ভারতীয় ইতিহাসের প্রথম ক্রসফায়ারের মাধ্যমে সন্ত্রাসী হত্যার ঘটনা সংঘটিত হয় ১১ জানুয়ারী, ১৯৮২ সালে। সেদিনের ক্রসফায়ারে খুন হওয়া সন্ত্রাসী’র নাম ছিলো মনোহর অর্জুন সুরভে ওরফে মানিয়া সুরভে !
১৯৪৪ সালে জন্মগ্রহণ করা মনোহর মুম্বাই শহরে (তৎকালীন বোম্বে) পদার্পণ করে ৮ বছর বয়সে, ১৯৫২ সালে। সৎ বাবা ও মায়ের হাত ধরে সেদিন বোম্বে’র মাটিতে পা রাখা নিষ্পাপ মনোহর যে একদিন হয়ে উঠবে বোম্বের সবচেয়ে বড় ত্রাস তা সেদিন হয়ত খোদ বিধাতা ছাড়া আর কেউ আঁচ করতে পারেনি। পিতার দারিদ্রতার কারনে মনোহরের ছোটবেলা কেটেছে বোম্বের বিভিন্ন বস্তিতে। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও নিজের মেধাশক্তির গুণে মনোহর বেশ ভালোভাবেই নিজের লেখাপড়া চালিয়ে নেয়, এবং ১৯৬৮ সালে কৃতী কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে। সেই সময় রেকর্ড ৭৮% নাম্বার নিয়ে পাস করা মনোহর ছিলো অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে ঈর্ষণীয়। তার চাল-চলন এবং লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রিয়পাত্র ছিলো মনোহর অর্জুন সুরভে।
সময়টা ১৯৬৯, লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে মনোহর তখন একটা ভদ্র চাকরীর আশায় দিন গুনছে। এই সময় হঠাৎ কপালের ফেরে উল্টোপথে ঘুরে যায় তার জীবনের চাকা। দাউদ ইব্রাহীমের প্রভাবের কারণে কিংবা তার সাফল্যের প্রতি লোভের বশে, যাই হোক না কেনো তৎকালীন বোম্বে’র অশিক্ষিত কিংবা অর্ধশিক্ষিত যুবকদের চোখ ছিলো গ্যাংস্টার হবার স্বপ্নে বিভোর। সেরকমই এক উঠতি মাস্তান ছিলো মনোহরের সৎ ভাই ভার্গব। ঘটনাক্রমে ভার্গবের হাতে খুন হয় আরেক উঠতি মাস্তান, যার দায় সমভাবে চাপে দুই ভাই ভার্গব এবং মনোহরের কাঁধে। আদালত দু’জনকেই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেয়। শিক্ষিত মার্জিত মনোহর হয়ে গেলো খুনের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত দাগী আসামী। মনোহরের তিলে তিলে সাজানো গুছানো জীবন যেনো লণ্ডভণ্ড হয়ে গেলো এক হঠাৎ-ঝড়ে। বোম্বের বস্তি থেকে তার স্থান হলো পুনে’র ইয়ারওয়াদা সেন্ট্রাল জেলে।
ইয়ারওয়াদা জেলে তখন কারাবাস করছিলো বোম্বের উল্লেখযোগ্য এক সন্ত্রাসী সুভাষ ভাটকার, ওরফে পোটিয়া ভাই। বিভিন্ন সময়ে ছোট-ছোট কিছু ঘটনার জের ধরে সুভাষের সাথে দ্বন্দ্ব বেঁধে যায় মনোহরের। যার ফলে জেল কর্তৃপক্ষ মনোহরকে রত্নাগিরি জেলে স্থানান্তর করতে বাধ্য হয়। বিষয়টা মেনে নিতে পারেনি মনোহর। সে রত্নাগিরি জেলে অনশন করতে শুরু করে এবং একসময় অসুস্থতাজনিত কারণে প্রায় ২০ কেজি ওজন কমে যায় তার। কারা-কর্তৃপক্ষ তাকে স্থানীয় সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করতে বাধ্য হয়। এই সুযোগটা যথার্থ কাজে লাগায় মনোহর। ১৯৭৯ সালের ১৪ নভেম্বর প্রায় ৯ বছর কারাবাসের পর পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় সে।
