বর্তমানে পৃথিবীর বিক্ষ্যাত মিউজিক ব্যান্ড আর্টিস্টদের আইকন ব্যান্ড এর নাম জানতে চাওয়া হলে তাদের পছন্দের তালিকায় একটি বিশেষ ব্যান্ড এর নাম থাকেই। মেটালিকা, গানস এনড রোজেস এর মত ব্যান্ড মিউজিককে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সে ব্যান্ডের নাম হচ্ছে আয়রন মেইডেন। এরা হচ্ছে পূর্ব লন্ডনের একটি হেভি মেটাল সঙ্গীত দল। বেজ গিটারবাদক স্টিভ হ্যারিস, ১৯৭৫ সালে এই দল গঠন করেছিলেন। ৮০’র দশকে সংগী্তের মাঠ কাপানো এই ব্যান্ড এর এখন পর্যন্ত শেষ এলবাম রিলিজ দিয়েছে ২০১৫ সালে। আশির দশক থেকে বিংশ শতাব্ধী, বয়সের ভাজ প্রত্যেকের চামড়ায় স্পষ্ট হয়ে গেলেও আগের সবই যেন এখনো উপস্থিত। হেভি মেটাল শ্রোতারা ‘ফিয়ার অব দ্য ডার্ক’, ‘দ্য ট্রুপার’, ‘দ্য নাম্বার অব দ্য বিস্ট’, ‘রান টু দ্য হিলস’-এর মতো গানগুলোতে হেডব্যাং দিয়ে চলেছে। কোথাও যেন কারো কোনো ক্লান্তি নেই। প্রায় ৪ দশকের ক্যারিয়ারে হেভি মেটাল ভক্তদের এক মুহূর্তের জন্য হেডব্যাং দেয়া থেকে বিশ্রাম নিতে দেয়নি হেভি মেটাল ব্যান্ড ‘আয়রন মেইডেন’।
আয়রন মেইডেনের ভাঙ্গা গড়ার গল্প
ব্যান্ডটি গঠিত হয় বেইজিস্ট স্টিভ হ্যারিসের হাত ধরে। ১৯৭৫ সালের শেষ দিকে হ্যারিস স্মাইলার থেকে বের হয়ে যান। সে বছরের ক্রিসমাসেই তার হাত ধরে যাত্রা শুরু করে আয়রন মেইডেন। ব্যান্ডটির নামও রেখেছিলেন তিনিই। এর কিছুদিন আগেই হ্যারিস দ্য ম্যান ইন দ্য আয়রন মাস্ক সিনেমাটি দেখেন। আলেকজান্ডার দ্যুমা-র ফরাসি উপন্যাস দ্য ভিকোমঁ দে বাজেলোন থেকে নির্মিত সিনেমাটিতে উল্লেখ ছিল আয়রন মেইডেন-এর। এই আয়রন মেইডেন মূলত চতুর্দশ শতকের জার্মানিতে ব্যবহৃত এক ধরনের টর্চার ডিভাইস। এই আয়রন মেইডেন থেকেই স্টিভ হ্যারিস ব্যান্ডের নামকরণ করেন।
ব্যান্ডটি প্রথম পারফর্ম করে পরের বছরের ১ মে। এর পর দ্রুতই আরো কয়েকটা। আর ব্যান্ডটির সেই প্রথম লাইনআপে ভাঙনও ধরে দ্রুতই। প্রথম বাদ পড়েন ভোকালিস্ট পল ডে। কারণ, স্টেজে তার পারফরম্যান্স ‘প্রাণবন্ত’ নয়। তার বদলে যোগ দেন ডেনিস উইলকক। উইলকক আবার ছিলেন কিস-এর বেজায় ভক্ত। কিস-এর মতোই জবরজং পোশাক পরে মঞ্চে উঠতেন। এমনকি ব্লাড স্পিটিংও করতেন। পরে উইলককের হাত ধরে ব্যান্ডে যোগ দেন তার বন্ধু ডেভ মারে। মারের পারফরম্যান্স ব্যান্ডের অন্য দুই গিটারিস্ট ডেভ সুলিভান ও টেরি র্যান্সকে রীতিমতো আতঙ্কিত করে তোলে। সে জটিলতার জেরে সে বছরেরই শেষ দিকে বিরক্ত হয়ে ব্যান্ড ভেঙেই দেন হ্যারিস।
অবশ্য দ্রুতই আবার যাত্রা শুরু করে আয়রন মেইডেন। এবার একজন মাত্র গিটারিস্ট নিয়ে—ডেভ মারে। পরের বছর দ্বিতীয় গিটারিস্ট যোগ দেন দলে—বব সয়্যার। তবে সেও বেশিদিন টেকেনি। তার অপরাধ, ‘স্টেজে দাঁত দিয়ে গিটার বাজানোর চেষ্টা করে ব্যান্ডের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা।’
এর মধ্যেই আবার দুই বন্ধু উইলকক আর মারের মধ্যে খিটিমিটি লেগে যায়। তার জেরে উইলকক হ্যারিসকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে মারেকে মেইডেন থেকে বের করে দেন। সঙ্গে কাটা পড়েন ব্যান্ডের প্রথম লাইনআপের ড্রামার রন ম্যাথুস। মেইডেনও এক নতুন লাইনআপ নিয়ে হাজির হয়—হ্যারিস-উইলককের সঙ্গে যোগ দেয় গিটারে টেরি ওয়াপরাম, কিবোর্ডে টনি মুর এবং ড্রামসে বেরি পার্কিস।
বাজে পারফরম্যান্সের জন্য কনসার্টের পরপরেই বাদ পড়েন পার্কিস। নতুন ড্রামার হিসেবে যোগ দেন ডগ স্যাম্পসন। ব্যান্ডের ঘরানার সঙ্গে কিবোর্ড যাচ্ছে না বলে বাদ পড়েন টনি মুরও। মাস কয়েক পরে চলে যান উইলককও। উইলককের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গেই ডেভ মারে আবার মেইডেনে ফিরে আসেন। মারের হাতে সলো ছাড়তে রাজি না হওয়ায় বাদ পড়েন ওয়াপরামও।
ঝামেলা শেষে আয়রন মেইডেনের নতুন একটা লাইনআপ মোটামুটি দাঁড়িয়ে যায়। হ্যারিস-মারে-স্যাম্পসন জমিয়ে প্র্যাকটিসও চালাতে লাগলেন। কেবল একটাই সমস্যা, ভোকালে কেউ নেই। অবশেষে সেই লোকও পাওয়া গেল। ১৯৭৮-এর নভেম্বরে লেটোনস্টোনের রেড লায়ন পাবে তাদের সঙ্গে পরিচয় হলো পল ডি’অ্যানোর সঙ্গে। ভোকালিস্ট হিসেবে পলকে তাদের ভীষণ পছন্দও হয়ে গেল। আয়রন মেইডেনে যোগ দিতেও রাজি হলেন পল।
এই লাইনআপেই প্রথম রেকর্ডিং করল মেইডেন। চারটি গানের ডেমো রেকর্ড করে তারা তুলে দেন নিয়াল কে-র হাতে। নিয়াল ছিলেন ব্যান্ডওয়াগন হেভি মেটাল সাউন্ডহাউস ক্লাবের ম্যানেজার। এই হেভি মেটাল ক্লাবে বাজানো গানের রেকর্ড থেকে একটা টপচার্টও বানানো হতো। সেটা আবার ছাপা হতো সাউন্ডস নামের একটা সাপ্তাহিক পত্রিকায়। নিয়ালের গানগুলো পছন্দ হয়। সাউন্ডহাউসে গানগুলো বাজানো হয়। একটা গান আবার টপচার্টের শীর্ষেও উঠে আসে। সেই সূত্রেই রড স্মলউড মেইডেনের প্রথম ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরেই মেইডেন ব্রিটেনের অন্যতম