বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি প্রতিভাবান ও সম্ভাবনাময় ব্যাটসম্যান হিসেবে আবির্ভাব ঘটেছিলো মোহাম্মদ আশরাফুলের। যদিও এটা সত্য যে, আশরাফুল নিজের অসীম সম্ভাবনার খুব কমই প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু তারপরও আশরাফুলের ব্যাটে চড়েই বাংলাদেশ পেয়েছে তার স্মরণীয় অনেক সাফল্য। চূড়ান্ত রকমের অধারাবাহিক হওয়া সত্ত্বেও যখনই আশরাফুল ব্যাটিংয়ে নামতেন, বাংলাদেশের সকল ক্রিকেটপ্রেমীরা তাঁর অতিমানবীয় কোনো ইনিংস দেখার আশায় বুক বাঁধতেন। কিন্তু পরবর্তীতে সেই আশরাফুল স্পট ফিক্সিং কেলেংকারিতে জড়িয়ে এদেশের কোটি কোটি ক্রিকেটভক্তকে আশাহত করেন। বর্তমানে স্পট ফিক্সিংয়ের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফেললেও জাতীয় দলে তিনি এখনো ব্রাত্য রয়ে গেছেন। আশরাফুল ভবিষ্যতে আর কখনো জাতীয় দলের জার্সি গায়ে মাঠে যদি নাও নামতে পারেন, তবুও অতীতের কীর্তিগুলোই তাকে অমর করে রাখবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম সুপারস্টার হিসেবে। তাঁর বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের স্মরণীয় পাঁচটি ইনিংসের গল্প চলুন জেনে আসা যাক।
১১৪ বনাম শ্রীলঙ্কা, ২০০১
১৭ বছর বয়সে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষিক্ত হোন আশরাফুল। অভিষেক ম্যাচেই প্রতিপক্ষ হিসেবে পান শ্রীলংকাকে। কলোম্বোর সেই টেস্টে প্রথম ইনিংসে দলীয় সর্বোচ্চ ২৬ রান করেন তিনি, যেখানে পুরো দল মাত্র ৯০ রানে অল-আউট হয়ে পরে। শ্রীলংকা তারপর ৫৫৫-৫ তাদের ইনিংস ডিক্লেয়ার করে বাংলাদেশকে ইনিংস পরাজয় থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য ৪৬৫ রান করার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। চামিন্দা ভাস, মুরালিধরনদের সামনে সহজেই গুড়িয়ে যাওয়ার কথা ছিল সেই বাংলাদেশ দলের। কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে ১৭ বছর বয়সী আশরাফুল শ্রীলংকার বোলারদের উপর ছড়ি ঘুড়িয়ে অভিষেক টেস্টে তুলে ফেলেন ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি, খেলেন ২১২ বলে ১১৪ রানের এক অনবদ্য ইনিংস। পাকিস্তানের মুশতাক আহমেদের ৪০ বছরের রেকর্ড ভেঙ্গে টেস্ট ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ সেঞ্চুরিয়ান হিসেবে নিজের নাম পোক্ত করে ফেলেন। শেষ পর্যন্ত ইনিংস পরাজয় ঠেকাতে না পারলেও সেই ইনিংসের মাধ্যমে আশরাফুল তার আগমনী বার্তা পুরো বিশ্বকে জানিয়ে দেন।
১০০ বনাম অস্ট্রেলিয়া, ২০০৫
জুন মাসের ১৮ তারিখে ইংল্যান্ডের কার্ডিফ শহরে সোফিয়া গার্ডেনে যখন এই দুই দল মাঠে নামে তখন কি কেউ কল্পনা করতে পেরেছিল যে কি হতে যাচ্ছে কিছুক্ষণ পরে। টস জিতে ব্যাটিং নিয়েও অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশী বোলারদের নিয়ন্ত্রিত বোলিং-এ ২৪৯-৫ রানেই তাদের ইনিংস সমাপ্ত করে। টার্গেট নাগালের বাইরে না হলেই প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া বলেই রয়ে সয়ে খেলার ফলে প্রথম ২১ ওভারে মাত্র ৭২ রান তুলতে পারে বাংলাদেশ তিন উইকেটের বিনিময়ে। কিন্তু তারপর সব হিসেব-নিকেষ পালটে দেন আশরাফুল। বলের সাথে রানের গতি সচল রেখে চালাতে থাকেন তার ব্যাট। গিলেস্পি, ম্যাকগ্রাদের হতাশ করে ১১টি চারের সাহায্যে ঠিক ১০০ বল খেলে নিজের শতরান পূরণ করে ফেলেন। পরের বলেই আউট হয়ে গেলেও তার আফতাব আহমেদের ১৩ বলে ২১ রানের অপয়াজিত ইনিংস বাংলাদেশকে এক অবিশ্বাস্য জয় এনে দেয়।
