চা সম্পর্কে এমন কিছু চমকপ্রদ তথ্য রয়েছে, চায়ে নিদারুণ ভাবে আসক্ত অনেক ব্যক্তিরাও যা একদমই জানেন না। শুধু দিনভর চা পান করেই যাচ্ছেন। চায়ের ইতিহাস সম্পর্কে বলতে গেলে এতটাই পেছনে ফিরে যেতে হবে, যা আপনার ধারণারও বাইরে। আজকে আপনার হাতে ধূমায়িত এক কাপ চায়ের পেছনে রয়েছে উটের কাফেলা, আধ্যাত্মিক প্রয়োজন এবং বিপ্লবের চমৎকার কিছু ইতিহাস। সারাদিন আপনার পান করা পানীয়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কি কি? এই প্রশ্নের উত্তরে সবচেয়ে বেশি আসবে চায়ের নাম।
চাহিদার কারণে গত ৩ শতাব্দীতে এর পাতার ধরণে এসেছে অভাবনীয় পরিবর্তন। কিন্তু এর চাহিদা ঠিক একইরকম রয়ে গেছে। উটের কাফেলা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বিপ্লব – এবং এমনকি আধ্যাত্মিক জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে চা মানবজাতির জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। ১০টি চমকপ্রদ তথ্যের মাধ্যমে এই চায়ের ইতিহাস আজকে জানাবো। অল্প কথায় পড়ুন বাকিটুকু…
চা পানের সূচনা চীনে ২০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে
মধ্য চীনের ইয়াং লিং সমাধিস্তম্ভে প্রাচীনকালে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে বা মমি তৈরিতে যেসব জিনিসপত্র উৎসর্গ দেয়া হত, তারমধ্যে পাতা দিয়ে তৈরি শুকনো কেক দেখা যেত। এইসব পাতার মধ্যে থাকা থিয়ানিন এবং ক্যাফেইন প্রমাণ করে যে, সেগুলো ছিলো চা পাতা, যা কিনা মৃতদের সাথে দিয়ে দেয়া হত তাদের পরলৌকিক জীবনের অনুষঙ্গ হিসেবে। ২০০ বছর আগে এভাবে চায়ের ব্যবহার হওয়ার সময়কালের কথা জানা যায়।
ধর্মীয় অভিজ্ঞতা
চীন থেকে ফিরে আসা জাপানি ধর্মগুরু ও দূতদের হাত ধরে জাপানে চা আসে। এই চা ষষ্ঠ শতকের দিকে এবং দ্রুত তা ধর্মীয় শ্রেণীর মানুষদের পছন্দের পানীয় হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। আর গরম পানির সংস্পর্শে এসে হালকা সবুজ রং ধারণকারী গ্রিন-টি কয়েক শতাব্দী ধরে দেশটির সংস্কৃতিবান এবং উচ্চবিত্ত সমাজের মানুষদের কাছে প্রাধান্য পেয়ে আসছে। পনেরো শতকে চায়ের সংস্কৃতির সাথে বৌদ্ধ ধর্ম-ভিক্ষুরা পরিচিত হয় চীন থেকে। কিন্তু জাপানিরা একে তাদের নিজস্ব রীতিনীতি ও প্রথায় রূপ দেয়, যা একরকম ধর্মীয় পর্যায়ের সামাজিক প্রথাতে পরিণত হয়।
চীনের একচেটিয়া বাজারে ভাঙ্গন
৭০০ খ্রিষ্টাব্দে চীন এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কে ভাঙ্গন ধরলে ব্রিটিশদের চায়ের জন্য অন্য দেশের দিকে মনযোগ দিতে হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন বৈশ্বিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত। তারা তখন রবার্ট ফরচুন নামে একজন স্কটিশ উদ্ভিদ বিজ্ঞানীকে নিয়োগ করলো। এই ব্যক্তি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিদেশি বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করতেন এবং সেগুলো অভিজাতদের কাছে বিক্রির জন্য বহুল পরিচিত ছিলেন। তাঁকে গোপনে চীনে গিয়ে সেখান থেকে ভারতে চা গাছ পাচারের জন্য দায়িত্ব দেয়া হল। উদ্দেশ্য, নিজ দেশে বিকল্প একটি চা শিল্প গড়ে তোলা। আশ্চর্যজনকভাবে তিনি ২০,০০০ চা গাছ ও চারাগাছ চীন থেকে দার্জিলিংয়ে রপ্তানি করেন। তর্ক-সাপেক্ষে অনেকেই মনে করেন, রবার্ট ফরচুনের এই গোপন কর্মকাণ্ডের ফলাফলের প্রত্যক্ষ ফলস্বরুপ ভারত আজ চায়ের আবাসস্থলে হিসেবে পরিণত হয়েছে।
রাশান ক্যারাভান চা
ক্যারাভান রুটে চীন থেকে রাশিয়ার পথে রুশদের কাছে বেশিরভাগ চা পৌঁছাত। উটের কাফেলা মাসের পর মাস ধরে ভ্রমণ করে মহাদেশ জুড়ে চা বহন করে চলত। তাদের রাতের ক্যাম্পফায়ার এর ধোঁয়া চায়ের ওপর পরত এবং যতক্ষণে তারা মস্কো কিংবা সেন্ট পিটার্সবার্গ পৌঁছাত, পাতাগুলোতে ধোঁয়াটে স্বাদ তৈরি হত আর সেখান থেকে তৈরি হওয়া সেই চায়ের স্বাদ; যা আজকের দিনে রাশান ক্যারাভান চা হিসেবে পরিচিত !
