১৯৯৩ সাল, বিশ্বজুরে মুক্তি পেলো স্টিভেন স্পিলবার্গের হলিউডের বিখ্যাত ছবি জুরাসিক পার্ক। ভারতের রাজস্থানের ছেলে ইরফানের সে সামর্থ্য নেই যে আয়েশ করে হলে গিয়ে ছবি দেখবে। আর্থিক দোটানায় থাকা ছেলেটাই ঠিক ২২ বছর পর ২০১৫ তে হলিউডের জুরাসিক ওয়ার্ল্ডের মালিক হিসেবেই সকলের সামনে পর্দায় আসেন।
এবার সিনেমার ভাষায় বলা যাক। মনে আছে ‘দ্য লাঞ্চবক্স’ এর সেই মধ্যবয়স্ক নিঃসঙ্গ পুরুষটার কথা? মাত্র ৪৫ বছর বয়সে একজন বৃদ্ধ চরিত্রে সাবলীল একজন মানুষ, লোকাল ট্রেনের ঝাঁকি খেয়ে নয়টা-পাঁচটার জীবন কাটাচ্ছে, কোথা থেকে ভুলে এক বাসায় বানানো লাঞ্চবক্স চলে আসে ! ছোট্ট সাধারণ একটা গল্পের অসাধারণত্ব আসে যে মানুষটার কারণে, তার কথাই বলছিলাম। তিনি ভারতের প্রতিভাবান অভিনেতা ইরফান খান। অভিনয়কে শিল্পের উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া ভারতের অন্যতম শক্তিমান অভিনেতা ছিলেন ইরফান খান।
পুরো নাম সাহেবজাদা ইরফান আলী খান, ভারতের রাজস্থানের জয়পুরের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তার পিতার পেশা ছিল পাগড়ি ব্যবসা। শুরুর জীবনে বেশ কয়েকবার আর্থিক টানাপোরান চলে পরিবারের মধ্যে। বন্ধু সতীশ শর্মার সাথে ক্রিকেট খেলতে পছন্দ করতেন। একসময় প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের ভিত্তি হিসেবে সুপরিচিত সিকে নায়ুডু টুর্নামেন্টে অনুর্ধ্ব ২৩ দলের জন্য নির্বাচিত হন। কিন্তু প্রয়োজনীয় টাকার অভাবে তিনি এই আসরে খেলতে পারেননি। ক্রিড়া ক্ষেত্রের ইতি ঘটিয়ে মন দেন লেখা পড়ায়। স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে পড়াকালীন ১৯৮৪ সালে নতুন দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামাতে (এনএসডি) অধ্যয়নের জন্য বৃত্তি পান। সেখান থেকে তিনি নাট্যতত্ত্বে ডিপ্লোমা করেন। সে সময় থেকেই অভিনয়ে জড়িয়ে পরেন ইরফান।
টেলিভিশনের ছোট চরিত্রের অভিনয় দিয়ে শুরু। টিভি সিরিয়ালের অভিনেতা, খল নায়ক, খুনী প্রায় সব চরিত্রেই একবার ঢু মারা হয়েছে তার। টেলিভিশন ছেড়ে ভারতীয় মুভি ইন্ডাস্ট্রিতে দ্যুতি ছড়াতে শুরু করলেন যখন। তখন থেকেই সকলের কাছে পরিচিতি লাভ করতে থাকেন। বড় বড় এক্টররাও নির্দিধায় তার অভিনয় দক্ষতা স্বীকার করে নেন। হিট অভিনেতারা যেখানে একটি দৃশ্যে কয়েকবার শট নিতেন সেখানে ইরফানের জন্য একটি শটই যথেষ্ট ছিল। কঠিন কঠিন ডায়লগ বা দৃশ্যে সাবলীল অভিনয় করে ফেলার গুন ছিল তার। চলচ্চিত্র জগতে ৩০ বছরের তাঁর দ্যুতিমান যাত্রায় ইরফান খান প্রায় ৫০টির কাছাকাছি দেশী ও বহু বিদেশী চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয়ের মাধ্যমে বারবার দর্শকদের বিমুগ্ধ করেন।
বলিউড, ব্রিটিশ ভারতীয়, হলিউড এবং একটি তেলুগু চলচ্চিত্রে তিনি কাজ করছেন। তার বিদেশি ছবিগুলো হচ্ছে দ্য ওয়ারিয়র (২০০১), দ্য নেমসেক (২০০৬), দ্য দার্জিলিং লিমিটেড, একাডেমি পুরস্কার বিজয়ী চলচ্চিত্র স্লামডগ মিলিয়নিরার (২০০৮), নিউ ইয়র্ক, আই লাভ ইউ (২০০৯), দি অ্যামেজিং স্পাইডার-ম্যান (২০১২), লাইফ অব পাই (২০১২), জুরাসিক ওয়ার্ল্ড (২০১৫), ও ইনফার্নো (২০১৬)। এছাড়াও ভারতে তার অভিনীত লাইফ ইন আ… মেট্রো (২০০৭), দ্য লাঞ্চবক্স (২০১৩), হায়দার (২০১৪), পিকু (২০১৫), তালবার (২০১৫), ও ব্ল্যাকমেইল (২০১৮), হিন্দি মিডিয়াম (২০১৭) প্রভৃতি চলচ্চিত্র দিয়ে মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। বাংলাদেশে মোস্তফা সারওয়ার ফারুকির আলোচিত ডুব চলচ্চিত্রেও তিনি ছিলেন মূখ্যভুমিকায়।
তার অর্জিত পুরস্কার এর সংখাও নেহায়েত কম না। শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও চারটি ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার-সহ অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেছেন। চলচ্চিত্র সমালোচক, সমসাময়িক অভিনয়শিল্পী ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা তাকে ভারতীয় চলচ্চিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনয়শিল্পী বলে গণ্য করে থাকেন। ২০১১ সালে ভারত সরকার তাকে ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মশ্রীতে ভূষিত করে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত তার অভিনীত বিদেশী চলচ্চিত্রসমূহ বিশ্বব্যাপী বক্স অফিসে $৩.৬৪ বিলিয়ন আয় করে।
২০১৮ সালে তিনি নিউরো এন্ডোক্রিন টিউমারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নেন। সুস্থ্য হয়ে ফিরে এসে তিনি আংরেজি মিডিয়াম চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। কিন্তু পুনরায় মলাশয়ের ক্যান্সারের জটিলতায় ভারতের মুম্বাইয়ের কোকিলাবেন ধীরুভাই আম্বানি হাসপাতালের আইসিইউতে থাকা অবস্থায় বুধবার , ২০২০ সালের ২৯শে এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন এই গুনী শিল্পী। তার বয়স হয়েছিল ৫৩ বছর।
ভক্তদের উদ্দেশে কিছুদিন আগে টুইটারে ইরফান লেখেন, “জীবনে জয়ী হওয়ার সাধনায় মাঝে মধ্যে ভালবাসার গুরুত্ব ভুলে যাই আমরা। তবে দুর্বল সময় আমাদের তা মনে করিয়ে দেয়। জীবনের পরবর্তী ধাপে পা রাখার আগে তাই খানিক ক্ষণ থমকে দাঁড়াতে চাই আমি। অফুরন্ত ভালবাসা দেওয়ার জন্য এবং পাশে থাকার জন্য আপনাদের সকলকে কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই। আপনাদের এই ভালবাসাই আমার যন্ত্রণায় প্রলেপ দিয়েছে। তাই ফের আপনাদের কাছেই ফিরছি। অন্তর থেকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি সকলকে।”