হরর সিনেমার ইতিহাসে ‘ইভিল ডেড’ এর মত জনপ্রিয়তা অর্জন করা ফ্রাঞ্চাইজির খুবই সামান্য। হরর এবং ব্ল্যাক কমেডি নিয়ে ইভিল ডেড মুভি সিরিজের মোট তিনটি সিনেমা নির্মিত হয়েছে। এই ট্রিলজির প্রথম সিনেমাটি বহু আগেই পেয়েছে কাল্ট ক্লাসিকের মর্যাদা। যদিও অতিরিক্ত ভায়োলেন্সের কারণে সিনেমাটি কিছু কিছু দেশে নিষিদ্ধ হয়েছে। তবুও এখন পর্যন্ত এটি আন্তর্জাতিক সিনেমা ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হরর সিনেমাগুলোর একটি। স্পাইডারম্যান খ্যাত পরিচালক স্যাম রেইমির এক অনবদ্য মাস্টারপিস এই ইভিল ডেড ফ্রাঞ্চাইজি।
ট্রিলজি বলতে তিনটি পর্বকে বুঝায়। ইভিল ডেডের এই পুরো ট্রিলজিকে সিরিজ না বলে বরং প্লট এবং চরিত্রের মধ্যে যোগসাজশ থাকা আলাদা ৩টি সিনেমা বলাই ভালো। এই ট্রিলজির প্রথম সিনেমা The Evil Dead মুক্তি পায় ১৯৮১ সালে। মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির পাঁচ শিক্ষার্থী অ্যাশ, তার বান্ধবী লিন্ডা, তার বোন সেরিল এবং তাদের বন্ধু স্কট এবং স্কটের বান্ধবী শেলীকে নিয়ে দ্য ইভিল ডেড সিনেমাটির কাহিনী ! সংক্ষেপে গল্পের খানিকটা পড়ে নেয়া যাক…
দ্য ইভিল ডেড ১
একটি ‘1973 Oldsmobile Delta 88’ মডেলের গাড়ি নিয়ে টেনেসির প্রত্যন্ত এলাকার জনমানবহীন একটি উড কেবিনে তারা বসন্তের ছুটি কাটানোর উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। মাঝপথে একটি ট্রাকের সঙ্গে তারা অল্পের জন্য সংঘর্ষ হওয়া থেকে বেঁচে যায়। এটাই ছিলো বিপদের অশনি সংকেত। এরপর কেবিনে যাওয়ার পথে পুরনো একটি নড়বড়ে ব্রিজে তাদের গাড়ির চাকা আটকে যায়। ভাঙাচোরা ব্রিজ আর গভীর জঙ্গলে পুরনো কেবিন, তখনো কোনো পরিচালকের মাথায় আসেনি এটাই হতে পারে হরর সিনেমার জন্য একদম উপযুক্ত পরিবেশ ! অধিকাংশ ভৌতিক সিনেমা’র শুরুতেই সামনে আসন্ন বিপদের আভাস দেয়া হয় বা বিদঘুটে কিছু মিউজিকের মাধ্যমে ভীতিকর আবহ সৃষ্টি করা হয়। ইভিল ডেড সিনেমার শুরুর অংশটাও ঠিক তেমনই…
সেই পুরনো কাঠের কেবিনে পৌঁছে সবাই যখন গল্পগুজব করছে, অ্যাশের বোন সেরিল তখন রুমে ঝুলানো পুরোনো একটি ঘড়ির ছবি আঁকায় ব্যস্ত। হঠাৎ তিনি খেয়াল করেন, ঘড়িটি থেমে গেছে এবং জানালার বাইরে থেকে ফিসফিসে কন্ঠ ভেসে আসছে। কেউ যেনো বলছে,”আমাদের কাছে চলে আসো”!
