অনেকেই বলে মোঘলাই খাবারের আদি উৎপত্তি নাকি আফগানিস্তানের কাবুলে ! আসলে মোঘলদের খাবারের ঐতিহ্য আসলে কাবুল নয় এটা এসেছে ইরান থেকে । পরবর্তীতে এতে আফগানিস্তানের কাবুলের কিছু মিশ্রন যুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশের অনেক মানুষই মনে করেন, মোঘলরা বাংলাদেশি সম্পত্তি এবং কাবাব এ অঞ্চলের নিজস্ব খাবার। যা কিনা একেবারেই ভুল তথ্য।
বহু আগে থেকেই ভারতীয়রা কাবাবকে তাদের নিজস্ব খাবার বলে চালিয়ে দিচ্ছিলো। সেখান থেকেই মূলত কাবাব সম্পর্কে এমন একটি ধারণা জন্মেছে যে, বাংলার নবাবদের হাত ধরে কাবাবের উৎপত্তি। আবার অনেকের ধারনা এই কাবাব বাংলাদেশ অথবা ভারতের নিজস্ব খাবার ! আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা খাবারের নিজস্ব কোনো ব্রান্ড ভ্যালু তৈরী করতে পারেনি। তাই প্রায়ই পুরান ঢাকার বিভিন্ন হোটেল রেস্তোরার মালিক বা বাবুর্চিত মুখে কাবাবকে তাদের পূর্বপুরুষের আবিষ্কার বলে চালিয়ে দিতে শোনা যায় তবে উৎপত্তি যেখানেই হোক, এই উপমহাদেশের মানুষ অনেক মজাদার খাবারের সাথে পরিচিত হয়েছে ভোজনরসিক মোঘলদের মাধ্যমেই। আর এজন্যই বোধহয় প্রায়ই মুখরোচক খাবারগুলোর সাথে ‘মোঘলাই’ শব্দটি জুড়ে দেয়া হয়… অনেক ক্ষেত্রে মোঘলাই বিবর্তিত হয়ে মোগলাই শব্দেও ব্যাবহার করা হচ্ছে।
অধিকাংশ মানুষ ও পেশাদার রান্না সংশ্লিষ্ট সকলেই কম বেশি এই তত্বে বিশ্বাস করেন যে কাবাবের উৎপত্তিস্থল তাদের এই উপমহাদেশ কিন্তু ইতিহাসবিদদের মতে কিন্তু বাস্তবতা একদমই আলাদা । কাবাবের উৎপত্তিস্থল কোনভাবেই ভারতীয় উপমহাদেশ নয়। আসল ব্যাপার হচ্ছে, আগুন আবিষ্কার হওয়ার পর থেকে মানুষ যখনই পুড়িয়ে মাংস খাওয়া শিখলো, মূলত তখনই কাবাবের ধারণা জন্ম নেয়।
পৃথিবীর যে অঞ্চলগুলোতে নিজস্ব মশলা এবং তেল ছিলো, সেখানেই এই পোড়ানো মাংসের বিভিন্ন স্বাদ আবিষ্কৃত হতে লাগলো প্রকৃতপক্ষে কাবাবের আদিরূপ ছিলো এগুলোই। তৎকালীন এশিয়া অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে প্রাকৃতিকভাবেই নানা রকম স্বাদবর্ধক উদ্ভিদের প্রাচুর্য্য ছিলো। এই সকল স্বাদবর্ধক উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত ফল, ছাল এবং পাতাই পরবর্তীতে মশলা হিসেবে সুপরিচিত লাভ করে। একটা সময় পোড়ানো মাংসে এই সকল মশলার ব্যবহার শুরু হয়। এইভাবে একটা সময় সকলের অলক্ষ্যে শুরু হয় ‘কাবাব’ নামক পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় খাবারের পথচলা।
ইতিহাস শুধু এখানেই শেষ নয় , আরো সুনির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে তুরষ্কের নাম চলে আসে। ‘কাইসা-ই-ইউসুফ’ নামক একটি প্রাচীন লিপিতে ১৩৭৭ সালে প্রথম কাবাবের কথা শুনতে পাওয়া যায়। ভৌগলিকভাবে প্রাকৃতিক আর্শিবাদতুষ্ট এই অঞ্চলে নানা ধরনের মশলার গাছ এবং ব্যবহার ছিলো। তার্কিশ সৈন্যরাই প্রথম সময় বাঁচাতে সদ্য শিকার করা পশুর বিভিন্ন মাংশল অংশ তরবারীর আগায় ঢুকিয়ে আগুনে পুড়িয়ে খেত।
