বিদেশ ভ্রমণে ইদানিং অনেকেই এয়ারপোর্টে এবং বিদেশের ইমিগ্রেশনে নানাবিধ ঝামেলার মুখোমুখি হন। মালয়েশিয়া বা উন্নত বিশ্বের কয়েকটি দেশে ট্যুরিস্ট হিসেবে ঘুরতে গেলে ইমিগ্রেশনে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদেরকে প্রায়ই সন্দেহের চোখে দেখা হয়। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ডিপোর্ট করে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়। এতে শুধুমাত্র আপনার ট্যুরটাই নষ্ট হচ্ছেনা, একইসাথে আপনার ট্যুরের বিমান ভাড়ার টাকাও নষ্ট হচ্ছে, রিজেক্ট হয়ে ফেরত আসায় আপনার পাসপোর্টের মূল্যায়নও কমছে। অথচ আমরা একটু সতর্ক থাকলেই ইমিগ্রেশন অফিসারদের এই চোখ রাঙ্গানি এবং অপ্রত্যাশিত হয়রানি থেকে বাঁচতে পারি।
চলুন তাহলে বিদেশের এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশনের ঝামেলা থেকে বাঁচতে করণীয় কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক…
এখানে উদাহরণ হিসেবে আমরা মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশনের কথা দিয়েই বিষয়টা সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছি। ধরুন আপনি বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন ঠিকঠাকভাবে পার হয়ে প্লেন জার্নি শেষে মালয়েশিয়ান এয়ারপোর্টে গিয়ে পৌঁছালেন। এখন মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন পার হওয়াটাই আপনার কাছে একমাত্র চ্যালেঞ্জিং বিষয়। আমরা জানি, ট্যুরের ভ্যালিড কাগজপত্র থাকা স্বত্বেও বর্তমানে মালয়েশিয়া এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন থেকে অনেক বাংলাদেশিদেরকে মালয়েশিয়ায় ঢুকতে না দিয়ে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়। অনেককে আবার প্রচুর জিজ্ঞাসাবাদ করে তারপর মালয়েশিয়ায় ঢুকতে দেয়া হয়। আবার অনেকেই আছেন, খুব স্মুথলি কোনো ঝামেলার সম্মুখীন হওয়া ছাড়াই ইমিগ্রেশন কম্পলিট করতে পারেন। এই বৈষম্যটা তাহলে কিসের? কেনো এমনটা হয়?
একজন ইমিগ্রেশন অফিসারের কাছে যখন মনে হবে আপনাকে তার দেশে ঢুকতে দেয়াটা তার জন্য সঠিক নয়, শুধুমাত্র তখনই সে আপনাকে এন্ট্রি না দিয়ে ইমিগ্রেশনে আটকে দিবে।
আপনি যখন মালয়েশিয়া যাবার ভিসা পান, তখন থেকেই আপনাকে প্রস্তুত হতে হবে আপনার ট্যুরের জন্য। ভিসা করার সময় আপনাকে নিশ্চয়ই প্লেনের রিটার্ন টিকেট বুকিং ও হোটেল বুকিংয়ের কপি জমা দিতে হয়েছে। এই হোটেল বুকিংয়ের ডকুমেন্টস নিয়ে আপনি যখন মালয়েশিয়া যাবেন, ইমিগ্রেশন অফিসার তখন দেখবে এই বুকিংটা ঠিক আছে কিনা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, আমরা অনলাইনে যেসব হোটেল বুক করছি, সেগুলো আমরা টাকা দিয়ে নিশ্চিতভাবে বুক করিনা। ফলে কিছুদিন পর হোটেল কর্তৃপক্ষরা রুমটি অন্যদেরকে দিয়ে দেয়। আপনার বুকিংটা আর তখন লাইভ থাকেনা। ইমিগ্রেশন অফিসার তখন দেখতে পাবে আপনার বুকিংটি লাইভ নেই। বাতিল হয়ে গেছে। ফলে সে ভাববে, আপনি একজন ট্যুরিস্ট হয়েও থাকার জায়গা ঠিক করে আসেননি। অতএব আপনাকে মালয়েশিয়ায় ঢুকতে দেয়া তার জন্য নিরাপদ না ! তাই অবশ্যই ট্যুরের জন্য ভ্যালিড হোটেল বুকিং নিয়ে তারপরই আপনি বিমানে উঠবেন। একইসাথে অবশ্যই আপনি রিটার্ন টিকেট করে তারপর প্লেনে উঠবেন। কারণ একজন ট্যুরিস্ট কোনোভাবেই ওয়ান ওয়ে টিকেট নিয়ে বিদেশ ভ্রমণে যেতে পারেনা। এটা এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশনের রুলসে নেই। তাই ট্যুরিস্ট হলে আপনাকে রিটার্ন টিকেট কাটতেই হবে।
