আজ পহেলা মে ২০২০ তারিখ পর্যন্ত করোনাভাইরাস সংক্রমণে বিশ্বব্যাপী মৃতের সংখ্যা ২ লাখ ৩১ হাজার। সারাবিশ্বে আক্রান্ত হয়েছেন ৩২ লাখ ৫০ হাজার মানুষ। প্রলয়ঙ্করী এই ভাইরাসের তীব্র আঘাতে বৈশ্বিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সহ বিশ্বের রাঘব বোয়াল সব রাষ্ট্র। এরকম মহামারি আমাদের এ প্রজন্মের কাছে নতুন হলেও ইতিপূর্বে প্লেগ, ফ্লু, স্প্যানিশ ভাইরাস সহ আরো অসংখ্য মহামারির কবলে প্রতি শতকেই অজস্র লাশের মিছিল দেখেছে মানবসভ্যতা। উৎকর্ষের শিখরে সুতীব্র উড্ডীয়মান হলেও সেই মানবজাতিই বারবার বলি হয়েছে প্রকৃতির নির্মম খেলায়। তাই সেই ভাইরাস নিয়ে করা হয়েছে বিস্তর গবেষণা, জৈবিক অস্ত্রের ধারণা মেলেছে ডালপালা। আর তার সাথে সাথে সিনেমাপ্রেমীরাও পেয়েছেন খণ্ড স্বাদ। চলুন সেই সুত্র ধরে জেনে নেয়া যাক ভাইরাস কেন্দ্রিক ৫টি সিনেমার কথা…
Blindness (২০০৮)
ধরুন, একদিন ঘুম ভাঙতেই আবিষ্কার করলেন শ্বেত সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছেন আপনি। মানে যেদিকেই চোখ যায়, শুধু সাদা আর সাদা ! আর কোন বর্ণ, আকার ধারণ করতে পারছেনা আপনার চোখ। সহজ ভাষায় রাতারাতি অন্ধ হয়ে গেছেন আপনি। অথচ কোন রোগব্যাধি বা দুর্ঘটনার ইতিহাস নেই ! দ্রুত চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে ছুটে গেলেন আপনি। ডাক্তার কিছু ওষুধ লিখে ঘরে ফেরত পাঠাবার পরদিনই শুনলেন শহরের প্রতিটা লোকই ধীরে ধীরে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে। থেমে যাচ্ছে জনজীবন। বিপদের কালো থাবা গ্রাস করছে পৃথিবীর সব দেশকেই। কী হবে তখন? রাষ্ট্রের হর্তাকর্তারা কী দায়িত্ব নিবেন? নাকি উগ্রতার বলি হবে অসহায়রা?
ব্লাইন্ডনেস সিনেমায় দেখানো হয়েছে এমনই অজানা এক ভাইরাস সংক্রমণের ঘটনা। এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে মাঝরাস্তায় অন্ধ হয়ে পড়েন এক জাপানিজ পুরুষ। সাহায্যের আশায় এক চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে গেলে সেখান থেকে ভাইরাস গোটা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি ব্যবস্থায় অন্ধদের জন্য আলাদা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হলেও ক্রমে স্থান জোগান ব্যবস্থা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। আর তখন সেই পুনর্বাসন কেন্দ্রে উত্থান ঘটে উগ্রতাবাদী কিছু লোকের। তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে সেখানকার বাকি সদস্যরা। খাদ্যবণ্টনকে কেন্দ্র করে নারী সদস্যদের যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে তারা। কিন্তু বিদ্রোহই বদলে দেয় এর পরবর্তী ইতিহাস।
সিনেমায় রুপ নেয়ার এই মানবিক বিপর্যয়ের উপন্যাস লিখেছিলেন পর্তুগিজ লেখক হোসে সারামাগো। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত ‘Blindness’ নামক উপন্যাসটিই সেলুলয়েডে প্রাণ পেয়েছে ফারনান্দো মেরেলেসের হাত ধরে। ডন ম্যাককেলার হুবহু উপন্যাস না তুলে নিজের মত করে লিখেছেন চিত্রনাট্য। মূল লেখক প্রথমে এর কপিরাইট বিক্রিতে অস্বীকৃতি জানালেও পরে মত বদলান। তাঁর মতামতের ভিত্তিতেই চলচ্চিত্রে কোন চরিত্রের নাম ব্যবহার করা হয়নি।
