খুব সম্ভবত ২০১৫’র দিকে ডাবস্ম্যাশ নামে একটা ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপ খুব জনপ্রিয় হয়। বিভিন্ন সিনেমার হিট হওয়া যত ডায়ালগ আর নানানরকম অদ্ভুত অদ্ভুত গানের সাথে লিপ সিঙ্ক করে মেয়েরা ভিডিও আপলোড দিত। কিছু ট্রল পেজ সেই ভিডিওগুলো ডাবস্ম্যাশ থেকে কপি করে নিজেদের পেজে পোস্ট করা শুরু করলো। পরে জানলাম, এটা চুরি নয়। এভাবেই নাকি তারা ডাবস্ম্যাশ ইউজারদের আইডি প্রমোট করে ফলোয়ার বাড়িয়ে দেয়। সেই সময়টা আমি ফেসবুকে আসতাম শুধুমাত্র আমার প্রজেক্টের কাজে। নিজের ভেরিফাইড পেইজ থেকে দু’চারটা পোস্ট দিতাম। এর বাইরে অনলাইনে আমার আর কোনো অ্যাক্টিভিটি ছিলো না। এখনো নেই। মাঝে বেশ কয়েকদিন মিউজিক্যালি, টিকটক, ভিগো নিয়ে মানুষকে হাসিঠাট্টা করত দেখলাম। আমিও বিদ্রুপ করলাম।
তবে আমি এটা নিয়ে হাসিঠাট্টা করলেও শুরু থেকেই একটা বিষয় আমার মাথায় ছিলো। সেটা হচ্ছে, যেভাবে আমরা এসব অ্যাপ ইউজারদেরকে নিয়ে ঠাট্টা রসিকতা করছি, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদেরকে প্রতিবন্ধীও বলে ফেলছি (প্রতিবন্ধী শব্দটি ব্যবহার করার জন্য দুঃখিত)। আসলে অতটাও তাচ্ছিল্য করার মত জিনিস নয় এই প্লাটফর্মগুলো !
কিভাবে? বুঝিয়ে বলি…
আমি এক মেয়েকে চিনি, যার জীবন একরকম চার দেয়ালের মাঝেই সীমাবদ্ধ। হাতে ফোন আছে। সিড়ির এক কোণে বসে সারাদিন ভিডিও বানায়। কি করবে সে? কি করার আছে তার? সারাদিন বসে বসে বিভিন্ন গানের সাথে ঠোঁট মেলাতে মেলাতে কোনোরকমে তার সময় কেটে যায়…
কিছুদিন আগে সেই মেয়ের বিয়ে হলো। বাপের বাড়িতে ফিরে ঘন্টাখানেক পরই সে ওই সিড়িতে গিয়ে বসে পরেছে ভিডিও বানানোর জন্য। আগের মত দশ বারোটা না, মাত্র একটা ?
… স্মৃতিচারণ করছিলো আরকি। এক মুহূর্তের জন্য ফিরে যেতে চাচ্ছিলো সেই পুরনো দিনগুলোয়।
এটাকে কি আপনি খারাপ বলবেন?
সমস্যাটা হচ্ছে, কেউ কেউ এই প্লাটফর্মগুলোকে নেশায় পরিণত করে ফেলেছ। কেউ সময় কাটাতে এসব ভিডিও শেয়ারিং প্লাটফর্মগুলো ব্যবহার করে। আর কেউ ব্যবহার করে তাদের শখের কাজগুলোরে (নাচ, গান, অভিনয়) আরেকটু জনপ্রিয়তার ছোঁয়া পাইয়ে দেয়ার জন্য…
বাইরের দেশের জন্য এই প্লাটফর্মগুলো খুব গোছানো প্লাটফর্ম হলেও আমাদের বাংলাদেশিদের জন্য বেশ অগোছালো। ভারতেও অগোছালো…
…এটা সত্য যে, বাংলাদেশের অধিকাংশ মেয়েরাই ইন্ডিয়ার কিছু টিকটক, ভিগো স্টারদের এক্টিভিটিজ ফলো করে। তারাও চেষ্টা করে ওদের মত হবার। কিন্তু আমাদের দেশের পরিবেশ এবং সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে সেটা সম্ভব নয়। আপনি কলকাতায় গেলে দেখবেন, সেখানকার মেয়েদের ওড়না ব্যবহার করার প্রয়োজন পরেনা। তারা ওড়না ছাড়াই পথেঘাটে চলাচল করেন। আবার ভারানসিতে তার উল্টো। অতএব চাইলেই সবার মত হওয়া যায় না। এবং সবার মত হতে চাওয়াটাও একেবারেই উচিত নয়…