ব্যাপারটাকে মোটেও পাত্তা না দিয়ে সে যখন আবার ছবি আঁকা শুরু করলো, তখনই ঘটলো একটি অদ্ভুত ঘটনা। নিজের হাতের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো সে। যেনো কেউ একজন তার উপর ভর করেছে, যে কিনা তাকে দিয়ে নিজের একটি ছবি আঁকিয়ে নিচ্ছে। ভৌতিক মুখাবয়বের প্রচ্ছদ সম্বলিত একটি বইয়ের ছবি, যাকে বলা হয় নেক্রোনোমিকেন !
এরপর রাতে খাওয়ার সময় হঠাৎ করেই ফ্লোরের বেজমেন্টের দরজা খুলে গেলে অ্যাশ এবং তার বন্ধু স্কট কি ঘটছে দেখার জন্য সেখানে যায়। সেখানে গিয়েই তারা খুঁজে পায় Naturom Demonto বা Necronomicon Ex-Mortis নামের একটি বই, যা হচ্ছে Book of the Dead নামের একটি মিশরীয় বইয়ের সুমেরীয় সংস্করণ ! আর এই বইটির ছবিই সেরিল এঁকেছিলো কিছুক্ষণ আগে !
তারা এর সাথে আরো খুঁজে পায় একটি টেপ রেকর্ডার, যেখানে এই বইটি সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে। এই বইটি নাকি শয়তানের উপাসকরা লিখেছিলো মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য। মানুষের রক্ত দিয়ে লেখা এই বইয়ের কিছু লাইন, যা মন্ত্রের মত ঠিকভাবে পড়লে শয়তান জগতের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করা যায়। তারা যখন সেই টেপ রেকর্ডারটি চালু করলো, তখনই ঘটলো বিপত্তি। ওখানে রেকর্ড করা ছিলো কেবিনের মালিকের কন্ঠে পঠিত ওই বইয়ের কিছু অংশ। যে কারণে জঙ্গলের গভীর থেকে উঠে আসে শয়তানের দল। কেবিনের বাইরের প্রতিটি গাছের উপরেও ভর করে অশরীরী আত্মা, অন্যদিকে এই জঙ্গল থেকে বের হওয়ার একমাত্র ব্রিজটিও পুরোপুরি ভেঙে যায়। অ্যাশ আর তার বন্ধুদের জন্য এই দুর্গম জায়গা থেকে বের হবার সব পথই বন্ধ হয়ে যায় ! তারপর ঘটতে থাকে মর্মান্তিক সব ঘটনা…
দ্য ইভিল ডেড ২
ইভিল ডেড ট্রিলজির দ্বিতীয় পর্ব অর্থাৎ দ্য ইভিল ডেড সিনেমার সিক্যুয়েল ‘Evil Dead 2 : Dead by Dawn’ মুক্তি পায় ১৯৮৭ সালে। প্রথম সিনেমাটি যেখানে শেষ হয়, এই সিনেমা শুরু হয় ঠিক সেখান থেকেই। শুরুতে প্রথম পর্বের শুরুর কিছু অংশ দেখানো হয়, যার কারণে অনেকেই এটাকে দ্য ইভিল ডেড সিনেমার রিমেক ভেবে ভুল করেন। এখানে অ্যাশ বাদে অন্যান্য চরিত্রগুলো সব আলাদা। পর্দায় আবির্ভাব হয় সেই পুরনো নির্জন কেবিনের মালিকের মেয়ে, তার বন্ধু এবং আরো দুজনের। আবারও শুরু হয় প্রেতাত্মাদের সাথে অ্যাশের লড়াই…
অল্প বাজেটের একটি হরর সিনেমা থেকে একজন দর্শক যে এত বেশি পরিমাণে ভয় হজম করতে পারবেন, তা এই সিনেমার প্রথম দুটো পর্ব দেখার আগে কেউ ভাবেনি।
আর্মি অব ডার্কনেস
১৯৯২ সালে মুক্তি পায় ইভিল ডেড ট্রিলজির শেষ পর্ব ‘Army of Darkness’। এই সিনেমায় কমেডির পরিমাণ ছিলো বেশি এবং ভৌতিক দৃশ্য কিছুটা কম। আগের দুটো পর্বের সাথে এই পর্বের ব্যতিক্রমীতা হচ্ছে, এই সিনেমাটি দেখলে ভয়ের পাশাপাশি হাসিও পাবে দর্শকদের। সিনেমার শুরুতেই দেখা যায়, অ্যাশ মধ্যযুগের ইউরোপে চলে এসেছে। টাইমমেশিন ছাড়াই সে কিভাবে এত পুরনো যুগে ফিরে এলো, তা বোঝার জন্য দেখতে হবে দ্বিতীয় পর্বটি।