Contagion (২০১১)
অফিসের কাজের খাতিরেই হংকং গিয়েছিলেন AIMM কর্মকর্তা বেথ এমহফ। ক্যাসিনোর উত্তাল জুয়া, রসনা বিলাস সবশেষে শিকাগো হয়ে ঘরেও ফিরেছিলেন তিনি। কিন্তু একদিনের মাথায় হঠাৎই ঠাণ্ডা জ্বর আর কাশিতে মৃত্যু হয় বেথের। শুধু তাই নয়, তার শিশু সন্তানও একই কারণে মারা যায়। দুই মৃত্যুরই প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন মিচ এমহফ। দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হতেই তিনি টের পান প্রাণঘাতী এক ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে গোটা আমেরিকায়। সংক্রামক রোগের বৃদ্ধির হার অস্বাভাবিক রকম দ্রুত এবং সম্পূর্ণ নতুন ধরণের ভাইরাসের হাতে বাস্তবিক অর্থেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জিম্মি।
এদিকে আটলান্টায় এলিস চিভারের নেতৃত্বে একরাশ নিবেদিত প্রাণ ডাক্তার ও বিশেষজ্ঞ মাঠে নামে এই ক্ষতিকর ভাইরাসের বিরুদ্ধে। ডাক্তার এরিন মেয়ারস যেমন একদিকে মাঠ পর্যায়ে গবেষণায় ব্যস্ত, তেমনি এলি হাক্সটেলও নিত্যনতুন ভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরিতে ব্যস্ত। অথচ সারাবিশ্বে ইতিমধ্যেই জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organization)। মাত্র এক মাসের মধ্যেই আমেরিকায় আড়াই মিলিয়ন ও সারাবিশ্বে ২৬ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়ে পরেন। দুঃসময়েও ফায়দা তোলার জন্য ব্লগার এলান ক্রামওয়াইড নামে এক ব্যক্তি শুরু করেন ‘ফরসিথ’ নামক এক ওষুধের প্রচারণা। কিন্তু শেষ রক্ষা হবে কী মানব জাতির? নাকি বাঁদুড় আর শূকরের মাধ্যমে সংক্রমিত এই রোগেই শেষ হবে গোটা সভ্যতার জীবনধারার?
স্টিভেন সোডারবার্গের পরিচালনায় নির্মিত ২০১১ সালের ছবিটি সেসময় ফ্লপ হলেও সম্প্রতি করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে আবারও পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছে হাল আমলে। চিত্রনাট্যকার স্কট জে বার্নস এই কাহিনি লিখবার আগে টানা ছয় মাস বিশদ গবেষণা করেছেন মহামারি ও ভাইরাস নিয়ে। শুধুমাত্র ভাইরাস সংক্রমণই নয়, ‘ম্যাস হিস্টিরিয়া’ এবং বিপর্যয়ে মানুষের মনস্তত্ত্বের প্রতিও গভীর পর্যালোচনা করেছেন তিনি। এরই ফসল ১০৬ মিনিটের এই ব্যবসাসফল ছবি। ছবির মূল ভূমিকায় অভিনয় করেছেন কেট উইন্সলেট, ম্যাট ডেমন, জুড ল, ম্যারিওন কটিলার্ড, গিনেথ প্যালট্রো, লরেন্স ফিশবার্ন প্রমুখ। মাত্র ৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজেটের ছবিটি আয় করে ১৩৫.৫ মিলিয়ন ডলার।
Outbreak (১৯৯৫)
১৯৬৭ সাল। আফ্রিকার জায়ারে বিদ্রোহীদের সাথে লড়াই চলাকালে আমেরিকান সৈন্যরা মুখোমুখি হয় বিদঘুটে এক অসুখের। জ্বর আর কাশির সাথে দ্রুতই কাবু হতে থাকেন তারা। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই চেহারার বিকৃতি ঘটে যায়। নতুন এই রোগের সাথে পরিচয় ছিলো না তৎকালীন সেনাদের। এমনকি রাষ্ট্রও মুখ ফিরিয়ে নেয় তাদের থেকে। ফলশ্রুতিতে বোমার আঘাতে গুঁড়িয়ে দেয়া হয় সেনা ক্যাম্প !