দ্বিতীয়ত, ইমিগ্রেশন অফিসার ভাবতে পারেন আপনি হয়ত মালয়েশিয়ায় ট্যুরিস্ট হিসেবে গিয়ে থেকে যাবেন, দেশে ফিরবেন না, সেখানে গিয়ে জব খুঁজবেন। ইমিগ্রেশন অফিসার যাতে এমনটা না ভাবেন, তার জন্য আপনার করণীয় হচ্ছে, আপনাকে প্রমাণ করতে হবে আপনি আর্থিকভাবে স্বচ্ছল। আপনার ভালো একটা চাকরী বা ব্যবসা আছে। এবং ট্যুর শেষে আপনি বাংলাদেশে ঠিকই ফিরে আসবেন। কিভাবে প্রমাণ করবেন এটা?
নিজেকে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল প্রমাণ করার দুটো উপায় আছে। প্রথমত, আপনি যদি ভালো চাকরীজীবি হয়ে থাকেন বা ব্যবসায়ী হয়ে থাকেন, তাহলে অবশ্যই আপনার কাছে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবহারযোগ্য ক্রেডিট কার্ড রয়েছে। এই ক্রেডিটকার্ড থাকলে যেকোনো দেশের ইমিগ্রেশন অফিসাররাই বুঝে নিবে আপনি আর্থিকভাবে স্বচ্ছল। আপনি অবশ্যই ব্যাংক থেকে এই ক্রেডিট কার্ডটি পাসপোর্টে এনডোর্স করে নিবেন। একটা ক্রেডিট কার্ডে আপনি ১হাজার থেকে ৩হাজার বা তারও বেশি ডলার এনডোর্স করে নিতে পারেন।
আর যদি আপনার কাছে ক্রেডিট কার্ড না থাকে, তাহলে অবশ্যই আপনার সাথে পর্যাপ্ত পরিমাণ ডলার থাকতে হবে। এবং অবশ্যই ট্যুরে যাবার সময় ব্যাংক থেকে এই ডলারের এনডোর্সমেন্ট পেপার সংগ্রহ করে সাথে নিয়ে যাবেন। ইমিগ্রেশন অফিসার যখন দেখবে, আপনার কাছে মালয়েশিয়ায় কিছুদিন থাকার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা আছে, তখন সে আপনাকে তার দেশে ঢুকতে দেয়ার ভরসা পাবে।
ইমিগ্রেশনের ঝামেলা পোহাতে ক্রেডিটকার্ড, এনডোর্সমেন্টের পাশাপাশি আপনি আরো কিছু সাপোর্টিং ডকুমেন্টস সাথে করে নিয়ে যেতে পারেন। আপনি যদি চাকুরীজীবি হন তাহলে অবশ্যই আপনার আইডি কার্ড সাথে রাখবেন। আর ব্যবসায়ী হলে অবশ্যই আপনার প্রতিষ্ঠানের ভিজিটিং কার্ড সাথে রাখবেন। আপনি ব্যাংকের যে স্টেটমেন্ট দিয়ে ভিসা করেছেন, তার একটি ফটোকপিও আপনি সাথে রাখতে পারেন। একইসাথে আরেকটা জিনিস রেডি রাখতে হবে, সেটা হচ্ছে ট্যুর প্লান। আপনি মালয়েশিয়ায় গিয়ে কোন কোন জায়গায় ঘুরতে চাচ্ছেন বা কত তারিখে কোন জায়গায় ঘুরবেন, তা সুন্দর করে সাজিয়ে একটা কাগজে লিখে নিন। আপনি যে সত্যিই ট্যুরে যাচ্ছেন, এটা বুঝানোর জন্য এ কাগজটি আপনাকে অনেক সহায়তা করবে।
এই ডকুমেন্টসগুলো সাথে থাকার পর ইমিগ্রেশন অফিসার যদি আপনাকে তার দেশে এন্ট্রি না দেয়, তখন আপনি তাকে ভদ্রভাবে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলতে পারবেন, আপনার কাছে এই ট্যুরের জন্য প্রয়োজনীয় সব ডকুমেন্টস আছে এবং সে আপনাকে এন্ট্রি দিতে বাধ্য !