সিনেমায় দেখানো সেই মধ্যযুগের লোকেরা বিশ্বাস করেন, একদিন আকাশ থেকে এমন একজন ব্যক্তি নেমে আসবেন, যিনি শয়তানের হাত থেকে তাদের রক্ষা করবেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও অ্যাশ আবারো শয়তানের সাথে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়। শুরু হয় তার নতুন লড়াই। আর্মি অব ডার্কনেস আগের সিনেমা দুটোর মত নয়, বরং বলা যায় একরকম সহজপাচ্য পপকর্ণ মুভি। রোমান্স এবং ব্যতিক্রমধর্মী অ্যাকশন দৃশ্য দুটোই রয়েছে এখানে…
ইভিল ডেড নির্মাণের গল্প
ইভিল ডেড সিনেমার পরিচালক স্যাম রেইমি। তার সাথে অ্যাশ চরিত্রে অভিনয় করা ব্রুস ক্যাম্পবেল হচ্ছেন তার ছোটবেলার বন্ধু। তাঁরা বড় হয়েছেন একই সাথে। বলা যায়, এই দুজন মিলেই তৈরি করেছেন আজকের এই ইভিল ডেড ফ্রাঞ্চাইজি। এই ট্রিলজির প্রথম পর্ব দ্য ইভিল ডেড সিনেমাটি বানানোর আগে তারা দুজন মিলে বেশ কিছু স্বল্প বাজেটের শর্টফিল্ম বানিয়েছিলেন, যেগুলো ছিলো মূলত কমেডি ঘরানার। ‘Its Murder’ নামের একটি শর্টফিল্ম বানানোর সময় সাসপেন্স দৃশ্য শ্যুট করতে গিয়ে হরর ধাঁচের সিনেমা বানানোর প্রতি তাঁরা উৎসাহিত হয়েছেন। সেখান থেকেই বানালেন ‘Within the Woods’ নামের একটি হরর শর্টফিল্ম, যার বাজেট ছিল মাত্র ১,৬০০ ডলার ! ইভিল ডেড বানানোর আগে এটাই ছিলো তাদের পরীক্ষামূলক প্রস্তুতি…
কিন্তু পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা বানানোর জন্য দরকার বিশাল বাজেট। বিভিন্ন প্রযোজকের কাছে ধরনা দিয়ে এবং আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী ও বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে ধার করে শেষমেশ তারা তিন লাখ পঞ্চাশ হাজার ডলার জোগাড় করতে পারলেন। এরপর পরিচিত মানুষজনদের মধ্যে থেকেই বাছাই করা হয় সিনেমাটির কাস্ট। ১৯৮১ সালে এরকম একটা সিনেমা বানানোর জন্য এখনকার মত এত উন্নত প্রযুক্তিও ছিলো না। এত সংকটের মাঝেও ক্যামেরা থেকে শুরু করে সম্পাদনা পর্যন্ত সবখানেই দক্ষতার ছাপ রেখেছেন পরিচালক সহ সকল কলাকুশলীরা।
মাত্র ১৩ জন ক্রু মিলে এত স্বল্প বাজেটে এমন একটা সিনেমা কিভাবে বানিয়েছিলেন, তা শুনে স্বভাবতই অবাক হতে হয় ! সিনেমাটি জঙ্গলের মধ্যে যে কেবিনে শ্যুট করা হয়েছিল, সেখানেই গাদাগাদি করে থাকত সবাই। ব্রিজের ধারে শ্যুট করতে গিয়ে একদিন জঙ্গলে হারিয়ে গিয়েছিলো পুরো দলটি। সিনেমার শ্যুটিংয়ের শেষদিকে প্রচন্ড ঠান্ডায় শেষপর্যন্ত কেবিনের আসবাবপত্র পুড়িয়েও নিজেদের শরীর গরম রাখতে হয়েছিলো তাদেরকে ! বর্তমান সময়ের মত কোনো স্পেশাল ইফেক্ট ছিল না তখন। মেকআপের উপর ভরসা করেই ভৌতিক দৃশ্যগুলো পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে হয়েছিলো। একধরনের সিরাপ ব্যবহার করে কয়েক গ্যালন কৃত্রিম রক্ত বানানো হয়েছিলো। আর কিছু মৃত মুরগী কোপানো হয়েছিলো মাংস কাটার শব্দ যুক্ত করার জন্য !