কাহিনী এখানেই শেষ হতে পারত। আফ্রিকান মোটোবা ভাইরাস নিয়ে আপাত দৃষ্টিতে শঙ্কামুক্ত ছিল মার্কিন সেনাবাহিনী ও স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো। কিন্তু আশির দশকে আবার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় জায়ারে। গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস হয়ে থাকে মহামারীর কবলে। ভাইরোলজিস্ট কর্নেল স্যাম ড্যানিয়েলস সেসব গ্রামগুলোয় কর্নেল কেসি স্কুলার ও মেজর সল্টকে নিয়ে পর্যবেক্ষণ শেষে উপলব্ধি করেন, খুব শীঘ্রই এ ভাইরাসের প্রতিষেধক না মিললে এই মহামারী বিধ্বংসী রূপ নিবে পুরো পৃথিবীতে।
অন্যদিকে এই জায়ারে থেকেই কালোবাজারী জিম্বোর হাত ধরে মোটোবা ভাইরাসের হোস্ট বানর প্রবেশ করে যুক্তরাষ্ট্রে। প্রথমে পানিবাহিত হলেও ভাইরাসের RNA পরিবর্তিত হয়ে বায়ু সংক্রামকে পরিণত হয় এটি। মার্কিন সেনাবাহিনীর অবহেলায় ক্রমে বাড়তে থাকে এর ক্ষতির মাত্রা। সিডার ক্রিক শহরের ২৬০০ লোককে আক্রান্ত করে সপ্তাহের মধ্যেই। মানবিক বিপর্যয়ের সীমা অতিক্রম করার আগেই স্যাম আর সল্ট চেষ্টা করেন প্রতিষেধক আবিষ্কারের। কিন্তু সেনাবাহিনীর স্বেচ্ছাচারিতা ও একগুঁয়েমির বলি কে হবে? সিডার ক্রিকের হাজার মানুষ নাকি গোটা দুনিয়া? কেসি, রবির আত্মত্যাগ কি বদলাতে পারবে ইতিহাস?
