২০১৩ সালে, খুব সম্ভবত সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে। দেশের অবস্থা তখন ভয়াবহ রকমের খারাপ। দিনশেষে একটু ফেসবুকে এসেই সুখের দেখা মিলত। সেই ফেসবুক নিউজফিডটাও দখল করে নিয়েছিলো খুনের খবর, রাজনৈতিক আলোচনা এবং ‘মুক্তি চাই-ফাঁসি চাই’ জাতীয় পোস্টগুলো ! গণজাগরণ মঞ্চ, নাস্তিক হত্যা, জাতীয় নির্বাচন, জামাত নেতাদের ফাঁসি; সবমিলিয়ে দেশ একটা ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলো। ঠিক সেসময়ই শিহাব শাহীনের পরিচালনায় তাহসান ভাই অভিনিত “নীলপরী নীলাঞ্জনা” নামে একটা টেলিফিল্ম খুবই জনপ্রিয়তা পায়। চারিদিকে এই নাটকের নামডাক। এমনকি ফেসবুকেও মাত্রা ছাড়িয়ে বাড়তে থাকে নীলপরী নীলাঞ্জনাদের ভীড়। একটা ছবি, একটা নাম, কয়েকহাজার একাউন্ট…
ফেসবুকে তখন নীলপরী নীলাঞ্জনা নামে কম করে হলেও ১০হাজার আইডি ওপেন হয়েছিলো। অনেকে আবার তাদের নিজেদের আইডির নাম পাল্টেও নীলপরী নীলাঞ্জনা রেখে দিয়েছিলো। সাথে একটা প্রোফাইল পিক !
এই কয়েকহাজার নীলপরী নীলাঞ্জনাদের মধ্য থেকে একজন নীলপরী নীলাঞ্জনা আমাকে ম্যাসেজ দিয়েছিলো। কথোপকথনটা কিভাবে শুরু হয়েছিলো আমার মনে নেই। সেসময় আমার একটা বদভ্যাস ছিলো, আমি কোনো মেয়ের রিকুয়েস্ট অ্যাক্সেপ্ট করতাম না, সহজে কোনো মেয়ের সাথে কথাও বলতাম না। কিভাবে যেনো এই মেয়েটা ফ্রেন্ডলিস্টে জায়গা পেয়ে গেছিলো…
… এই মেয়েকে নিয়ে আমি কখনোই প্রেমভালোবাসা টাইপের কোনো ভাবনার মধ্যে জড়াইনি। একদমই অতি সাধারণ সম্পর্ক ! ফেসবুকের অনেক মেয়ের সাথেই এরকম সাধারণ সম্পর্ক রয়েছে আমার। তবে চারপাশে এত মানুষের ভিড়ে এই একজনকে মনে রাখারও কিছু কারণ আছে !
এই মেয়েটা ছিলো একটু পাগল টাইপের। পাগল মানে কথার কথায় পাগল না। একদমই অদ্ভুত রকমের পাগলাটে ধরণের মানুষ। নাটকের নীলপরী নীলাঞ্জনাকে নিয়ে মানুষের মাঝে যতটা আবেগ সৃষ্টি হয়েছে, এই নীলপরী নীলাঞ্জনাকে বিশেষ কিছু ভাবার জন্যও ততটা আবেগ আমি খুঁজে পেলাম। মায়া লাগত, এত দারুণ একটা মেয়ে। অথচ সামান্য কিছু প্রতিবন্ধকতার কারণে মানসিক রোগী হিসেবে সবাই তাকে ট্রিট করে। এমনকি আমাদের সার্কেলের সবাই, আমি, সাদিকুল, কুয়াশা, মৃন্ময়, মারুফ, আমাদের প্রত্যেকেরই অত্যন্ত কাছের মানুষ হয়ে গিয়েছিলো সে। আমার আসলে অনেক কিছুই মনে নেই। যতটুকু মনে পড়ে, বলি…
১৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে কোনো একদিন শীতের রাতে আমি আমার দলবল নিয়ে ছারপোকা প্রজেক্টের শীতবস্ত্র বিতরণে নেমেছি, ট্রাকের পিঠে চড়ে ঢাকার বাইরে কোনো জেলায় দরিদ্র হাড্ডিসার মুরব্বি খুঁজে বেড়াচ্ছে, যে কিনা শীতবস্ত্রের অভাবে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে। এমন মানুষের দেখা না পাওয়া গেলেও কিছুক্ষণ পরপর ফোনের স্ক্রিনে ঠিকই এই নীলপরী নীলাঞ্জনার দেখা পাওয়া যেত। ঘন্টা না পেরোতেই সে ফোন দিয়ে বলতো, ঠিকঠাক মত ভারী জামাকাপড় পরে নেমেছি কিনা, কম্বল সবগুলো বিতরণ করা শেষ হয়েছে কিনা, ট্রাকের পেছনে না গিয়ে যেনো সামনের সিটে বসি। এইসব হাবিজাবি…