সিনেমা বানানো শেষ হয়ে গেলে স্যাম রেইমি ঠিক করলেন বড় সড় একটি প্রিমিয়ার করবেন। একটা থিয়েটারে সিনেমাটি মুক্তি দিয়ে মোটামুটি ভালো সাড়া পেলেন দর্শকদের কাছে। এরপর কান চলচ্চিত্র উৎসবে সিনেমাটি প্রদর্শনের জন্য অনুমতি পান তিনি। তখন বিশ্বখ্যাত আমেরিকান লেখক স্টিফেন কিং এর নজরে আসে সিনেমাটি। দ্য ইভিল ডেডের ভূয়সী প্রশংসা করলেন তিনি। বললেন, তাঁর সবচেয়ে প্রিয় পাঁচটি হরর সিনেমার একটির মধ্যে রেখেছেন এই সিনেমাকে !
দ্য ইভিল ডেড সম্পর্কে স্টিফেন কিং বলেন, ‘The most ferociously original horror film of the year’। তার এই উক্তিটি সিনেমাটির প্রচারণার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিলো।
থিয়েটারে প্রথমে ভীড় কম থাকলেও এরপর থেকে ধীরে ধীরে দর্শকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত সিনেমাটি তাদের প্রত্যাশার চেয়ে অনেক গুণ বেশি সফলতা পায় বক্স অফিসে। বিশ্বজুড়ে সব মিলিয়ে প্রায় ২৪ লাখ ডলার আয় করে সিনেমাটি, যা মোট বাজেটের প্রায় আট গুণ। প্রথম পর্বের জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে এবং আরো বড় বাজেটের কল্যাণে পরবর্তী দুটো সিনেমাও আশানুরূপ সাফল্য পায়। যদিও অনেকের কাছে এই সিরিজের প্রথম পর্বটিই সেরা। এমনকি আমার কাছেও…
ইভিল ডেড ফ্রাঞ্চাইজির রয়েছে একটি শক্তিশালী ফ্যানবেজ। আজীবন ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কাল্ট সিনেমার তালিকায় থাকবে এটি। ২০১৩ সালে ‘ইভিল ডেড’ নামে আরেকটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে, অনেকটা রিমেক বলা যায় একে। কিন্তু ট্রিলজির মূল চরিত্র অ্যাশের বদলে এসেছে মিয়া অ্যালেন নামের আরেকটি চরিত্র। তাই সিনেমাটি স্বভাবতই মুখ থুঁবড়ে পরেছে…
তবে সম্প্রতি এই ফ্রাঞ্চাইজি থেকে নির্মিত হয়েছে Ash vs Evil Dead নামের একটি টিভি সিরিজ। এর মূল চরিত্রে আছে সেই পুরনো অ্যাশ। সিরিজটির তিনটি সিজন মুক্তির মাধ্যমে ২০১৮ সালে শেষ হয়ে গেছে ইভিল ডেডের রাজত্ব আর এই সিনেমার আইকনিক চরিত্র অ্যাশের লড়াই। ভবিষ্যতে অ্যাশকে আর কখনো লড়তে দেখা যাবেনা বলেও জানা গেছে ইতমধ্যেই…