রিচার্ড পিটারসনের The Hot Zone: A Terrifying True Story (1992) বইটি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৯৫ সালে নির্মিত হয় আউটব্রেক সিনেমাটি। ওই বইটিতে সুদান ভাইরাস, ইবোলা ভাইরাস, র্যাভন ভাইরাস ও মারবার্গ ভাইরাসের ইতিহাস, প্রেক্ষাপট এবং ক্ষতিকর দিক নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছিলেন লেখক। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতে মানব সভ্যতার জন্য প্রাণঘাতী ভাইরাসের প্রত্যাবর্তনের আশংকাও প্রকাশ করেছিলেন তিনি। এ সিনেমাটি ব্যবসায়িকভাবে সাফল্য পেলেও সমালোচকদের কাছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পায়। ওলফগ্যাং পিটারসনের পরিচালনায় ছবিটি আয় করে ১৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
The Flu (২০১৩)
কালোবাজারি হিসেবেই দুই ভাই জু-বং কি ও জু-বং উ নানান গলি ঘুঁপচিতে ঘুরে বেড়ায়। সেই সূত্রেই আচমকা তারা আবিষ্কার করে ফেলে অসংখ্য অবৈধ অভিবাসীর মৃতদেহ। পঁচে গলে বিদঘুটে হয়ে যাওয়া সেইসব লাশের সংস্পর্শেই তারা নতুন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। বায়ুবাহিত এই ভাইরাস দুর্বার গতিতে ছড়িয়ে পড়ে বুদাং শহরে। রক্তবমি, জ্বর আর কাশির আঘাতে মাত্র ৩৬ ঘণ্টার মধ্যেই মৃত্যুবরণ করতে থাকেন আক্রান্ত ব্যক্তিরা।
হতবিহ্বল স্বাস্থ্য সংস্থা ও কোরিয়ান সরকারের নানান চেষ্টার পরেও প্রতিষেধক মিলে না। শহরের বাইরে ভাইরাস ছড়াবার আশংকায় সরকার কোরিয়ান সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেয় আক্রান্ত জনগণকে আক্ষরিক অর্থেই বন্দি করে ফেলার। এদিকে শহরের বিশেষজ্ঞরা নিভৃতে আবিষ্কার করে ফেলেন যুগান্তকারী প্রতিষেধক। অথচ সরকার তার পূর্বের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। অবশেষে অধিবাসীদের প্রবল বিক্ষোভ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার চাপে পিছু হটতে বাধ্য হয় নিষ্ঠুর সরকার প্রধান।
কোরিয়ান সিনেমা জগতের অন্যতম আলোচিত এই ‘The Flu’ সিনেমাটি দেখে না থেকে এখনই দেখে নিন ! H5N1 নামক ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংক্রমণের আশংকা থেকেই কিম সাং–সু নির্মাণ করেন এটি। ১২১ মিনিটের ছবিটি সারাবিশ্বে ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে।
Virus (২০১৯)
ভারতের কেরালা রাজ্যে নিপাহ ভাইরাসের আক্রমণের কথা খুব পুরনো নয়। ২০১৮ সালের মে মাসে সংঘটিত সেই সংক্রমণে আড়াই সপ্তাহের মাঝেই ১৭ জন মারা যান। এছাড়াও কেরালার ২০০০ অধিবাসীকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। ভাইরাসের আক্রমণে কার্যত স্থবির হয়ে যায় গোটা রাজ্য।
এই সত্য ঘটনাকে কেন্দ্র করেই চিত্রনাট্যকার লিখে ফেলেন ‘ভাইরাস’ এর কাহিনী। মালায়লাম ভাষায় তৈরি ছবিটি বক্স অফিসে ঝড় তোলার পাশাপাশি নজর কেড়েছে সিনেমা বোদ্ধাদেরও। ক্রান্তিকালে কিভাবে পুরো কেরালা বিপর্যস্ত ছিলো, স্বাস্থ্যকর্মীদের নিবেদিত প্রাণ প্রচেষ্টা, রাজ্যব্যাপী সংকট, মোটকথা কোন কিছুই বাদ পড়েনি সিনেমার পর্দা থেকে। তাই ১৫২ মিনিটের এই সিনেমাকে চলচ্চিত্রের চাইতে ডকু ড্রামার কাতারে ফেলাই বেশি বুদ্ধিমানের কাজ।
শেষকথা
করোনাভাইরাস দুর্যোগ পেরিয়ে সুস্থ পৃথিবীতে এই বিপর্যয়ের দিনগুলো নিয়ে নিশ্চয়ই সেলুলয়েডে যোগ হবার জন্য আরো সেরা কিছু আসতে চাচ্ছে ! আপাতত এই সিনেমাগুলো দেখুন। ঘরে থাকুন, অবসরের এই সময়টা পরিবার পরিজন নিয়ে সিনেমা দেখে সময় কাটান। এখন শুধু একটা সুস্থ পৃথিবী ফিরে পাবার অপেক্ষা…