…একটা সময় এই ফেসবুকটাও এরকমই ছিলো। মানুষ হাই হ্যালো লিখে পোস্ট দিত। সকাল বিকাল গুডমর্নিং গুডইভনিং, আর রাত হলেই গুড নাইট সুইট ড্রিমস। ৮-৯ সালের সেই সময়টা আমরা দেখেছি। মানুষকে বুঝিয়েছি, ফেসবুককে কতরকমভাবে ব্যবহার করা যায়। আরিফ আর হোসেন ভাই, আপেল মাহমুদ ভাই, রাসায়াত রহমান জিকো ভাই, অমি রহমান পিয়াল, দূর্যোধন, সিডাটিভ হিপনোটিকস, ডাক্তার আইজু ইনারা ফেসবুকের কয়েকজন অতীব পরিচিত মুখ, সেসময় তাদের রাজত্ব চলছিলো ফেসবুকে। শুরুতে যার নাম বললাম, ওই আরিফ সাহেবের মাধ্যমেই ফেসবুকে গঠনমূলক কাজগুলো শুরু হয়। মানুষ হাই হ্যালো হাউ আর ইউ বাদ দিয়ে সমাজের নানান অসংগতি নিয়ে লেখা শুরু করে। আখতারুজ্জামান আজাদ লিখলো কবিতা। সাদাত হোসেন সহ আরো অনেকেই মেধার ফলন খাটিয়ে হয়ে গেলেন মেধাবী নির্মাতা। রাসায়াত রহমান জিকো ভাই নিয়মিত বই লিখছেন (ভাই একজন টিকটক ইউজার 😛 )। একুয়া রেজিয়া, রাখী নাহিদ আপাদের বইও নিয়মিত উপহার পাচ্ছি মেয়ে ফ্যানদের কাছ থেকে। কত সুন্দর একটা প্লাটফর্ম। এখনকার ছেলেমেয়েরা তো সাজানো গোছানো ফেসবুক পাচ্ছে…
… ঠিক এভাবেই ভিডিও শেয়ারিংয়ের জনপ্রিয় প্লাটফর্মগুলোর সদ্ববহার এদেরকে শেখাতে হবে।
সেটা কিরকম?
যারা টিকটক , মিউজিক্যালি, ভিগোর বিপক্ষে সবসময় বলে আসছেন, লিখে আসছেন; তারা নিশ্চয়ই প্রায়ই কিছু না কিছু ভালো কাজ করছেন, যেটাতে সমাজের মানুষ উপকৃত হয় বা যেটাকে সোশ্যাল ওয়ার্ক বলা যায়। হতে পারে সেটা রক্তদান করা, আপনার এলাকার একটা ছোট্ট সমস্যা ভিডিও আকারে দেখিয়ে দেয়া, রাস্তায় একজন রোজাদার রিকশাওয়ালার হাতে ইফতার তুলে দিলেন বা ঈদে কোনো এক পথশিশুর হাতে একটা নতুন জামা তুলে দিলেন, বাচ্চাটার হাসিমুখের একটা পনেরো সেকেন্ডের ভিডিও…
…ঢাকার পরিবেশ রক্ষার্থে রাস্তার পাশে পরে থাকা একটা প্লাস্টিকের বোতল বা চিপসের প্যাকেট কুড়ানো।
অথবা বাজারে পলিথিন ব্যাগে সদাই না নেয়া, এবং দোকানদারকে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করতে নিষেধ করা…
পনেরো বিশ সেকেন্ডের এই ছোট ছোট ভিডিওগুলো আমাদের দেশটাকে বদলে দিতে পারে। আমরা আমাদের নতুন প্রজন্মকে যদি শুধু হাসিঠাট্টা আর অবহেলা অবজ্ঞাই দিয়ে যাই, তাহলে ওরা শিখবে কোত্থেকে? বুঝবে কিভাবে কোনটা মানবপ্রীতি আর কোনটা দেশপ্রেম? দেশটাই বা কিভাবে এগোবে তখন?
… কেউ ভুল করলে ভুলগুলো শুধরে দিন। নিজের জন্য বাঁচার চিন্তা না করে পুরো দুনিয়াটার কথা ভাবুন। আপনার চিন্তাচেতনার আয়তনটা যখন বড় হবে, অনেক কিছু করতে পারবেন তখন। অনেক কিছু…