ঘটনাটা ৯০ দশকের ! এক ছেলেকে হত্যার উদ্দেশ্যে ধরে আনা হয়েছে। ছেলেটির বয়স হবে আনুমানিক ২০-২২ বছর। কালো কাপড়ে চোখ বাঁধা। গায়ে কালো প্যান্ট আর সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি। দুই হাত জোড় করা অবস্থায় হাঁটু গেড়ে বসা। তার উল্টো পাশে আট দশ জন যুবক। তাদের একজন পিস্তলে গুলি লোড করছে। কালো কাপড়ে বাঁধা ছেলেটি অনুনয় বিনয় করছে। বলছে, ‘আমারে জানে মাইরেন না ভাই।’
পিস্তল হাতের যুবকটি বললেন, ‘ঠিক আছে, তুই যেমনে কবি, ওমনেই হইবো। এইবার বল, তোর শরীরের কোন দিকে গুলি করলে কষ্ট কম হইবো। মনে কর, এইটাই তর জীবনের শেষ ইচ্ছা।’
এ কথা শুনেই হাউমাউ করে কান্না করতে থাকে ছেলেটি। পা ধরে মাফ চায়, কসম কাটে ! কিন্তু পিস্তল হাতের যুবকটির এক কথা, কোথায় গুলি করলে কষ্ট কম হবে। বার বার একই প্রশ্ন করে যাচ্ছে সে। এক সময় চোখ বাঁধা ছেলেটির পায়ে পিস্তল ঠেকিয়ে বলে, ‘ঠিক আছে তরে পায়ে গুলি করি’। এ কথা বলেই সে ট্রিগার চেপে দেয়। গুলি পায়ের একদিকে ঢুকে আরেকদিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। ‘ওরে বাবা’ বলে চিৎকার করে ছেলেটি। সহযোগীরা ছেলেটিকে জাপটে ধরে রাখে। মুখের ভিতর গুঁজে দেয় কাপড়। এবার বুকে, হাতে এবং শেষে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি চালানো হলো। গগনবিদারী চিৎকার হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলো। চারদিকে নিস্তব্ধতা…
খুনি এবার সহযোগীদের নির্দেশ দিয়ে বললো, ‘যা লাশটা মাটিতে পুঁইতা রাখ গা।’
ঢাকার আমিনবাজারের তুরাগ নদীর পাড়ে এভাবেই একের পর এক খুন করেছেন শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন। যিনি বর্দির (বরদেশী গ্রামের ছোট নাম) মামুন নামেই পরিচিত। তার পুরো নাম খন্দকার মামুন। কথা বলতে বলতে মানুষ খুন করা ছিলো তার কাছে নেশার মত। তবে খুনের আগে জীবনের শেষ ইচ্ছা জেনে নিত মামুন। মামুনের কাছে শেষ ইচ্ছা বলতে শরীরের কোথায় গুলি করা হবে, তা জেনে নেওয়া। এভাবেই শেষ ইচ্ছা জেনে নিয়ে খুন করত কাছ থেকে ধীরে সুস্থে…
মামুন এতটাই ভয়ংকর ছিলো যে, আমিনবাজারে তার নাম মনে করলে এখনো মানুষ আঁতকে উঠে। এই মামুন একসময় খুন হওয়ার পর আমিনবাজারের মানুষ যেনো প্রাণ ফিরে পায়। ওই সময়ে সিরিজ গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। একসঙ্গে তিনজন, দুজন গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। অতিষ্ঠ মানুষ মামুন খুনের পর তার সহযোগীদের যেখানে পেয়েছে সেখানেই গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করেছে। মামুনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিলো এমন একটি সূত্র জানায়, ‘হ্যাঙ্গলা পাতলা গড়নের মামুনের ভীষণ সাহস ছিলো। সে সবসময় অস্ত্র বহন করত। ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াত।’
