করোনাভাইরাসের উৎপত্তি, বিস্তার, সংক্রমন এবং সুরক্ষার উপায় নিয়ে নানান পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে। যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটার সাথে অন্যটার মিল পাওয়া যাচ্ছেনা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাঠকরাও বিভ্রান্তিতে পরছেন। তাই সঠিক তথ্যগুলো একসাথে সাজিয়ে পাঠকদের কাছে তুলে ধরার জন্যই আজকের এই প্রতিবেদন – করোনাভাইরাস : এ টু জেড !
সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯ নামের রোগটিকে বিশ্ব মহামারী হিসেবে ঘোষণা করেছে। কোভিড-১৯ হচ্ছে ‘করোনাভাইরাস ডিজিজ’ এর সংক্ষিপ্ত রূপ যা করোনা নামক একটা ভাইরাসের মাধ্যমে মানবদেহে সংক্রমিত হয়। সর্বপ্রথম চীনে আক্রমন করা এই করোনা ভাইরাস ইতিমধ্যেই বিশ্বের প্রায় দেড় শতাধিক দেশে ছড়িয়ে পরেছে।
করোনা ভাইরাস কি?
এটি এমন একটি সংক্রামক ভাইরাস, যা এর আগে কখনো মনব জাতির দেহে আক্রমন করেনি। করোনাভাইরাসের বিভিন্ন রকম প্রজাতি আছে। এতদিন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা জানতেন করোনা ভাইরাসের প্রজাতিগুলোর মধ্যে মাত্র ছয়টি মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে। কিন্তু নতুন ধরণের ভাইরাসের কারণে সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে সাতটি। নতুন এই ভাইরাসের নাম ২০১৯ – এনসিওভি বা নভেল করোনা ভাইরাস।
২০০২ সালে চীনে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া ‘সিভিয়ার এ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম’ (সার্স) নামে একটি ভাইরাসের সংক্রমণে সারা পৃথিবীতে মোট ৭৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল এবং সংক্রমিত হয়েছিলো আরো ৮০৯৮ জন। সেটিও ছিল এক ধরণের করোনা ভাইরাস।
এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোগটির আনুষ্ঠানিক নাম দেয় কোভিড-১৯।
করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ধারণা ভাইরাসটির উৎস কোনো সামুদ্রিক প্রাণী। জানা যায়, মানুষের আক্রান্ত হবার ঘটনাটি ঘটেছে চীনের উহান শহরের এমন একটি বাজারে, যেখানে সামুদ্রিক মাছ পাইকারি বিক্রি হয়। যদিও বেশ কিছু সামুদ্রিক প্রাণী করোনা ভাইরাস বহন করতে পারে, তবে ওই বাজারটিতে অনেক জীবন্ত স্থলচর প্রাণীও বিক্রী হয়। যেমন মুরগি, বাদুর, খরগোশ এবং বিভিন্ন প্রজাতির সাপ। এসব প্রাণীও করোনা ভাইরাসের উৎস হতে পারে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, চীনের হর্সশু নামের একপ্রকার বাদুরের সঙ্গে এই ভাইরাসের ঘনিষ্ঠ মিল রয়েছে।
অধ্যাপক উলহাউজ বলছেন, “যেসব প্রাণী ভাইরাসটি বহন করে, সেগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে চীনের জনগণের। এছাড়াও চীনের বিশাল আকৃতি এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব তাদের মধ্যে ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পরাতে সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে।”
মানুষের মধ্যে কত সহজে রোগটি ছড়িয়ে পড়তে পারে?
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, একেকজন সংক্রমিত ব্যক্তি রোগটি গড়ে ১.৪ থেকে ২.৫ জন ব্যক্তির মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এই সংখ্যাকে বলা হয় ‘Basic Reproduction Number বা মৌলিক প্রজনন সংখ্যা’ – যা একের বেশি হওয়া মানে হলো রোগটি স্বনির্ভর হয়ে উঠেছে। সুতরাং এটি এমন একটি ভাইরাস যা নিজে থেকে বিনষ্ট বা বিলুপ্ত হয়ে যাবে না।
চীনে গৃহীত সিদ্ধান্ত – যেমন শহরগুলো বন্ধ করে দেয়ার মতো কড়া পদক্ষেপের ফলেই রোগটির বিস্তার ঠেকানো যেতে পারে।
এখন সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর ব্যাপার হলো, রোগে আক্রান্ত হওয়ার কোন লক্ষণ ছাড়া ব্যক্তিরাও ভাইরাসটি সুস্থ্য মানুষের দেহে ছড়িয়ে দিতে পারেন। তবে কত তাড়াতাড়ি বা কতটা সহজে সেটা ঘটতে পারে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। ভাইরাসটি কোন একটা প্রাণী থেকে মানুষের দেহে ঢুকেছে এবং একজন থেকে আরেকজনের দেহে ছড়াতে ছড়াতে আবার নিজের জিনগত গঠনে সবসময় পরিবর্তন আনছে – যাকে বলা হয় মিউটেশন।
এই ভাইরাস প্রথমেই মানুষের ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায় এবং শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমেই এটি একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে ছড়ায়। সাধারণ ফ্লু বা ঠান্ডা লাগার মত করেই এই ভাইরাস ছড়ায় হাঁচি কাশির মাধ্যমে !
