একেক দেশের ইদ উদযাপনের ধারা একেক রকম। রমজানের ইদে আমরা বাঙ্গালীরা সাধারণত খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে সেমাই পায়েস খাই। খাওয়া শেষে পাঞ্জাবী গায়ে চাপিয়ে আতর মেখে জায়নামাজ বগলবন্দি করে ইদগাহে যাই। ইদের নামাজ শেষে ঘরে ফিরে পোলাও মাংস খাই। বাসায় টুকটাক মেহমান আসে। বাচ্চারা সালাম করলে সালামি দেই। পকেট ফাঁকা থাকলে পালিয়ে বেড়াই। এটাই আমাদের বাংলাদেশিদের ইদ উৎসব। আমাদের পরম্পরাগত আনুগত্য…
অন্য দেশের মানুষেরা কিভাবে ইদ উদযাপন করেন, সেদিকেও একটু নজর দেয়া যাক…
সাউথ এশিয়ার ইদ উৎসব
এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে কম সংখ্যক মুসলিম জাতি রয়েছে সাউথ এশিয়াতে। ইদ নিয়ে মোটামুটি উৎসাহী জাতি সাউথ এশিয়ানরা। এ তালিকায় আছে ব্রুনেই, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর।
ইদের দিন এই দেশগুলোর মুসলিম পরিবাররা মাংসের বিভিন্ন আইটেম রান্না করেন। ইন্দোনেশিয়ানরা চিকেন ব্যাম্বো রাইস, ব্যাম্বো বিরিয়ানী রান্না করে থাকেন। ইদের দিন সেমাই খেয়ে মিষ্টিমুখ করা এদের ভেতর একেবারে দেখা যায় না বললেই চলে।
বেশিরভাগ মালয়েশিয়ান মুসলিমরাই পরিবার নিয়ে ঘরের মধ্যেই ইদ উদযাপন করেন। এই দিনটিকে মালয়েশিয়ান ভাষায় হারি রায়া বলা হয়। ইদে মালয়েশিয়ার রাস্তায় রাস্তায় নানান রকমের খাবারের স্টল দেখা যায়। যেহেতু মালয়েশিয়ায় এসময় সারাবিশ্ব থেকে প্রচুর পরিমাণ ট্যুরিস্ট আসে, তাই দেশটির মানুষেরা ব্যবসাবাণিজ্যেই বেশি মনযোগ দিয়ে থাকেন। ইদের দিন বিভিন্ন ট্যুরিস্ট অ্যাট্রাকশনগুলোর আশেপাশে ও ফেস্টিভালে চমকপ্রদ সব খাবার নিয়ে তাদের স্টল দিতে দেখা যায়।
মিশরের ইদ উৎসব
মিশরের মানুষরা ৪ দিন ব্যাপী ইদ উৎসব পালন করেন। ৫ হাজারটি ইদগাহ রয়েছে মিশরে। ইদের দিন মুসলিমরা সেখানে ইদের নামাজ পড়েন।
মিশরীয়রা ঐতিহ্যগতভাবে মাছ দিয়ে বিভিন্ন ধরণের স্পেশাল আইটেম রান্নার মাধ্যমে ইদ উদযাপন করে থাকেন। ইদের সকালে পুরুষরা যখন নামাজ পড়তে যান, ঘরের মহিলারা তখনই মাছ নিয়ে বসে পরেন। সারাদিন চলে নানান রকম স্পেশাল কারী রান্নার আয়োজন ! তবে এর বাইরে মিশরীয়রা ‘ফাতা’ নামে একটি আইটেম রান্না করেন, যা অনেকটা আমাদের দেশের পোলাওর মতই। পার্থক্যটা হচ্ছে তারা পোলাওর চাল ব্যবহার না করে সরাসরি ভাত রাধার চাল ব্যবহার করেন। অর্থাৎ ভাতের মধ্যে আপনি মাছ, মাংস, পেঁয়াজ, গাজর সব পাবেন।