৮৭ বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা, ২০০৭
২০০৭ সালের বিশ্বকাপকে বাংলাদেশের ক্রিকেট ভক্তরা দুইটি কারণে বেশি মনে রাখবে। প্রথমত গ্রুপ পর্বে ভারতকে হারিয়ে তাদেরকে টুর্নামেন্টের প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় করে দেয়া এবং প্রথমবারের মত বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে প্রবেশ করা। কিন্তু এই দুইটির পাশাপাশি আরো একটি স্মরণীয় জয় বাংলাদেশ পেয়েছি এই বিশ্বকাপে। আর তা হল সুপার-এইট রাউন্ডে দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে ৬৭ রানের জয়। সেই ম্যাচে বাংলাদেশ প্রথমে ব্যাট করে ২৫১-৮ রানে তাদের ইনিংস সমাপ্ত করে। আর তাদের সংগ্রহ ২৫০ ছুঁতে পারে আশরাফুলের আরো একতি অনবদ্য ইনিংসের কল্যাণে। ২৪ ওভারের ভেতর মাত্র ৮৪ রানে চার উইকেট হারিয়ে ফেলার পরে আশরাফুল ৮৩ বলে ৮৭ রানের এই আক্রমণাত্মক ইনিংস খেলেন, যেখানে তিনি আফ্রিকান বোলারদেরদের অসহায় করে মোট ১২টি চার হাঁকান। আর তারপর বাংলাদেশের বামহাতি স্পিনত্রয়ী, রাজাক, সাকিব আর রফিক, একত্রে ছয়টি উইকেট নিয়ে দক্ষিন আফ্রিকাকে ১৮৪ রানে অল-আউট করে দেন।
৬১ বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ২০০৭
২০০৭ সালে বিশ্বকাপে প্রথমবারের মত শেষ আটে জায়গা করে নিয়ে নতুন আত্মবিশ্বাসের সাথে বাংলাদেশ পাড়ি দেয় দক্ষিণ আফ্রিকায় ক্রিকেটের নতুন সংস্করণ টি-টুয়েন্টির প্রথম বিশ্ব আসরে অংশ নিতে। সেখানে প্রথম ম্যাচেই প্রতিপক্ষ হিসেবে তারা পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। ১৬৫ রানের টার্গেটে নেমে চার ওভার শেষে ২৮ রানে বাংলাদেশ হারিয়ে ফেলে দুই উইকেট। এরকম কোণঠাসা অবস্থান থেকেই আশরাফুল আফতাব আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে শুরু করেন তান্ডব। মাত্র ২০ বলে সাত চার আর ৩ ছয়ের মারে তুলে ফেলেন তার অর্ধশতক, যা এখনো আন্তর্জাতিক টি-টুয়েন্টি ম্যাচে বাংলাদেশের দ্রুততম পঞ্চাশ। ২৭ বলে ৬১ রানে আউট হয়ে গেলেও তার শুরু করা কাজ সমাপ্ত করে আসেন আফতাব, ৪৯ বলে অপরাজিত ৬২ রান করে আর বাংলাদেশ ম্যাচটি জিতে যায় ছয় উইকেটে।
১৯০ বনাম শ্রীলংকা, ২০১৩
দুই বছর টেস্ট দল থেকে বাদ থাকার পরে ২০১৩ সালে শ্রীলংকার বিপক্ষের টেস্ট সিরিজে আবার জাতীয় দলে প্রবেশ করেন আশরাফুল। টেস্ট ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ইনিংসের অভিষেককেও একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে স্মরণীয় করে রাখেন আশরাফুল। প্রথম ইনিংসে গলের ব্যাটিং স্বর্গে শ্রীলংকা ৫৭০-৪-এর পাহাড়সম স্কোরে ইনিংস ঘোষণা করে। শ্রীলংকার ইনিংস বিজয়ের আশা ভঙ্গ করে, আশরাফুল খেলেন এক অতিমানবীয় ইনিংস। জাতীয় দলে আবারো নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার যুদ্ধে নেমে, মুশফিকুর রহিমের সাথে ২৭৪ রানের এক মহাকাব্যিক পার্টনারশিপ গড়ে তোলেন। তৃতীয় দিনে একে একে শত রান ও দেড়শ রানের মাইলফলক ছুঁয়ে ১৮৯ রানে দিনশেষ অপরাজিত থাকেন। সুযোগ ছিল তার কাছে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে টেস্টে দুইশত রান করার কিন্তু পরের দিন মাত্র এক রান যোগ করেই তার উইকেট বিলিয়ে আসেন আশরাফুল। তিনি না পারলেও মুশফিক সেই ম্যাচে ২০০ রানের মাইলফলক ছুঁয়ে ফেলেন আর ম্যাচটি শেষ হয় ড্র হিসেবে।