… শৈশবে কখনো প্রেম করা হয়নি বলে এই ব্যাপারগুলো বেশ উপভোগ করতাম। তবে তার প্রতি বন্ধুসূচক সম্মানই ছিলো সবসময়।
সে প্রায়ই ফোন করে কান্নাকাটি করত। আমরা কেউ কোনোদিন কারণও জিজ্ঞেস করিনি। ধরেই নিয়েছিলাম, একটা পাগল মানুষ এমন করতেই পারে। পাত্তা দেয়ার কিছু নেই…
… তিন জানুয়ারী আমার জন্মদিন। প্রতিবছর এই দিনে আমি সবকিছু থেকে দুরে থাকি, সবার কাছ থেকে নিরুদ্দেশ থাকি। যোগাযোগের কোনো মাধ্যমই সচল রাখিনা। তিন জানুয়ারী আমাকে না পেয়ে সে হতাশ হয়েছিলো। এর দুদিন পর সে আমাকে ফোনে রিচ করতে পারলো।
দিনটা ছিলো নির্বাচনের দিন, জাতীয় নির্বাচন। জানুয়ারীর ৫ তারিখ, সকাল নয়টা। ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে আমি বাসার নিচে দাঁড়িয়ে পায়চারি করছি। এরমধ্যে নীলপরী নীলাঞ্জনা’র ফোন আসলো। প্রথমেই কান্নাকাটি। আমি ধমক দিলাম। সে কান্না থামিয়ে বললো, “শুভ জন্মদিন।” আমি বললাম, “ওকে” !
ভেবেছিলাম এত ছোট্ট উত্তর পেয়ে সে হতাশ হবে। হতাশ হয়নি। সে সাথে সাথেই এ প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে বললো, “নিপু ভাই আমি আর আপনাদের কাউকে বিরক্ত করবোনা। পৃথিবীর সবচেয়ে ‘অসহায়’ প্রাণী হচ্ছে মানসিক অসুস্থতায় ভোগা মানুষেরা। এদের মত ভালো শ্রোতা আপনি আর কোথাও পাবেন না। চলে যাই নিপু ভাই। ভালো থাকবেন।”
… এখানেই শেষ। এরপর আর কোনোদিন ওই নীলপরী নীলাঞ্জনার দেখা পাওয়া যায়নি। আমার ফোনে গতবছরেও (২০১৮) তার নম্বর সেভ করা ছিলো। এই ৫ বছরে সবমিলিয়ে ৭ বার ট্রাই করেও কোনোদিন আর ওই নম্বর খোলা পাইনি। এমনকি খোঁজখবর নেয়ার কোনো উপায়ও নেই। না থাকুক। থাকতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। তবে মাঝে মাঝে ফেলে আসা সেইসব দিনগুলোর আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে থাকা নিখোঁজ সেই মানুষগুলোকে একবার দেখতে ইচ্ছে হয়। নরম, মিনমিনে গলায় জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়, “কেমন আছো?”
… ঠিক যেমনটা আমরা প্রায়ই ইনবক্সে কারো না কারো সাথে করি। কিন্তু কখনো বুঝতেই পারিনা, গলার স্বর মিনমিনে হয়ে যাচ্ছে !
তাহলে আমাদের হারিয়ে যাওয়া সেসব নীলপরী নীলাঞ্জনারা কোথায়? তারা কি আজো বেঁচে আছে? যদি বেঁচে থাকে, তাহলে কি এই হারিয়ে যাওয়া নীলপরী নীলাঞ্জনারা আমাদের ফলোয়ার হয়েই থাকে? আর যদি মারা যায়, তাহলে রেস্ট ইন পিস, মে গড ব্লেস হার সোল ! মেয়েরা মারা যাবার পর শুধু ‘ফলোয়ার’ হয়ে থাকে। কেউ আর তাদের ফলোয়ার হয়না। বন্ধুবান্ধবরাও কষ্ট পাবার ভয়ে আনফ্রেন্ড/আনফলো করে রাখে। তাদের আইডি কেবল সবার ফলোয়ার লিস্টেই থাকে, ফলোয়িং লিস্টে আর খুব একটা থাকেনা।
… এই মেয়েরা জীবিত থাকলে কি হয়? নীলপরী নীলাঞ্জনা হয়? আমাদের সবার জীবনেই নিশ্চয়ই এমন কোনো নীলপরী নীলাঞ্জনা এসেছে, যাদের সাথে আমাদের খুব ভালো দিনগুলো কেটেছে। ব্যাপারটা তখন না বুঝলেও এখন ঠিকই বুঝতে পারি। এই নীলপরী নীলাঞ্জনারা এখন কোথায় আছে? যেখানেই থাকুক, আমাদের কথাও ঠিকই এভাবেই ভাবে তো?
এটি একটি অপ্রকাশিত নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি