ইতিহাসের সেরা ফুটবলার বলতে আমাদের সবার মাথায় প্রথম আসে পেলে, ম্যারাডোনা, কাকা, মেসি কিংবা রোনালদোর নাম। কার্লোস কাইজার আবার কে? কোন ম্যাচ খেলে কিভাবে ফুটবল ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড় হওয়া যায় ! চলুন ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখে আসি কিভাবে সেরা খেলোয়াড়ের তকমা পেয়েছিলেন কার্লোস কাইজার।
১৯৬৩ সালে ব্রাজিলে জন্ম নেন ইতিহাসের এই সেরা খেলোয়াড়। তার আসল নাম কার্রোস হেনরিক রাপোসো। বিখ্যাত ফুটবলার ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের সাথে চেহারার মিল থাকায় তার ডাকনাম হয়ে যায় কাইজার। ছোটবেলা থেকেই ফুটবল প্রেমী কার্লোস কাইজার (Carlos Kaiser) ফুটবলার হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চাইলেই তো হবেনা, থাকতে হবে ফুটবলীয় প্রতিভা। কাইজারের মনে ফুটবলের প্রতি প্রেম থাকলেও ছিলোনা প্রতিভা। অনেকগুলো ক্লাবে তিনি ট্রায়াল দিয়েও কোথাও টিকতে পারেননি।
কিন্তু ১৯৭৯ সালে মেক্সিকান ক্লাব “পুয়েবলা” কোনো এক অজানা ভুলের কারনে তাকে ট্রায়ালে পছন্দ করে, এবং সাইন করে নেয়। ১৬ বছর বয়সে কাইজার খেলতে যান মেক্সিকোতে। কিন্তু মাসখানেক পরেই ক্লাব কর্মকর্তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে কাইজারকে দেশে ফেরত পাঠান। কাইজার ব্রাজিলে ফেরত এসে হতাশ হয়ে পরেন। তিনি ফুটবলার হতে চান কিন্তু তার কোন ফুটবলীয় প্রতিভা নেই। এসব ভাবতে ভাবতেই এক সময় তার মাথায় আসে এক ভণ্ডামি বুদ্ধি।
পরিকল্পনা মোতাবেক প্রথমেই তিনি ব্রাজিলের কয়েকজন নামকরা ফুটবলারদের সাথে খুব ভালো খাতির জমালেন। তাদের মধ্যে ছিলেন কার্লোস আলবার্তো তোরেস, রিকার্দো রোচা ও রেনাতো গাউচো। নিজেকে তোরেস, রোচা ও গাউচোর বন্ধু হিসেবে তিনি সব জায়গায় পরিচয় দিতে লাগলেন। তারপর কিছু অখ্যাত পত্রিকার রিপোর্টারকে ঘুষ দিয়ে কার্লোস কাইজার নিজের নামে ভুল খবর ছাপালো। সেই খবরে বলা হলো, “পুয়েবলার হয়ে মেক্সিকান লীগে তিনি এতো ভালো খেলেছিলেন, যে তাকে মেক্সিকোর জাতীয় দলে খেলার জন্য অফার করা হয়েছিলো এবং মেক্সিকোর সিটিজেনশিপ দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু তিনি দেশের টানে সেসব অফার রিজেক্ট করেছেন।”
এই খবর দেখেই ব্রাজিলের অনেকগুলো ক্লাব তাকে খেলার জন্য অফার করলো। কারণ তখনকার দিনে তেমন কোন প্রযুক্তি ছিলো না সব নিউজ কনফার্ম করার। আর কার্লোস আলবার্তো ও রেনাতো গাউচোর বন্ধু বলে কেউই তাকে সন্দেহ করেনি।
আরো পড়ুনঃ
১৯৮১ সালে তিনি বোতাফোগো নামের একটি ক্লাবে জয়েন করলেন। কিন্তু তিনি ক্লাবের সাথে কন্ট্রাক্টে কিছু শর্ত লাগিয়ে দিয়েছিলেন।
তার ভেতর একটা ছিলো কিছুটা এমন, “অনেকদিন খেলাধুলা থেকে দূরে থাকায় তার ম্যাচ ফিটনেস্ নেই। তাই প্রথম এক মাস তিনি শুধু ফিজিক্যাল ট্রেনিং করে কাটাবেন।”
মাসখানেক ফিজিক্যাল ট্রেনিং শেষে তিনি যখন মেইন টিমের সাথে ট্রেনিংয়ে আসেন, তখন কয়েকটা দৌড় দিয়েই তিনি মাটিতে শুয়ে পড়েন এবং হ্যামস্ট্রিং ইনজুরির অভিনয় করেন। এরপর কয়েকদিন রেস্ট নিয়ে ট্রেনিংয়ে ফেরার পর তিনি আবার ইনজুর্ড হওয়ার অভিনয় করেন।
তখনকার দিনে ইনজুরি কনফার্ম করাটা অনেক কঠিন ব্যপার ছিলো। কারণ এমআরআই (MRI) করতে অনেক টাকা লাগতো এবং একটা সাধারন ব্রাজিলীয়ান ক্লাবের জন্য সেটা সম্ভব ছিলো না। কিন্তু তবুও কয়েকবার এরকম ইনজুরি নিয়ে অভিনয় করার পর ক্লাব তার MRI করে। MRI করলেও কাইজার ক্লিনিকের কর্মচারীদের ঘুষ দিয়ে একটা ফেইক মেডিকেল সার্টিফিকেট বের করে এনেছিলেন।
ক্লাব ধীরে ধীরে অনেক বিরক্ত হয়ে উঠছিলো তার ইনজুরি নিয়ে। তারপর একসময় তারা রিলিজ করে দেয় কাইজারকে…
এরপর কাইজার ১৯৮২ সালে আরেক ব্রাজিলীয় ক্লাব ফ্লামেঙ্গোতে জয়েন করেন এবং সেখানে তিন সিজন খেলেন ! এই তিন সিজন পুরোটাই তিনি ইনজুরির অভিনয় করে কাটিয়েছিলেন। কিন্তু ফ্লামেঙ্গোতে তিনি তিন সিজন কিভাবে টিকলেন ! কোচ বা সতীর্থ কেউ তো খেয়াল করার কথা যে কাইজার খেলতে পারে না!
