধিক দেশের অধীনে কৃষ্ণ সাগরের ছোট ছোট দশটি দ্বীপ রয়েছে। বর্তমানে এসব দ্বীপে জনপ্রিয় পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।
কৃষ্ণ সাগরের ৬৫০ ফুট নিচ থেকে এর পানিতে অক্সিজেনের স্বল্পতা রয়েছে। এর কারণ হলো এই সাগরের উপর ও নিচের স্তরের পানি খুব সামান্য সঞ্চালিত হয়, এবং দুই স্তরের পানির মিশ্রণ খুব কম ঘটে। ফলে সাগরের নিচের দিকে অক্সিজেন সহজে পৌঁছাতে পারে না। অক্সিজেনের অভাবে কৃষ্ণ সাগরের তলদেশের পরিবেশ জৈবিক ভাবে মৃতপ্রায়। এছাড়া এই অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে বিভিন্ন জাহাজের ধ্বংসাবশেষ সহজে নষ্ট হয় না। তুরস্কের উত্তর দিকের কৃষ্ণ সাগর অংশে সাগরের তলদেশে প্রায় চল্লিশটি পুরনো জাহাজের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। জাহাজ গুলো দেখে সহজেই বোঝা যায়, এগুলো বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সময়কার বাণিজ্যিক জাহাজ। যা প্রায় হাজার বছর আগে নিমজ্জিত হয়েছিল। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এত দীর্ঘ সময়েও কাঠের তৈরি সেইসব জাহাজে পঁচন ধরেনি। এমনকি সেই সময়ের জাহাজের দড়ি পর্যন্ত অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে। এছাড়া ১৩ শতকের ইতালীয় বণিক মার্কো পোলো’র আমলের কিছু জাহাজও এই সাগরের নিচে খুঁজে পাওয়া যায়।
কৃষ্ণ সাগরের সাথে সংযুক্ত সবচেয়ে বড় সামুদ্রিক অঞ্চল ভূমধ্যসাগর। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা ;এই তিনটি মহাদেশের মাঝখানে ভূমধ্যসাগরের অবস্থান। অতীতের বহু প্রভাবশালী সভ্যতা ও সাম্রাজ্য ভূমধ্যসাগরের তীরে গড়ে উঠেছিল। একাধিক প্রাচীন সভ্যতার আঁতুড়ঘর হিসেবে খ্যাত ভূমধ্যসাগর সম্পর্কে জানাবো আমাদের পরবর্তী প্রতিবেদনে।