মিশরীয়রা ইদে সালামী আদান প্রদান করেন না।
মায়ানমারের ইদ উৎসব
মায়ানমারে প্রচুর মুসলিম থাকলেও দেশটিতে আসলে ইদ কখনোই তেমনভাবে মানুষের মাঝে আনন্দ আনতে পারেনি। দেশটির মানুষেরা সবসময়ই জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত। আর দশটা দিনের মতই তাদের ইদ সাদামাটা ভাবে কাটে। তবে একটা সময় মায়ানমারেও বাংলাদেশের মত ইদের মেলা হত। বাচ্চারা সেই মেলায় নাগরদোলায় চড়তো। সেসব এখন শুধুই ধূসর অতীত…
আফ্রিকার ইদ উৎসব
আফ্রিকা মহাদেশের অন্তর্গত মুসলিম দেশগুলো হচ্ছে নাইজেরিয়া, কেনিয়া, ইথোপিয়া, আলজেরিয়া, লিবিয়া, মরিতানিয়া, জিবুতি, জাম্বিয়া, সেনেগাল, মরোক্কো, নিগার, সুদান সোমালিয়া, তিউনিশিয়া। এই দেশগুলোই অত্যন্ত ঘটা করে ইদ উদযাপন করা হয়। আফ্রিকানরা ধর্মের প্রতি খুবই নরম। পুরো একমাস রমজান পালনের পর তারা বেশ আনন্দের সাথেই ইদ পালন করেন। আফ্রিকায় যাকাত ফাউন্ডেশন রয়েছে, এরা দায়িত্ব নিয়ে দুস্থদের জন্য যাকাত সংগ্রহ করে আনেন।
ইদের দিন আফ্রিকানরা সকাল সকাল ইদের নামাজ পড়ে আসেন। তারপর শুরু হয় বাড়িতে বাড়িতে খাবার পাঠানো। আফ্রিকানরা ইদের দিন প্রতিবেশীদের ঘরে খাবার পাঠান। ঠিক যেমনটা আমরা শবে বরাতের দিনে করে থাকি। আফ্রিকানরা ইদের দিন গিফট পাঠানোর আয়োজনও করেন। প্রতিটা পরিবারই একে অন্যকে সামান্য কিছু ছোটখাট উপহার পাঠান।
আফ্রিকার একটি দেশ মরোক্কো। সেখানকার ইদগাহের পাশে ইদের রান্না করা খাবার সহ কিছু ফুডস্টাফ বিক্রি হয়। ধনীরা ইদের নামাজ পড়া শেষে ওই খাবারগুলো কিনে ইদগাহ প্রাঙ্গনে অপেক্ষায় থাকা গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দেন। টাকার বদলে সেখানে খাবার দান করা হয়। অত্যন্ত সুন্দর একটি নিয়ম…
আফ্রিকানরা সাধারণত ইদের দিন ভেড়ার আস্ত পা রোস্ট করে খেতে ভালোবাসেন। এছাড়াও ইদের দিন তারা ঘরে বানানো বিভিন্ন ধরণের প্যানকেক খান।
সেনেগালের মানুষরা ইদকে তাবাস্কি বলেন। এই দিনে তারা পুরো পরিবার নিয়ে একসাথে জড়ো হন। অর্থাৎ এক পরিবারের বাবা মা, দাদা দাদী, মামা চাচা, খালা খালু সহ যত ভাই বোন আছে, এক কথায় পুরো চৌদ্দগুষ্ঠি নিয়ে তারা একসাথে খেতে বসেন। তাও আবার এক থালায় !
সেনেগালের মত জাম্বিয়া, বুরকিনা ফাসো এবং মালিতেও একইভাবে তাবাস্কি (ইদ) উদযাপন করা হয়।
কেনিয়ার মানুষরা ইদের দিন সবার ঘরে ঘরে গিয়ে দরজায় টোকা দিয়ে বলে আসে, ইদ মোবারাক !
আরো পড়ুনঃ