দুধ চা
ভারতে প্রচুর পরিমাণে জন্মানো চায়ের উদ্ভিদটি ছিল ক্যামেলিয়া সিনেনসিস অসমিকা নামে একটি উপ-প্রজাতির উদ্ভিদ। গ্রিন টি’র চেয়ে ‘আসাম টি’ বেশি স্বাদযুক্ত কালো রংয়ের ছিলো। সাধারণভাবে প্রাথমিক ইংলিশ ব্রেকফাস্টের অন্তর্ভুক্ত আসাম চায়ের রং কড়া থাকায় লোকজন তা দুধ সহকারে পান করতে প্ররোচিত হয়েছিলো। বর্তমানে ব্রিটেনে সাধারণ ইংলিশ ব্রেকফাস্টের সাথে দেয়া চা দুধ সহকারে পান করা হয়। কিন্তু ইউরোপ মহাদেশের অন্যান্য স্থানে চায়ের সাথে দুধ খুব কমই পরিবেশন করা হয়। এর কারণ মূলত, ইন্দোনেশিয়ার জাভা থেকে নেদারল্যান্ডসে চা যেত, যা ছিলো খুব হালকা এবং এই চায়ের সাথে দুধ যোগ করার কোনো প্রয়োজন হত না। আর সে বিষয়টি ফ্রান্স, স্পেন এবং জার্মানিতে এই চা জনপ্রিয় করে তুলেছিলো।
টোস্টের সাথে চা
১৬৫৭ সালে লন্ডনে প্রথমবারের মত টমাস গ্যারাওয়ে নামে এক লোক খুচরা ভাবে চা বিক্রি করা শুরু করেন। তখন এটা কিছুটা দ্বিধা তৈরি করেছিলো যে সবচেয়ে ভালো উপায়ে তা গ্রহণ করার পদ্ধতি কী? যেহেতু এটা ছিলো তখন বিলাসিতার পণ্য, তাই সবার পক্ষে এর ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব ছিলো না। কিন্তু প্রচণ্ডভাবে তখন চা সকলের কাম্য হয়ে ওঠে। তখন দেখা গেলো যে, লোকজন পাতা ভিজিয়ে রাখার চেষ্টা করছে এবং সেগুলো খাচ্ছে, এমনকি সেগুলোর স্বাদ বাড়াতে টোস্টের ওপর দিয়ে মাখন মাখিয়ে দিয়ে খেতেও দেখা গেছে।
বিপ্লব উশকে দেয়া
১৭৭৩ সালে আমেরিকার বোস্টন শহরের বাসিন্দারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিলো। সেখান থেকেই ‘বোস্টন টি পার্টি’র উত্থান, যারা কিনা ব্রিটিশ সরকারের আরোপ করা চা করের (The Tea Act 1773) প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছিল। সেদিন রাতের অন্ধকারে বোস্টন বন্দরে ৩টি ব্রিটিশ জাহাজে অভিযান চালিয়ে দেশপ্রেমিক আন্দোলনকারীরা ৩৪২ কন্টেইনার চা পানিতে ফেলে দিয়েছিলেন। অদ্ভুতভাবে এই বিক্ষোভ আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের আন্দোলনকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো !
কফিকে ছাড়িয়ে চায়ের জয়জয়কার
ঐতিহ্যগতভাবে তুরস্ক বিশ্বের বৃহৎ চা বাজারগুলোর মধ্যে অন্যতম। কৃষ্ণ সাগরের উপকূলের রিয অঞ্চলের উর্বর ভূমি থেকে অধিকাংশ টার্কিশ ব্ল্যাক টি আসে। তুর্কী কফিও বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত, তবে তুরস্কে সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয় হল চা।
আপনি যে চা খাচ্ছেন তার সম্পর্কে জানেন?
আপনি যখন ভিন্ন ভিন্ন ধরনের চায়ের স্বাদ উপভোগ করতে চাইবেন, তখন আপনাকে এর ঘ্রাণ, ফ্লেভার এবং চেহারার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। দৃশ্যত, জোরে জোরে শব্দ করে চা পান করার মাধ্যমে এর স্বাদ ও গন্ধ দ্রুত পেতে পারেন। যদিও এভাবে চা পান করাটাকে অনেকে ছোট করেই দেখেন। কিন্তু এটিই চায়ের স্বাদ নেয়ার প্রকৃত উপায় !