সংগীত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ইএমআই-এর সঙ্গে চুক্তি সেরে ফেলে। এই সময়েই তারা ব্যান্ডে আরেকজন গিটারিস্ট নেওয়ার সিদ্ধান্তও নেয়। প্রথমে সে জন্য পছন্দ করা হয় মারের ছোটবেলার বন্ধু আড্রিয়ান স্মিথকে। কিন্তু স্মিথ তার পুরোনো ব্যান্ড আর্চিন ছাড়তে রাজি না হলে দ্বিতীয় গিটারিস্ট হিসেবে মেইডেনে যোগ দেন ডেনিস স্ট্র্যাটন। কাছাকাছি সময়ে শারীরিক অসুস্থতার কারণে ব্যান্ড ছাড়েন ডগ স্যাম্পসন। তার বদলে যোগ দেন স্যামসন-এর সাবেক ড্রামার ক্লাইভ বার।
পল-হ্যারিস-মারে-স্ট্র্যাটন-বার, এই লাইনআপ নিয়েই আয়রন মেইডেন প্রথম কোনো পূর্ণাঙ্গ অ্যালবামে কাজ করে। ১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটিশ নিউ ওয়েভ ব্যান্ডগুলোর গান নিয়ে একটা মিক্সড অ্যালবাম বের হয়—মেটাল ফর মাদেস। তাতে জায়গা করে নেয় মেইডেনের স্যাংকচুয়ারি আর র্যাথচাইল্ড।
সে বছরই বের হয় ব্যান্ডটির প্রথম অ্যালবাম—আয়রন মেইডেন। প্রথম অ্যালবামই উঠে আসে ইউকে টপচার্টের ৪ নম্বরে। সে বছরের শেষে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ট্যুরও করে দলটি। তার মধ্যে কিস ও জুডাস প্রিস্টের দুটো ওয়ার্ল্ড ট্যুরের ইউরোপ লেগও ছিল। এ দুই ট্যুরের মাঝেই অবশ্য ব্যান্ডটিতে আরেক দফা রদবদল হয়। মতের মিল না হওয়ায় বাদ পড়েন স্ট্র্যাটন। তাঁর বদলে অক্টোবরে যোগ দেন আড্রিয়ান স্মিথ।
১৯৮১ সালে বের হয় মেইডেনের দ্বিতীয় অ্যালবাম কিলার্স। এই অ্যালবাম মুক্তির পরই ব্যান্ডটি তাদের প্রথম ওয়ার্ল্ড ট্যুরে বের হয়। আর সেই ট্যুরেই লাইনআপে আরেক দফা পরিবর্তন ঘটে। তত দিনে পল একটু বেশিই কোকেনে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। পরে ব্যাপারটা পল নিজেও স্বীকার করেন, ‘আমি আসলে তখন কোকেন সেবনের মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিলাম। অনবরত কোকেন নিতাম, দিনে ২৪ ঘণ্টাই। প্রতিদিন। ব্যান্ডের তখন বছরব্যাপী পরিকল্পনা, সব জায়গায় কথা পাকাপাকি হয়ে আছে। ওদিকে আমি নেশার ঘোর থেকে বেরই হতে পারছিলাম না। বুঝতে পারছিলাম, আমার পক্ষে ট্যুরটা শেষ করা সম্ভব হবে না।’
তাকে অবশ্য ট্যুর শেষ করেই ছাঁটাই করা হয়। বিলম্বের কারণ, তাঁর বদলি খুঁজে পাওয়া সহজ ছিল না। রিডিং ফেস্টিভ্যালে ব্যান্ডটির ম্যানেজার রড স্মলউডের সঙ্গে কথা হয় স্যামসন-এর ভোকালিস্টের। ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বরে সে মেইডেনের জন্য অডিশন দেয়। অডিশন শেষেই তাঁকে সবুজসংকেত দেখানো হয় মেইডেনের পক্ষ থেকে। আয়রন মেইডেনের নতুন ভোকালিস্ট হিসেবে যোগ দেন ব্রুস ডিকিনসন।