জেল থেকে পালিয়ে সরাসরি বোম্বেতে চলে যায় মনোহর। তবে ততদিনে তার পূর্বের জীবনে ফিরে যাবার সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। একে তো দাগী আসামী, তার উপর আবার জেল থেকে পলাতক। সুস্থ্যভাবে জীবনযাপন করা তখন একেবারেই অসম্ভব মনোহরের পক্ষে। বাধ্য হয়ে সে সিদ্ধান্ত নিলো বিপথগামী হবার। বিপথে যাওয়া যখন নিশ্চিত, তখন এই পথের একেবারে শীর্ষে পৌঁছানোর জেদ চেপে গেলো মনোহরের মাথায়। ইয়ারওয়াদা জেলে পরিচয় হওয়া শেখ মুনির এবং বিষ্ণু পাতিলকে সঙ্গে নিয়ে নিজেদের একটা গ্যাং বানিয়ে ফেললো মনোহর। পরে তাদের সাথে যোগদান করে শ্যুটার উদয়।
মনোহরের গ্যাংয়ের প্রথম অপারেশন ছিলো ডাকাতি। ১৯৮০ সালের ৫ এপ্রিল তারা একটি এ্যাম্বাসেডর গাড়ি চুরি করে, এবং সেই গাড়ি ব্যবহার করে লক্ষী ট্রেডিং কোম্পানির অফিস থেকে ৫৭০০ রুপি ডাকাতি করে। এই ঘটনার ঠিক দশ দিন পর তারা ধারাবী বস্তিতে মুনিরের পূর্বশত্রু শেখ আজিজকে প্রচন্ড মারধর করে এবং জনসম্মুখে নিজেদের গ্যাংয়ের পরিচয় তুলে ধরে। এই সময় মনোহর নিজেকে “মানিয়া সুরভে” নামে পরিচয় দেয়। তার কিছুদিন পর ৩০ এপ্রিল তারা একজন পুলিশ অফিসার ই. এস. দাভোলকার-কে ছুরিকাঘাতে আহত করে। এই দাভোলকার-ই ১৯৬৯ সালে খুনের দায়ে মনোহর এবং তার ভাই ভার্গবকে অ্যারেস্ট করেছিলো।
কারাবাসের সময় জেমস্ হ্যাডলি চেজের বেশ কিছু উপন্যাস পড়েছিলো মনোহর। সেখান থেকেই আইডিয়া নিয়ে ডাকাতি করতে শুরু করে সে। রাস্তা থেকে প্রথমে সুবিধামত একটা গাড়ি চুরি করা হয়, এবং পরে সেই গাড়িই ব্যবহার করা হয় ডাকাতির কাজে। কাজ শেষে ব্যবহৃত গাড়ি ফেলে দেয়া হত নির্জন কোনো রাস্তায়। এভাবেই মানিয়া গ্যাং একে একে ডাকাতি করে সরকারি দুগ্ধাগার, কান্নাড়া ব্যাংক আর ডিউক অ্যান্ড সন্স কোম্পানিতে। এসব ডাকাতিতে প্রায় ৫ লাখ রুপি হস্তগত করে তারা। এত অল্প সময়ে এরকম বড় বড় ডাকাতির কারণে বোম্বে আন্ডারওয়ার্ল্ড এবং পুলিশের নজরে চলে আসে মানিয়া গ্যাং।
ওদিকে মানিয়া ডাকাতি ছাড়াও স্মাগলিং, মাদক পরিবহন এবং চাঁদাবাজিও শুরু করে দেয়। এতে করে দ্রুত তার নাম ছড়িয়ে পরে সবখানে। শিক্ষিত এবং তুখোড় বুদ্ধির কারণে মাফিয়া লিডারদের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে তার।
১৯৮১ সালে দাউদ ইব্রাহীমের বড় ভাই শাবির ইব্রাহীম খুন হওয়ার পর বোম্বের আন্ডারওয়ার্ল্ডে অস্থিতিশীলতা শুরু হয়ে যায়। দাউদের নির্দেশে সন্দেহভাজন সব মাফিয়া লিডাররা খুন হতে শুরু করে। শাবিরের খুনের সাথে সরাসরি যুক্ত থাকা পাঠান গ্যাংয়ের সাথে সখ্যতা ছিলো মানিয়ার। সুতরাং দাউদের তীর মানিয়ার উপরও তাক করা ছিলো। এই অবস্থায় কল্যানের কাছাকাছি এক রাসায়নিক কারখানায় চাঁদা তুলতে গিয়ে গ্রেফতার হয় মানিয়ার ডানহাত শেখ মুনির। ওদিকে বিষ্ণু এবং উদয়ও পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলে গা-ঢাকা দেয় মানিয়া। তখন শুধু পুলিশের নয়, দাউদের শিকার হওয়ারও ভয় ছিলো তার।
