অদ্ভুত এক প্রাণী বনরুই। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই এই প্রাণীটিকে কখনো সামনাসামনি দেখেনি। এমনকি অনেকে এর নামই শোনেনি। অথচ মানুষের নির্মম আচরণের শিকার হয়েই প্রাণীগুলো আজ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। চীন এবং ভিয়েতনামসহ এশিয়ার বহু দেশে নানান রোগের ঔষধ তৈরিতে এবং খাদ্য হিসেবে বনরুই -এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সম্প্রতি বনরুই -এর শরীরে এমন ভাইরাস পাওয়া গেছে, যা করোনাভাইরাসের সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ভাবে সম্পর্কিত।
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি অবৈধভাবে পাচার হওয়া প্রাণী বনরুই সম্পর্কে জানাবো আমাদের এই প্রতিবেদনে।
সারা শরীরে রুই মাছের মত আঁশ এবং বনে জঙ্গলে বিচরণ করার কারণে প্রাণীটির নামকরণ করা হয়েছে ‘বনরুই’। মালয় ভাষায় এটাকে বলা হয় ‘পেঙ্গুলিং’। সেখান থেকেই এদের ইংরেজি নাম হয়েছে ‘প্যাঙ্গোলিন’। উত্তর ভিয়েতনামের লোকজন বনরুইকে বলে ‘তে তে’, এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামের লোকেরা একে বলে ‘ত্রুত’।
বনরুই মূলত নিশাচর প্রাণী। রাতের বেলা এরা খাবার খুঁজতে বের হয়। এদের মুখে কোন দাঁত নেই। তবে অনেক লম্বা জিহ্বা আছে। বনরুই একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী, যাদের শরীরে আঁশ আছে। আর এই আঁশই তাদের বিপদের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরা সাধারণত পিঁপড়া ও ছোট পোকামাকড় আহার করে। অতীতে বনরুইকে দাঁতহীন স্তন্যপায়ী প্রাণীদের দলে অন্তর্ভুক্ত করা হতো। কিন্তু এদের বেশ কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে বর্তমানে এদেরকে ‘ফোলিডোটা’ নামে আলাদা একটি দলে ফেলা হয়েছে। ফোলিডোটা বর্গের একমাত্র প্রাণী এই বনরুই।
শুধুমাত্র এশিয়া ও আফ্রিকার মহাদেশের বেশ কয়েকটি দেশে এদের পাওয়া যায়। পৃথিবীতে সাতটি প্রজাতির বনরুই আছে। এশিয়া মহাদেশে পাওয়া যায় চারটি প্রজাতি। তার মধ্যে বাংলাদেশের রয়েছে তিনটি প্রজাতির বনরুই। সেগুলো হলো- দেশি বনরুই, চায়না বনরুই এবং মালয়ী বনরুই।
প্রাণীটি অত্যন্ত লাজুক এবং ভীতু হওয়ার কারণে এদেরকে চিড়িয়াখানায় রাখা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। এরা সহজে অন্য কোন প্রাণীর সামনে আসতে চায় না। বনরুই যখন ভয় পায়, তখন তারা পুরো শরীরটাকে অদ্ভুতভাবে মুড়ে গোল হয়ে যায়। শুধুমাত্র মানুষ ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোন প্রাণী তাদেরকে এই অবস্থা থেকে ছাড়াতে পারে না
চোরাই পথে সবচেয়ে বেশি পাচার হওয়া স্তন্যপায়ী প্রাণী বনরুই। চীন এবং ভিয়েতনামে বনরুই -এর শরীরের আঁশ থেকে ঐতিহ্যবাহী ঔষধ তৈরি করা হয়। এদের মাংসও অত্যন্ত মূল্যবান ও উপাদেয় খাদ্য হিসেবে বিবেচিত। অনেকেই মনে করে বনরুই -এর অাঁশ মানুষের বন্ধ্যাত্ব থেকে শুরু করে ক্যান্সার সহ সকল ধরনের রোগের ঔষধ। যদিও এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, তবুও এই ধারণা এতই বদ্ধমূল যে ভিয়েতনামের কিছু হাসপাতালেও বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় বনরুই -এর আঁশ ব্যবহার করা হয়। বনরুই -এর আঁশ ক্যারোটিন নামের এক ধরনের শক্ত প্রোটিন দ্বারা তৈরী। ক্যারোটিনের সবচেয়ে সহজ উদাহরণ হলো মানুষের নখ। শুধু নখ নয়, মানুষের চুলও ক্যারোটিন দ্বারা তৈরি।