আসলে এই কথা টিমের সবাই জানতো ! কাইজার ফুটবলে পারদর্শী ছিলেন না ঠিকই কিন্তু তিনি ছিলেন প্রচন্ড ধুরন্ধর। তিনি সব টিমমেটদের উদ্দেশ্যে গোপনে পার্টি দিতেন এবং তাদের জন্য সুন্দরী মেয়ে ভাড়া করে আনতেন। এর বিনিময়ে সবাই মুখ বন্ধ রাখত।
ফ্লামেঙ্গো অধ্যায়ের পর তিনি নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে এবার যান ফ্রান্সের লীগ টু’র ক্লাব আজাসিয়োকে বোকা বানাতে। কিন্তু তিনি সেখানে নেমেই আরেক বিপদে পড়েন। ক্লাবটি তাদের ফ্যানদের কাছে কাইজারকে তাদের ইতিহাসের সেরা সাইনিং হিসেবে প্রোমোট করেছিলো এবং সেজন্য তার প্রেজেন্টেশনের দিন আলাদা করে দর্শকদের সামনে একটা প্র্যাক্টিস সেশন এ্যরেঞ্জ করেছিলো।
এখানেও কাইজার নিজের বুদ্ধিমত্তায় সিচুয়েশন ট্যাকেল দিয়েছিলেন। তিনি প্রাকটিস সেশনে অন্য সবার মতো ফুটবল নিয়ে কারিকুরি না দেখিয়ে সরাসরি বলগুলো নিয়ে ফ্যানদের উদ্দেশ্যে কিক করে মারেন এবং ক্লাবের জার্সিতে চুমু খেতে থাকেন। এ যাত্রায় বেঁচে গেলেও ইউরোপ তো ব্রাজিলের মতো এতো বোকা এবং অনুন্নত ছিলো না। কিছুদিনের মধ্যেই তার ভণ্ডামি ধরা পরে যায় এবং পরের সিজনেই তিনি দেশে ফিরে আসেন।
দেশে ফিরে এসেই তিনি সংবাদপত্রে ছাপিয়ে দেন যে, “কাইজার আজাসিয়োতে ৮ সিজন ছিলেন এবং সেই ক্লাবের টপ গোল স্কোরার হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন!” এই খবর দেখে বাঙ্গু নামের একটা ক্লাব তাকে সাইন করে নেয়। বাঙ্গুর কোচ ছিলেন নাছোরবান্দা। একটি ম্যাচে ২-০ গোলে পিছিয়ে পরায় তিনি ইনজুরি থাকা সত্বেও কাইজারকে সাবস্টিটিউট হিসেবে নামাতে চান। অবশেষে কাইজার ওয়ার্ম-আপ করতে টাচ লাইনে যান। তার মাথায় তখন ভয় কাজ করছে। কি করবেন তিনি ! মাঠে নামলে এক মিনিটের মধ্যেই দর্শকসহ সবাই বুঝে যাবে তার ফুটবলের প্রতিভা কিরকম !
ঠিক সেই সময়েই কাইজার আবার সুযোগ পেয়ে গেলেন ! কয়েকটা ফ্যান তার দলের বিরুদ্ধে আজেবাজে চ্যান্ট দিচ্ছিলো। কাইজার গিয়ে সেই ফ্যানদের সাথে মারামারি শুরু করলেন এবং মাঠে নামার আগেই রেফারি তাকে লাল কার্ড দেখিয়ে দিলেন। এভাবে বছরের পর বছর ব্রাজিলের বিভিন্ন ক্লাবকে তিনি বোকা বানিয়ে ১৯৯২ সালে তিনি অবসর গ্রহন করেন।
এখনকার দিনে কাইজারের ভণ্ডামি ধরা সহজ হলেও তখনকার দিনে খুবই কঠিন ছিলো। কারন ব্রাজিলের মতো বড় এবং অনুন্নত দেশে এক জায়গার খবর অন্যজায়গায় পৌছানো অনেক কষ্টকর ছিলো।
২০১৫ সালের নভেম্বরে ব্রিটেনের একটি প্রোডাকশন হাউজ কাইজারের গল্পের উপর ভিত্তি করে একটি সিনেমা বানানোর কাজ হাতে নেয়। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে “Kaiser! The Greatest Footballer Never to Play Football” নামের ওই সিনেমাটি মুক্তি পায়।
২০১৮ সালে কাইজারকে নিয়ে সাংবাদিক রব স্মিথের লিখা “Kaiser: The Greatest Footballer Never to Have Played Football” বইটি প্রকাশ করা হয়।