বয়স তার ৯০ বছর। এই ৯০ বছর বয়সে সাইকেল চালিয়ে গ্রামবাসীকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন এই মানুষটি ! এবং তা একদিন দুইদিন নয়, বিগত ৪৪ বছর যাবৎ তিনি এ সেবাটি দিয়ে আসছেন ! ভাবা যায়?
নাম জহিরন বেওয়া । প্রতিদিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে অসুস্থ দরিদ্র মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ায় তার মূল কাজ। পূর্বেও তাকে নিয়ে পত্রপত্রিকায় দুয়েকটি সংবাদ ছাপা হতে দেখা গেছে। আজ ফেসবুক ফিডে এই মহীয়সী নারীকে নিয়ে রাজভী রায়হান শোভন নামে এক ব্যক্তির পোস্ট দেখে মনে হলো, একটা ছোটখাট প্রতিবেদন করা গেলে মন্দ হয় না। শোভনের লেখাটি –
৯০ বছর বয়সে সাইকেল চালিয়ে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া এক নারীর কথা
“আপনি যখন নারীকে দূর্বল ভাবছেন, তখন আমি প্রায় ৯৭ বছর বয়স্কা একজন নানীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। উনার নাম জহিরন বেওয়া, থাকেন লালমনিরহাটের আদিতমারী গ্রামে। উনি এই বয়সে এসেও বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন, তবে আপনাকে চমকে দেবার মত তথ্য হচ্ছে, জহিরন বেওয়া ৯০ বছর বয়সে সাইকেল চালিয়ে জনসেবার কাজ করে যাচ্ছেন, যার শুরুটা হয়েছিলো কিনা প্রায় ৪৪ বছর আগে !
জহিরন বেওয়ার ভাষ্যমতে, দেশ স্বাধীনের আগে উনার স্বামী মারা যান, তারপর উনি টানা ১০ বছর নার্সের চাকুরী করেন। চাকুরী থেকে অব্যহতি নিয়ে তিনি একটা বাই সাইকেল কিনেন, তারপর শুরু হয় নিজের গ্রামসহ আশেপাশের গ্রামের মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে চিকিৎসা সেবা দেয়া।
ভাবুন তো প্রত্যন্ত গ্রামের একজন বিধবা নারী আজ থেকে প্রায় চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর আগে সাইকেল যোগে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন, তখন আশেপাশের মানুষের কেমন চাহনী ছিলো তার প্রতি। কতটা কটাক্ষ, তিরস্কার, টিপন্নী, টিটকারি সহ্য করে উনি নিজেকে এই কাজে সঁপে দিয়েছিলেন। জহিরন বেওয়া বলেন, আমি যখন সাইকেল চালানো শুরু করি, তখন মেয়েছেলে সাইকেল চালাবে কি, গ্রামে তো সাইকেলই তেমন ছিলো না।
একটা মজার ব্যাপার হলো, উনি এখন গ্রামের সবার জাতীয় নানী। সবাই তাকে নানী বলেই ডাকে, হয়তো ছেলে দেখলে তাকে নানী বলে ডাক দেয়, ছেলের বাবাও দেখলে নানী বলে ডাকে। অনেকে আবার আদর করে উনাকে নানী বুড়ি বলে ডাকেন।
স্থানীয় লোকজন বলেন, আমাদের এই অঞ্চলে সবাই নানী বুড়ি বললে জহিরন বেওয়াকে এক নামে চিনে, এমনকি আমাদের এমপিরে কেউ চিনুক না চিনুক কিন্তু এই নানী বুড়িকে আশেপাশের সব লোক এক নামে চিনে।
নানীকে ভালোবেসে অনেকে পরামর্শ দেয়, ‘নানী তোমার বয়স হইছে, এখন সাইকেল চালানো বাদ দেও, বাড়ি বাড়ি যাওয়া বাদ দেও, রাস্তা ঘাটে কখন কি ঘটে যায় কে জানে’।
নানী নাকি বাদ দিতে পারে না, উনার একটা অভ্যাস হয়ে গেছে। ইস্ কি সুন্দর পবিত্র এক অভ্যাস। সকাল হলেই উনি ক’টা ভাত মুখে তুলে সাইকেল নিয়ে বের হয়ে যান। তারপর, আশেপাশের গ্রামের সবার খোঁজ খবর নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেন। নানী যদি কখনো নিজে অসুস্থ থাকেন, উনার খোঁজখবর নিতে উনার নিজের বাড়িতে লোকজনের ঢল নামে।
আমরা হয়তো বইতে পড়েছি বেগম রোকেয়ার, মাদার তেরেসার, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের কথা- কিন্তু এমন অন্তরালে লুকিয়ে থাকা নানীদের অবদান তাদের চেয়ে কোন অংশে কম নয়।। কেউ তার কাজের ব্যপ্তি নিয়ে দীপ্তি ছড়িয়েছেন, কেউবা নানীর মত ছোট্ট পরিসরের আলোকিত সেবক।
তুমি বোকামানব নিজের মায়ের কোল থেকে গা ঝাঁকি দিয়ে উঠে নারীকে দূর্বল বলতে থাকো, আমি বরং এই ফাঁকে নানীকে একটা রাজকীয় স্যালুট দেই।”