একে বলা যায় আধুনিক কাবাবের আদিরূপ। তবে ইতিহাস ভালভাবে ঘাটলে কাবাবের গল্পতে খিচুড়ি পাকিয়ে যায় কারন স্যান্তোরিনির গ্রিক আইল্যান্ডের আক্রোতিরিতে খননকাজ চালানোর সময় খৃষ্টপূর্ব সতেরো শতাব্দীর একধরনের সমান্তরাল দুই পায়া বিশিষ্ট একটি চুলা আবিষ্কার হয়েছে, যার সাথে বর্তমান কাবাব বানানোর কয়লার চুলার প্রায় শতভাগ মিল খুঁজে পাওয়া যায়।সন্দেহটা আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন মহাকবি হোমার। তিনি তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ইডিয়াডে কয়েক টুকরো ঝলসানো মাংসপিন্ডের কথা উল্লেখ্য করেছেন।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে একে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। কোথাও বলা হয় কেবাপ, কেবোব আবার কোথাও বা কিবোব। আবার কোথাও বলা হয় কেবাভ আর কিছু জায়গায় বলা হয় কেবাবী। কাবাব কথাটার আসলে আরামাইক ‘কারব্ববা’ থেকে এসেছে যার উৎস “আকাদিয়ান কাবাবু” মানে আগুনে পোড়ানো বা ঝলসানো। বর্তমানে গোটা পৃথিবী জুড়ে কাবাবের বিভিন্ন রূপ ছড়িয়ে আছে।
ভারতীয় উপমহাদেশে সনাতন ধর্মাবলীদের আধিক্যতার জন্য এখানে খাবার ব্যাবস্থায় তাদের আচার সংস্কৃতির বিষয়গুলো লক্ষ্য করা যায় । একটা সময় যখন ভারতে মুসলিম সাম্রাজ্যের যখন বিকাশ ঘটে – তা একদিকে যেমন সমাজ ব্যবস্থায় কিছুটা পরিবর্তন আনে, তেমনি প্রচলিত খাবার ব্যবস্থায়ও কিছুটা পরির্বতন আসে। ভারতীয় সমাজে মাংস গেঁথে আগুনে পুড়িয়ে খাওয়ার এই রেওয়াজ পরবর্তীতে মোঘলদের হাতে একটি শিল্পে পরিনত হয়।
ভারত থেকে প্রায় ৪ হাজার ৬শ কিলোমিটার দূরে তুরষ্কের বুরসা শহরের
দিকে যাই । এটা তুরষ্কের আনাতোলিয়ার অন্যতম বড় শহর। আনাতোলিয়াকে বলা হয় কাবাবের রাজ্য। তো এই শহরে ১৮’শ থেকে ১৯’শ শতাব্দীর মাঝামাঝি কোন এক সময়ে ইস্কান্দার এফেন্দি নামক এক ভোজন রসিক ব্যক্তি ছিলেন যিনি পোড়ানো মাংসের একটি চমৎকার রেসিপি আবিষ্কার করেন।
এই পদ্ধতিতে কচির ভেড়া অথবা গরুর অথবা মুরগীর মাংসকে সামান্য কিছু উপাদান দিয়ে মেরিনেশন করে লম্বা একটি কাঠির ভেতর প্রবেশ করিয়ে খাড়াভাবে স্থাপিত একটি কয়লার চুলায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পোড়ানো হতো। পোড়া মাংসগুলো সাইড থেকে কেটে ফেলার পর পাওয়া যেত ভেতরের নরম ও সুস্বাদু অংশ। এই নরম মাংসের কিছু টুকরোকে বেকড রুটির ভেতরে দিয়ে সালাদ, লেটুস, পার্সলে টমেটো, পেঁয়াজ ইত্যাদি ও সস দিয়ে সাজিয়ে পরিবেশন করা হয়। এইভাবে শুরু হয় দুর্দান্ত স্বাদের এক কাবাবের যা পরবর্তীতে তুরুষ্কের অন্যতম জনপ্রিয় খাবারে পরিনত হয়। শুরুর দিকে এই কাবাবকে ইস্কান্দার কাবাব হিসেবেই লোকে জানত। পরবর্তীতে এর নাম হয় ডোনার কাবাব যা চাহিদার দিক থেকে বর্তমান বিশ্বে শীর্ষে। উল্লেখ্য, তার্কিশ ভাষার ডোনার মানে ঘুর্ণয়মান। কাদির ন্যুম্যান নামে এক ব্যক্তির হাত ধরে ১৯’শ সালের শেষের দিকে এই কাবাব ইউরোপে বিশেষ করে জার্মানী এবং ইংল্যান্ডে দারুন জনপ্রিয় হয়ে উঠে।
কিমা করা মাংসে কুচি করা ধনে পাতা, লেবুর রস, অলিভ ওয়েল আর সামান্য কিছু গুপ্ত মশলা ব্যবহার করে ভালো করে মাখিয়ে ছোট ছোট বল আকৃতিতে শিকে পুড়ে যখন গনগনে কয়লার আগুনে পুড়তে দেয়া হয় , তখন নিজের অজান্তেই তৈরী হয়ে যায় চমৎকার একটি খাবার ।