‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে
প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে
বই, সেতো অনন্ত যৌবনা।’
-ওমর খৈয়াম
বই নিয়ে এই বিশ্ববিখ্যাত উক্তিটি যে কত সাহিত্য, কত পাঠ্যে পঠিত হয়েছে তার হিসেব করা খুবই কঠিন। ওমর খৈয়াম একাধারে প্রেম ও বিরহের কবি, গণিতবিদ, দার্শনিক ও জ্যোতির্বিদ। পারস্যের খোরাসানের অন্যতম সেরা শিক্ষক হিসেবে বিবেচিত ইমাম মোয়াফেফক নিশাপুরীর ছাত্র ছিলেন ওমর খৈয়াম। ইরানের নিশাপুর শহরে ওমরের জন্ম। তার পিতা ছিলেন তাঁবুর কারিগর ও মৃৎশিল্পী। ছোটবেলায় তিনি বালি শহরে সে সময়কার বিখ্যাত পণ্ডিত শেখ মুহাম্মদ মানসুরীর তত্ত্বাবধানে শিক্ষালাভ করেন। যৌবনে তিনি ইমাম মোআফ্ফাক-এর অধীনে পড়াশোনা করেন।
বিজ্ঞানে ওমর খৈয়ামের অবদান:
জীবদ্দশায় ওমরের খ্যাতি ছিল গণিতবিদ হিসাবে। ইসলামী সভ্যতার জ্ঞান-বিজ্ঞানের সোনালী যুগে তথা এখন থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে বীজগণিতের যেসব উপপাদ্য এবং জ্যোতির্বিদ্যার তত্ত্ব ওমর খৈয়াম দিয়ে গেছেন সেগুলো এখনও গণিতবিদ এবং মহাকাশ গবেষক বা জ্যোতির্বিদদের গবেষণায় যথাযথ সূত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তিনি পরাবৃত্ত ও বৃত্তের ছেদকের সাহায্যে ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধান করেন। এছাড়া তিনি দ্বি-পদী রাশিমালার বিস্তার করেন। ওমরের আর একটি বড় অবদান হলো ইউক্লিডের সমান্তরাল স্বীকার্যের সমালোচনা যা পরবর্তী সময়ে অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতির সূচনা করে।
মর খৈয়াম জ্যোতির্বিদ হিসাবেও সমধিক পরিচিত ছিলেন। সেলজুকের বাদশাহ মালিক শাহ ১০৭৩ সালে আরো কয়েকজন বিজ্ঞানীর সঙ্গে ওমরকেও আমন্ত্রণ জানান একটি মানমিন্দর নির্মাণের জন্য। ওমর তখন অত্যন্ত সফলভাবে (দশমিকের পর ছয় ঘর পর্যন্ত) সৌর বছরের দৈর্ঘ্য পরিমাপ করেন। তার হিসাবে এটি ছিল ৩৬৫.২৪২১৯৮৫৮১৫৬ দিন। এই ক্যালেন্ডারের হিসাবে প্রতি ৫,৫০০ বছরে এক ঘণ্টার গড়মিল হয়ে থাকে।
রুবাইয়াৎ
রুবাইয়াত’ শব্দটি ‘রুবাই’ শব্দের বহুবচন। ‘রুবাই’ শব্দের অর্থ হলো চতুষ্পদী বা চারলাইনের কবিতা-ছত্র। রুবাইতে সাধারণত প্রথম, দ্বিতীয় ও চতুর্থপদে অন্ত্যমিল থাকে, তুতীয় পদটি ভিন্ন সুর বা বিষম হয়। অর্থাৎ এরা ক ক খ ক ছন্দ অনুসরণ করে। মনে হয়, এভাবে কবিতা রচনার ফলে কবিতার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। অনেকটা আমাদের পড়া সনেট এর মত , অর্থাৎ চতুর্দশপদী কবিতাবলী।
তার কবিতাগুলো তার ইন্তেকালের ৭৩৪ বছর পর ১৮৫৭ সালে এডোয়ার্ড ফিজারেল্ড ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন। এরপরই ওমর খৈয়ামের মনের খেয়ালের রচনাগুলো প্রকৃতির খেয়ালে বিশ্বের সাহিত্য অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত হয়। আর সেই সঙ্গে ওমর খৈয়ামকে অন্যতম সেরা কবির আসনে সমাসীন করে।
জীবনের শেষদিকে এসে হয়েছেন শিক্ষক; শিক্ষাদান করেছেন ইবনে সিনার দর্শন ও গণিত বিষয়ে। ‘রুবাইয়াত-ই-ওমর খৈয়াম’ বইটি ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয়। এর লেখক কাজী নজরুল ইসলাম। ওমর খৈয়ামের রুবাই বা কবিতা অবলম্বনে এই অনুবাদগ্রন্থ রচনা করেন কাজী নজরুল।
ওমর খৈয়ামের জীবনের অনেক দিকই আমাদের অজানা। তার অনেক কাজও দুর্ভাগ্যজনকভাবে হারিয়ে গেছে কালের স্রোতে। তার দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তার বিয়ে নিয়ে অনেক মতবিরোধ রয়েছে। তবে ধারণা করা হয়, তিনি বিয়ে করেছিলেন এবং তার একটি সন্তানও ছিল। তবে এই ধারণার সঙ্গে অনেকে দ্বিমত পোষণ করেছেন। আরেক সূত্র দাবি করে তিনি কখনো বিয়ে করেননি। ১১৩১ সালের ৪ ডিসেম্বর ওমর খৈয়াম তার জন্মস্থান নিশাপুরে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি মৃত্যুর আগে এমন একটি বাগানে তার লাশ সমাহিত করার কথা বলে গিয়েছিলেন, যেখানে বছরে দুইবার ফুল ফোটে। একটি সূত্র দাবি করে যে, মৃত্যুর আগে ওমর খৈয়াম তার ছাত্রদের শেষবারের মতো বিশেষ উপদেশে দানের জন্য আহ্বান জানান। এরপর তিনি ভালোভাবে ওজু করেন এবং এশার নামাজ আদায় করেন। সেজদা অবস্থায়ই তিনি ইন্তেকাল করেন।
ওমর খৈয়ামের বিখ্যাত রুবাইয়াৎ এর ৪ টি লাইন দিয়ে শেষ করবো
সৃষ্টির রহস্য জানো না তুমি, জানি না আমি
এ এমন এক জটিল বাক্য যা পড়তে পারো না তুমি, না আমি
পর্দার আড়ালে তোমায় ও আমার মাঝে চলছে এ আলাপ
পর্দা যেদিন উঠে যাবে সেদিন থাকবে না তুমি ও আমি।