সবকিছু ঠিকঠাক করে যখন আপনি মালয়েশিয়ার এয়ারপোর্টে গিয়ে পৌঁছেছেন, এখন আপনার একমাত্র কাজ হচ্ছে ইমিগ্রেশন পার হওয়া। এখানে আপনাকে স্ট্রং থাকতে হবে। আপনি মোটেও নার্ভাস হতে পারবেন না। কারণ আপনি তাদের অতিথি। আপনি নিশ্চয়ই চুরি ডাকাতি করতে যাননি? তারা আপনাকে মারধরও করবেনা। ধরে বেঁধেও রাখবেনা। তাহলে কেনো নার্ভাস হবেন !
ইমিগ্রেশন অফিসারের মুখোমুখি হওয়ার পর ঠিকঠাকভাবে তার সব প্রশ্নের উত্তর দিবেন। কোনো কারণে সে যদি আপনাকে সন্দেহ করে এন্ট্রি না দেয়, তাহলে আপনি ফেরত আসার প্রস্তুতি না নিয়ে তাকে বলবেন, “আপনি আমাকে ডিপোর্ট করার আগে আমি আপনাদের হেড অফিসারের সাথে কথা বলতে চাই – Before you deport me, I want to talk with your immigration head officer” !
এই সিদ্ধান্তে আপনাকে অনড় থাকতেই হবে যে, আপনি হেড অফিসারের সাথে কথা না বলে কোনোভাবেই ফেরত চলে আসবেন না।
সবচেয়ে বড় যে বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে, সেটা হচ্ছে আপনার একটিভিটি,আপনার আচার আচরণ। মনে রাখবেন, প্লেন থেকে নেমে ইমিগ্রেশনে আসার পুরোটা সময় জুড়েও আপনার গতিবিধি লক্ষ্য করা হচ্ছে। আপনি যেহেতু ট্যুরিস্ট হিসেবে যাচ্ছেন, পরিবারের সাথে গেলে পরিবারের সাথেই থাকুন। একা গেলে একাই বসে থাকুন। অন্য কারো সাথে কথা বলবেন না। যখনই আপনি অন্য কোনো যাত্রীর সাথে কথা বলবেন, তখনই তারা আপনাকে সন্দেহ করে বসবে। সবসময় চেষ্টা করবেন অন্য ক্যাটাগরির ভিসার যাত্রীদের সাথে কোনোরকম কথা বলা বা আলাপ আলোচনা না করার। নিজের মত নিজে বসে থাকুন, লাইনে দাঁড়ান বা অপেক্ষা করুন। অন্য কারো সাথে কথা বলে বা সহায়তা নিয়ে সন্দেহের ভুলেও চোখে পরতে যাবেন না।
উপরের সবগুলো নিয়ম অনুসরণ করলে পৃথিবীর কোনো দেশের এয়ারপোর্টে, কোনো ইমিগ্রেশনেই আপনাকে ঝামেলায় পরতে হবেনা। পোস্টটি শেয়ার করে অন্যদের উপকৃত করতে পারেন। ধন্যবাদ…
আরো পড়ুনঃ