স্কুলের সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ভুগোল অংশের বদৌলতে বিশ্ব মানচিত্র আমরা সবাই দেখেছি। সে সময়ে এই রেখাচিত্র সম্পর্কে সামান্য কিছু ধারণা হলেও আসলে ম্যাপ বা মানচিত্র তৈরি মানব সভ্যতার কি যে এক পরম অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা নেই বললেই চলে। এটি কিন্তু মোটেই আধুনিক সময়ের আঁকা নয়।
কিভাবে শুরু হয়েছিল এই মানচিত্র তৈরি?
মানচিত্র বলতে আমাদের চোখের সামনে যে জ্যামিতিক রেখা দিয়ে যুক্ত বিভিন্ন স্থল ও জলভাগের চিত্রটি ফুটে ওঠে সেটি আঁকা মোটেও সহজ কাজ নয়। প্রথমেই জানিয়ে রাখা ভালো মানচিত্র যারা অঙ্কন করেন তাদের বলা হয় ইংরেজিতে- কার্টোগ্রাফার। বিশ্বের সবথেকে প্রাচীন মানচিত্র যেটি আজও অক্ষত আছে সেটি পাওয়া যায় ব্যাবিলনে। নাম ছিল -ইমাগো মানডি। এটি তৈরি হয় যীশু খ্রীষ্টের জন্মের ছশো বছর আগে। তবে বৈজ্ঞানিক ভাবে মানচিত্র তৈরি প্রথম আগমন ঘটে গ্রিক দের হাত ধরে। গ্রিকরাই সর্বপ্রথম প্রাকৃতিক মানচিত্র তৈরি করে। রোমানরা মানচিত্রে অবদান রেখেছে। তবে তাদের মানচিত্র মূলত সম্পত্তি,শহর ও রাস্তা নিয়েই তৈরি ছিল। ইউরোপ জুড়ে যখন মানচিত্র তৈরি নিয়ে প্রতিযোগীয়া চলছে , এশিয়ায় তখন একটি দেশ মানচিত্র বানিয়েই কেবল বসে থাকল না, তারা সেই মানচিত্রে শৈল্পিক কারুকাজ যুক্ত করল সাথে মৌখিক বৰ্ণনা।দেশটির নাম- চীন। জাপান আর কোরিয়াও উদ্যোগ নিল ঠিকই কিন্তু খেয়াল করলো চীন অনেক নিখুত একটি মানচিত্র বানিয়েছে , নিজেরা আর এ ব্যাপারে কোন কষ্ট না করে নিজেদের মানচিত্র চীনের গা ঘেষে বসিয়ে দিলো। বিশ্বের প্রাকৃতিক মানচিত্রের জন্য যখন অর্ধেক পৃথিবী কাজ করছে অপরদিকে আরব কিন্তু ইসলাম ধর্মের ভিত্তিতে তাদের যে ঐতিহ্যগত মানচিত্র ছিল সেটিই ব্যাবহার করতে লাগলো।
ছাপাখানার আবির্ভাব ও সেই সাথে টলেমির ‘গাইড টু জিওগ্রাফি’র পুনরাবিষ্কার গোটা পশ্চিম ইউরোপের মানচিত্র আঁকিয়েদের মধ্যে যেন একটা সাড়া ফেলে দিল বিশ্বের সবথেকে বৈজ্ঞানিক মানচিত্র আঁকার জন্য।এই উন্মাদনা আরো বৃদ্ধি পেল যখন স্পেনীয় এবং পর্তুগীজরা আফ্রিকা এবং আমেরিকায় সমুদ্র যাত্রা শুরু করল। মধ্যযুগীয় সেই বিশ্বে আজ যাকে আমরা আমেরিকা নামে চিনি তার নাম তখন কিন্তু আমেরিকা ছিল না। Waldseemuller সর্বপ্রথম তার ম্যাপে আমেরিকা শব্দটি ব্যবহার করেন ১৫০৭ সালে। এর মধ্যে ফরাসীরা একটা যুগান্তকারী কাজ করে দিল কার্টোগ্রাফির জগতে। তারা বিশ্বে প্রথম সরকারীভাবে ১৭৮৭ সালে জমি জরিপ করে ১৮২টি মানচিত্র তৈরি করল। ব্রিটিশরা ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শুরুতে ভারতের এক ব্যাপক ত্রিকোনমিতিক সমীক্ষার মানচিত্র তৈরি করে।
তারা এমন আকার এবং আকৃতি ব্যবহার করতেন যেগুলোকে টান টান করে মাটিতে পাতা যায়, যেমন সমতল কিছু, কিংবা কোন, চোঙ ইত্যাদি। এগুলো মানচিত্র জগতে পরিচিত developable surface নামে। বিভিন্ন গাণিতিক হিসাব করে ওই developable surface গুলোকেই পৃথিবীর ভূমিরূপ বানিয়ে দিতেন। এখন এই যে অবস্থাটা দাঁড়াল একে বলে প্রোজেকশন। মানচিত্র যা দাঁড়াল তা মোটেও ত্রুটিমুক্ত হল না। নানান বিকৃতিতে ভরে থাকল মানচিত্র গুলো। তারা কি করলেন এই বিকৃতিগুলো সংশোধন করার চেষ্টা করতে লাগলেন মানচিত্রের চেহারাটাই বদলে দিয়ে।
সময়ের সাথে সাথে আরো শৃঙ্খলা, আরো সতর্কতা ও আরো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নেওয়া হতে লাগল বিশ্ব মানচিত্র আঁকার ক্ষেত্রে। ১৯৯৮ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি অনুমোদিত The Winkel Tripel Projection মানচিত্রটিই হল বর্তমানে সর্বাধিক প্রচলিত বিশ্ব মানচিত্র।