মানিয়া ভেবেছিলো পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে আবার সবকিছু গুছিয়ে নিবে সে। কিন্তু শেষ সময়ে অঙ্কের হিসেবে কিছুটা গড়মিল করে ফেলেছিলো সে। বোম্বে পুলিশের দুই নাছোড়বান্দা অফিসার ইসাক বাগোয়ান ও রাজা তাম্বাট ওৎ পেতে ছিলো মানিয়ার অপেক্ষায়। গর্ত থেকে বের হলেই শিকার করতে হবে মানিয়াকে। পুলিশ ডিপার্টমেন্টের উপর লেভেল এবং দাউদের চাপে তারা অপেক্ষা করছিলো সেই কাজ করার, যা ভারতবর্ষে আগে কখনো হয়নি। বিচারবিভাগের সম্মুখীন না করেই পুলিশের হাতে সরাসরি একজন সন্ত্রাসীকে হত্যা করার কথা কেউ তখন ভাবতেও পারত না।
ইসাক বাগোয়ান এবং রাজা তাম্বাট কার্যসিদ্ধির জন্যে ব্যবহার করলো মানিয়ার প্রেমিকা বিদ্যা-কে। বিদ্যার উপর নজরদারী করার ফলে তারা জানতে পারলো ১১ জানুয়ারিতে মানিয়া দেখা করবে বিদ্যার সাথে, স্থানটা নির্ধারিত হয়েছে আম্বেদকর কলেজের সামনে। প্ল্যানমত নির্ধারিত দিনে সকাল থেকেই ছদ্মবেশে ১৮ জন পুলিশ অফিসার আম্বেদকর কলেজের সামনে অবস্থান গ্রহন করে। দুপুর একটার দিকে আম্বেদকর কলেজের গেটের সামনে এসে দাঁড়ায় একটা হলুদ রঙের ট্যাক্সিক্যাব। ট্যাক্সি থেকে নেমে দাঁড়ালো মানিয়া সুরভে, লক্ষ্য খানিকটা দূরে অপেক্ষায় থাকা প্রেয়সী বিদ্যা’র দিকে। মানিয়া ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি, ততক্ষণে সে ১৮ জন অস্ত্রধারী পুলিশের লক্ষ্যবিন্দুতে পরিনত হয়ে গেছে। হঠাৎ পুলিশ অফিসার রাজা তাম্বাট তার দিকে অস্ত্র তাক করে এগিয়ে আসতে থাকে। অবস্থা বেগতিক বুঝতে পেরে মানিয়া নিজের কোমড়ে গুঁজে রাখা ওয়েম্বলি এ্যন্ড স্কট কোম্পানির রিভলভারটা বের করতে উদ্দ্যত হয়। ততক্ষণে রাজা তাম্বাট এবং ইসাক বাগোয়ানের শিকারে পরিনত হয়েছে সে। একে একে তাদের ছোঁড়া পাঁচটা গুলি মানিয়ার বুক এবং কাঁধ ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে।
পাঁচটা গুলি লাগার পরেও জীবিত ছিলো মানিয়া। ঘটনাস্থল থেকে তাকে নিকটবর্তী সিওন হাসপাতালে নেয়ার উদ্দেশ্যে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়। অ্যাম্বুলেন্সের বেডে শুয়ে মানিয়া পুলিশকে গালাগালি করতে থাকে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়নি বলে। আম্বেদকর কলেজ থেকে সিওন হাসপাতালের দুরত্ব প্রায় ১২ মিনিটের হলেও সেদিন মানিয়াকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স সময় নিয়েছিলো ৩০ মিনিট। আর সেই যাত্রাপথেই মৃত্যু হয় মানিয়া সুরভে’র।
শেষ হয় মানিয়ার দুই বছরের ত্রাসের রাজত্বের। মাত্র দুই বছরের কার্যক্রমে যে কাঁপিয়ে দিয়েছিলো বোম্বে আন্ডারওয়ার্ল্ড এবং পুলিশের হৃদপিণ্ড। কথিত আছে, ওই দুই বছরে সে দাউদ ইব্রাহীমের যতটা ক্ষতি করেছিলো তা আজ অব্দি দাউদের অন্য কোনো প্রতিপক্ষ এবং তাবৎ দুনিয়ার সমস্ত পুলিশ অফিসার মিলেও করতে পারেনি। আর তাই তো দাউদ উঠেপড়ে লেগেছিলো মানিয়াকে খতম করার কাজে, সফলও হয়েছিলো খুব দ্রুত। মানিয়া সুরভে-কে নিয়ে বলিউডে নির্মিত হয়েছে “শ্যুটআউট অ্যাট ওয়াদালা” নামের সিনেমাটি। যদিও গল্পের প্রয়োজনে সেখানে অনেক ঘটনা বদলে দেয়ার পাশাপাশি কিছু ঘটনা সংযোজনও করা হয়েছে।
মানিয়া সুরভে – ভাগ্য যাকে নিয়ে খেলেছে নিজের মর্জি মত। সহজ সরল শিক্ষার্থী থেকে যাকে তৈরী করেছে দুঃসাহসী এবং নির্মম। যার শেষটাও ছিলো একটা নতুন শুরুর ইতিহাস।
আরো পড়ুনঃ