১৯৮২ সালে মুক্তি পায় মেইডেনের তৃতীয় একক অ্যালবাম দ্য নাম্বার অব দ্য বিস্ট। তাদের এই অ্যালবামটাই প্রথমবারের মতো তাদের টপচার্টের শীর্ষে তুলে আনে। শুধু তা-ই নয়, অ্যালবামটি মেইডেনের ভবিষ্যৎকেও পোক্ত করে তোলে। অ্যালবাম-পরবর্তী ওয়ার্ল্ড ট্যুরে মেইডেন ইউরোপ-আমেরিকার বাইরেও কনসার্ট করে দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, এমনকি জাপানেও। পারফর্ম করে রিডিং ফেস্টিভ্যালের হেডলাইন ব্যান্ড হিসেবেও। অবশ্য ট্যুরের আমেরিকা লেগে তাদের এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়। তাদের অ্যালবামের নাম দেখে মার্কিন রক্ষণশীল রাজনৈতিক দলগুলোর একটা অংশ দাবি করে বসে, আয়রন মেইডেন শয়তানের উপাসক। তখন প্রতিক্রিয়ায় তেমন কিছু না বললেন, সম্প্রতি ডিকিনসন এক সাক্ষাৎকারে জানান, তারা নাকি ব্যাপারটাতে বেশ মজাই পেয়েছিলেন। কারণ, এহেন দাবি তাদের মুফতে কিছু প্রচারণা এনে দিয়েছিল।
এভাবে করেই আয়রন মেইডেনের ভাঙ্গা গড়া চলতে থাকে।
আয়রন মেইডেনের স্টুডিও অ্যালবাম সমূহ
আয়রন মেইডেন (১৯৮০)
কিলার্স (১৯৮১)
দ্য নাম্বার অব দ্য বিস্ট (১৯৮২)
পিস অব মাইন্ড (১৯৮৩)
পাওয়ার স্লেভ (১৯৮৪)
সামহয়ার ইন টাইম (১৯৮৬)
সেভেন্থ সান অফ আ সেভেন্থ সান (১৯৮৮)
নো প্রেয়ার ফর দ্য ডাইং (১৯৯০)
ফিয়ার অফ দ্য ডার্ক (১৯৯২)
দ্য এক্স- ফ্যাক্টর (১৯৯৫)
ভারচুয়াল XI (১৯৯৮)
ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড (২০০০)
ড্যান্স অব ডেথ (২০০৩)
এ ম্যাটার অব লাইফ এন্ড ডেথ (২০০৬)
দ্য ফাইনাল ফ্রন্টিয়ার (২০১০)
অর্জনের ঝুলি
২০১৫ সাল পর্যন্ত পৃথিবীব্যাপী আয়রন মেইডেন এর প্রায় নয় কোটি অ্যালবাম বিক্রি হয়েছে। ৩৫ বছরের ইতিহাসে তারা লাইভ পারফরম্যান্স করেছে দুই হাজারের বেশি। ২০০২ সালে তারা জিতে নেয় ব্রিটেনের অভিজাত মিউজিক অ্যাওয়ার্ড দ্য আইভর্স। এ ছাড়া তাদের অর্জনের ঝুলিতে আছে ব্রিট অ্যাওয়ার্ডস, ক্ল্যাসিক রক রোল অব অনার অ্যাওয়ার্ড, ব্যান্ডিট রক অ্যাওয়ার্ডস, মেটাল হ্যামার গোল্ডেন গডস অ্যাওয়ার্ড, মেটাল স্টর্ম অ্যাওয়ার্ড, গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডস, দ্য রক বিয়ার অ্যাওয়ার্ড, জুনো অ্যাওয়ার্ড প্রভৃতি।