কয়েক বছর আগে অবৈধভাবে পাচার করার সময় একসাথে ৪৮ টন বনরুই -এর আঁশ জব্দ করা হয়। তবে পাচারকারীরা প্রতি বছর শত শত টন বনরুই -এর আঁশ সফলভাবে পাচার করতে সক্ষম হয়। যেখানে একটি বনরুই -এর শরীরে মাত্র প্রায় ৭০ টি আঁশ থাকে, সেখানে এত বিপুল পরিমাণ আঁশের জন্য কত লক্ষ বনরুই হত্যা করা হয় তা কল্পনাতীত।
ভিয়েতনাম এবং নাইজেরিয়া বনরুই পাচারের অন্যতম কেন্দ্র। বনরুই -এর সকল ধরনের ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও ভিয়েতনামে এগুলো খুবই সহজলভ্য। ২ কেজি ওজনের একটি ছোট্ট বনরুই -এর দাম প্রায় ৫০ হাজার টাকার উপরে। ১০০ গ্রাম বনরুই -এর আঁশের দাম প্রায় চার হাজার টাকা। অর্থাৎ এক কেজির দাম প্রায় ৪০ হাজার টাকা। চীন ও ভিয়েতনামের রেস্তোরাঁগুলোতেও বনরুই -এর মাংসের তৈরি বিভিন্ন খাবার পাওয়া যায়। শুধু ঔষধ বা খাবারই নয়, এমনকি অলঙ্কার হিসেবেও এদের আঁশ ব্যবহৃত হয়।
বন্যপ্রাণীর অবৈধ পাচার ও খাদ্য হিসেবে গ্রহণের বিষয়টিকে নতুন করে আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে করোনাভাইরাস। চীনসহ এশিয়ার বেশ কিছু দেশের বন্যপ্রাণীর বাজারে বিভিন্ন প্রজাতির পশু-পাখিদেরকে এমন ভাবে রাখা হয়, যেখান থেকে এক প্রাণীর ভাইরাস অন্য প্রাণীর শরীরে খুব সহজেই ছড়াতে পারে। তার উপর আবার এসব প্রাণী বিক্রীই করা হয় মানুষের খাদ্য হিসেবে। চীনে পাচার হওয়া বনরুই -এর মধ্যে দুই ধরনের করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে। যাদের সাথে কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাসের অনেক মিল রয়েছে। যদিও মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের বাহক হিসেবে বনরুই -এর ভূমিকা কতটুকু, তা জানতে আরও গবেষণা প্রয়োজন। তবে একাধিক প্রাণীর দেহ ঘুরে তারপর করোনাভাইরাস মানুষের দেহে আসার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এশিয়ার বনরুই আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়ার পর প্রাণীটির ব্যাপক চাহিদা পূরণ করতে পাচারকারীরা এখন আফ্রিকার বনরুইদের পেছনে লেগেছে। প্রকৃতি থেকে একটি প্রাণী বিলুপ্ত হলে সমগ্র প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হতে বাধ্য। আপনি এই প্রতিবেদনটি পড়ার সময়ও অন্তত একটি বনরুই প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। কারণ প্রতি ৫ মিনিটে একটি বন রুই পাচারকারীদের শিকারে পরিণত হয়।
বন্যপ্রাণীর অবৈধ ব্যবহার শুধু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ই ডেকে আনবে না, এটা যে সমগ্র বিশ্বের মানুষকে ভয়াবহ স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতেও ফেলতে পারে তার উদাহরণ আজ আমাদের সবার সামনেই রয়েছে।