বাংলাদেশে স্ট্রোকে মৃত্যু হার সবচেয়ে বেশি ! সম্প্রতি এমনটাই জানা গেছে আন্তর্জাতিক যৌথ গবেষণা থেকে। আমাদের দেশে প্রচলিত একটি ধারণা আছে যে, স্ট্রোক হচ্ছে হৃদপিণ্ডের রোগ। যা মোটেই সঠিক নয়। স্ট্রোক মস্তিষ্কের রোগ। মস্তিষ্কের রক্তবাহী নালীর দুর্ঘটনাকেই স্ট্রোক বলা যায়। এ দুর্ঘটনায় রক্তনালী বন্ধও হতে পারে, আবার ফেটেও যেতে পারে। এর ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। স্ট্রোক সম্পূর্ণই মস্তিষ্কের রক্তনালীর জটিলতাজনিত রোগ।
সকালে বাসা থেকে হাসিখুশি বের হয়ে বাজারে গেলেন এক ভদ্রলোক। পছন্দমত বাজার করে ব্যাগ নিয়ে সিড়ি বেয়ে উঠতে উঠতেই আচমকা শক্ত হয়ে পরে গেলেন তিনি। এইটা এখনকার বাংলাদেশের পরিচিত একটি দৃশ্য। রিকশা থেকেও একজনকে সেদিন পরে যেতে দেখলাম। ভদ্রলোক স্ট্রোক করে ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন। কেনো হচ্ছে এই স্ট্রোক? আর হঠাৎ করে বাংলাদেশেই কেনো স্ট্রোকের মাত্রা এত বেড়েছে? চলুন জেনে নেয়া যাক…
স্ট্রোক হবার কারণ
- অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ স্ট্রোকের সবচেয়ে বড় কারণ।
- ধুমপান, তামাক পাতা, জর্দ্দা, মাদক সেবন।
- অলস জীবন যাপন করা, স্থুলতা বা অতিরিক্ত মোটা হওয়া, অতিরিক্ত মাত্রায় কোমল পানীয় গ্রহণ।
- অতিরিক্ত টেনশন, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, রক্তে বেশি মাত্রায় চর্বি।
- কিছু কিছু ওষুধ যা রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। যেমনঃ আ্যাসপিরিন, ক্লপিডোগ্রেল।
- ঘুমের সময় নাক ডাকা বা শ্বাসকষ্টজনিত উপসর্গ।
- মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
- যেকোনো ধরনের প্রদাহ অথবা ইনফেকশন ও জন্মগতভাবে ব্রেনে কিংবা মস্তিষ্কে সরু রক্তনালী থাকা।
- অনেক সময় বংশানুক্রমে কিংবা পূর্বের স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক ও দূরবর্তী রক্তনালী বন্ধ হওয়ার কারণেও স্ট্রোক হতে পারে।
স্ট্রোক এর লক্ষণ
- শরীরের কোথাও বা একাংশ অবশ ভাব লাগা কিংবা দুর্বলবোধ করা।
- কথা বলার সমস্যা অর্থাৎ কিছুক্ষণের জন্য কথা জড়িয়ে যাওয়া, অস্পষ্ট হওয়া ও একেবারে কথা বলতে বা বুঝতে না পারা।
- এক চোখ বা দুই চোখেই ক্ষণস্থায়ী ঝাপসা দেখা বা একেবারেই না দেখা।
- মাথা ঝিমঝিম করা, মাথা ঘোরা, দৃষ্টি ঘোলা লাগা, হঠাৎ করে কিছুক্ষণের জন্য হতবিহ্বল হয়ে পড়া।
- বমি বোধ অথবা বমি করা।
- পা দুইটিতে দুর্বল বোধ করা
- স্ট্রোকের মারাত্মক উপসর্গ হচ্ছে অজ্ঞান হওয়া, খিচুনি, তীব্র মাথা ব্যাথা ও বমি।
স্ট্রোক এর চিকিৎসা