রোগের লক্ষ্মণ কি?
জ্বর, কাশি, শ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যাই মূলত প্রধান লক্ষ্মণ। নতুন এই ভাইরাসটির জেনেটিক কোড বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে এটি অনেকটাই সার্স ভাইরাসের মতো।
এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মার্ক উলহাউস বলেছেন, “এ ভাইরাসটি অনেকটা ফ্লুর মতো কিন্তু সার্স ভাইরাসের চেয়ে মারাত্মক নয়। প্রথমত জ্বর দিয়ে ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়। এরপর কিছুদিনের মধ্যেই শুকনো কাশি এবং এক সপ্তাহের মধ্যে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে সর্দি থেকে শুরু করে মৃত্যুর সব উপসর্গ দেখা দিতে পারে। প্রতি ৩ জন রোগীর মধ্যে অন্তত একজনের অবস্থা মারাত্মক পর্যায়ে যেতে পারে।”
ভাইরাসটি যেভাবে ঠেকানো যেতে পারে
ভাইরাসটি প্রতিরোধ করতে কোন ভ্যাকসিন বা টিকা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। আপাতত এই রোগ থেকে রক্ষার একমাত্র উপায় হলো অন্যদের মধ্যে ভাইরাসের সংক্রমণ হতে না দেয়া। যার মানে হলো মানুষজনের চলাচল এবং মেলামেশা সীমিত করে দেয়া, নিয়মিত হাত ধুতে সবাইকে উৎসাহিত করা, স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতিরক্ষামূলক পোশাক পরে রোগীদের আলাদা আলাদা করে চিকিৎসা সেবা দেয়া ইত্যাদি।
রোগীদের ভাইরাস রয়েছে কিনা তা জানতে এবং রোগীদের সংস্পর্শে আসা লোকদের শনাক্ত করার জন্য গোয়েন্দা কর্মকাণ্ড বা নজরদারির ব্যবস্থারও প্রয়োজন।
মাস্ক পরে কি করোনার সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব?
বিশ্বের বহু দেশেই ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য একটি জনপ্রিয় ব্যবস্থা হচ্ছে মাস্ক ব্যবহার করা। বিশেষ করে চীনে, যেখান থেকে শুরু হয়েছে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা।
ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা, যাদেরকে বলা হয় ভাইরোলজিস্ট তারা বায়ুবাহিত ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে মাস্ক ব্যবহার করা কতটা কার্যকর সে ব্যাপারে যথেষ্টই সংশয়ে আছেন। ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে সেন্ট জর্জেসের ডঃ ডেভিড ক্যারিংটন বলেন, “সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক বায়ুবাহিত ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে যথেষ্ট নয়”।
তার মতে, এই মাস্কগুলো এতোটাই ঢিলেঢালা থাকে যে এটা বায়ুকে ঠিকমতো ফিল্টার করতে পারেনা।
তবে হাঁচি বা কাশি থেকে ভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি কিছুটা কমাতে সাহায্য করতে পারে এই মাস্ক। আর হাত থেকে মুখের সংক্রমণের বিরুদ্ধেও কিছু সুরক্ষা এটা দেয়। ২০১৬ সালে নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি সমীক্ষায় বলা হয়, মানুষ প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ২৩ বার হাত দিয়ে মুখ স্পর্শ করে।
সচেতনতা ও সঠিক পদক্ষেপ
সর্বোপরি করোনা ভাইরাস থেকে নিজেকে রক্ষার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হচ্ছে সচেতনতা। সুতরাং কেউ আতঙ্কিত না হয়ে নিজের ও পরিবার পরিজন তথা বন্ধু-বান্ধবদের সচেতন থাকার প্রতি উৎসাহী করুন এবং সরকারি বিধিনিষেধ মেনে চলুন। করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত যেকোনো তথ্য ও যোগাযোগের জন্যে ফোন করুন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুমের হটলাইন ০১৯৩৭১১০০১১, ০১৯৩৭০০০৯১১, ০১৯২৭৭১১৭৮৪ ও ০১৯২৭৭১১৭৮৫ ।