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮৮ সাল থেকেই রাজধানীর সবচেয়ে বড় মাদকের আখড়া ছিলো এই আমিনবাজার। রাজধানীর উপকণ্ঠ আমিনবাজারের এ জায়গাতেই ভিড়ত ফেনসিডিলের চালান। যার পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করত বর্দির মামুন। আর এই মাদকের ডিপো নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে খুন-খারাবি থেকে শুরু করে প্রায় সবধরনের অপরাধই করেছে মামুন। মামুন বাহিনীতে শুধু ওই এলাকার অপরাধীরাই নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকার দুর্ধর্ষ অপরাধীদের নিয়ে এসেছিলো মামুন। পুলিশও মামুনের আখড়ায় হানা দিতে একসময় ভয় করত। যে কারণে মামুন চলাফেরা করত বুক চিতিয়ে। মাদক ব্যবসায় অঢেল সম্পদের মালিক বনে যান মামুন। অস্ত্রের ভাণ্ডার গড়ে তোলেন আমিনবাজারে। রাজধানীর দুর্ধর্ষ অপরাধীদের নিয়ে গড়ে তোলে তার নিজস্ব বাহিনী। যারা আমিন বাজার থেকে শুরু করে রাজধানীর শ্যামপুর পর্যন্ত দাঁপিয়ে বেড়াত। আমিনবাজারের বরদেশী গ্রামের ভিতর দিয়ে বয়ে চলা তুরাগ নদীর তীর ছিলো তার খুন করার জায়গা। মাদকের ব্যবসায় যারা প্রতিবাদ করত বা নতুন করে মাদক ব্যবসা শুরু করত তাদেরকেই ধরে নিয়ে যাওয়া হতো নদীর তীরে। যেখানে সন্ধ্যার পর মানুষ চলাচল করে না। সেখানেই বসত তার খুনের আসর। এই নদীর তীরেই সে তার প্রতিপক্ষ গুলজারকে হাত-পা বেঁধে পানিতে ফেলে দিয়েছিলো। সাভার থানার ওয়ারেন্টের আসামি মামুন এতটাই দুর্ধর্ষ ছিলো যে, অস্ত্র হাতে সাভার থানায় গিয়ে পুলিশ সদস্যদের হত্যার হুমকি দেওয়ার ঘটনাও সে ঘটিয়েছে…
৯০ সালের দিকে মামুনের সাথে দ্বন্দ্ব বাঁধে বিকাশ আর প্রকাশের। সমঝোতার কথা বলে মিরপুর এলাকায় মামুনকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই কাটা রাইফেল ঠেকিয়ে মামুনকে হত্যার জন্য গুলি চালায় প্রকাশ। গুলিবিদ্ধ মামুনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সংবাদ পেয়ে পুলিশ হাসপাতালে যায় মামুনকে গ্রেফতারের জন্য। এ খবর মামুনের কাছে পৌঁছে যায়। হাসপাতাল থেকেই ট্রলি সহ তার সহযোগীরা বের করে বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায় মামুনকে। এরপর সে সুস্থ হয়ে ওঠে। বেপরোয়া হয়ে পড়ে মামুন। রাজধানীর শীর্ষ সন্ত্রাসী আসলাম, সুব্রত বাইন, পিয়াল সহ আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। রাজধানীর এই শীর্ষ সন্ত্রাসীরা এক জোট হয়ে মামুনকে হত্যার পরিকল্পনা আঁটে।
১৯৯৬ সালের এক দিনে, মিরপুর এলাকায় মোল্লা মাসুদ গুলি করে হত্যা করে মামুনকে। ঈদের আগে স্ত্রীকে নিয়ে শপিং করে রিকশায় চড়ে বাড়ি ফিরছিলো মামুন। কিন্তু আগে থেকে ওৎ পেঁতে থাকা মোল্লা মাসুদের বাহিনী তাকে গুলি চালায়। মামুন পাল্টা গুলি চালালেও তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। মোল্লা মাসুদ বাহিনীর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মামুনের জীবনপ্রদীপ সেদিন থেমে যায়…