- স্ট্রোক হয়ে গেলে এর চিকিৎসা বেশ জটিল। রোগীর উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়। স্ট্রোকের রোগী যদি খেতে না পারেন, তবে নল দিয়ে খাবার ব্যবস্থা করতে হয়। প্রস্রাব ও পায়খানা যাতে নিয়মিত হয়, সে ব্যবস্থা নিতে হয়। প্রয়োজনে প্রস্রাবের রাস্তায় ক্যাথেটার দিতে হবে। চোখ, মুখ ও ত্বকের যত নিতে হবে। বেড সোর প্রতিরোধ করা জন্য নিয়মিত পাশ ফেরাতে হবে।
- উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
- পাশাপাশি অনেক রোগীর হার্টের রোগ থাকে। এসব ক্ষেত্রে কার্ডিওলজিস্টের পরামর্শের প্রয়োজন হয়।
- অন্যান্য চিকিৎসা স্ট্রোকের ধরণ অনুযায়ী করা হয়। যেমনঃ ইস্কেমিক ক্ষরণের কারণে স্ট্রোক হলে অপারেশনের প্রয়োজন পড়ে।
- সকল হাসপাতালেই থাকা উচিৎ একটি স্ট্রোক-কেয়ার ইউনিট, যেখানে ডাক্তার, নার্স, থেরাপিস্ট এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞ সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে স্ট্রোক রোগীর চিকিৎসা দেবেন।
- একজন স্ট্রোক রোগীর চিকিৎসায় প্রয়োজন হয় নিউরোলোজিস্ট এবং নিউরোসার্জনের।
- অনেক রোগীর শ্বাসকষ্ট, বেডসোর প্রভৃতি সমস্যা দেখা দেয়। সৃুতরাং রেসপিরেটরি মেডিসিন স্পেশালিষ্ট, প্লাস্টিক সার্জন সহ সবার সহযোগীতা প্রয়োজন হতে পারে।
- রোগীর অঙ্গ সঞ্চালন করে জড়তা কাটিয়ে তুলতে রিহ্যাবিলিটেশন বা পূনর্বাসনের জন্য ফিজিওথেরাপিস্ট প্রয়োজন হয়।
- রোগী কথা বলতে না পারলে প্রয়োজন স্পিচথেরাপিস্ট এর।
- স্ট্রোক-কেয়ার ইউনিট, সমন্বিত স্ট্রোক-কেয়ার টিমের ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসায় আসবে সুফল, রোগী ও রোগীর স্বজন হবেন চিন্তামুক্ত, রোগী লাভ করবে আরোগ্য।
যেভাবে স্ট্রোক প্রতিরোধ সম্ভব !
স্ট্রোক প্রতিরোধযোগ্য একটি রোগ। এটি ব্রেন বা মস্তিস্কের কঠিন রোগ। ব্রেনের কোষগুলো একবার নষ্ট হলে পুনরায় পুরোপুরি ভাবে কার্যকরী হয় না অথবা জন্মায় না। চিকিৎসার চেয়ে এই রোগ প্রতিরোধই উত্তম। এই রোগ মস্তিস্কের রক্তনালী থেকে উদ্ভুত হয়। স্ট্রোক হলে অনেক সময় রোগী পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে। এর জন্য সুনির্দিষ্ট ও সুচিকিৎসা প্রয়োজন। গ্রামাঞ্চলে বা শহরে যেকোনো হাসপাতালে এই চিকিৎসা সম্ভব।
- ধুমপান, মদ পান, মাদক দ্রব্য, তামাক পাতা ও জর্দা খাওয়া, গুল লাগানো ইত্যাদি থেকে বিরত থাকতে হবে।
- নিয়মিত ওষুধ সেবনের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখতে হবে।
- হৃদপিন্ডের রোগের চিকিৎসা, রক্তের চর্বি নিয়ন্ত্রন করতে হবে।
- চর্বি ও শর্করাযুক্ত খাবার নিয়ন্ত্রন করতে হবে। ফাস্টফুড, বাদাম, সন্দেশ, রসগোল্লা, দুধ-ঘি-পোলাও-বিরিয়ানী, পাঙ্গাশ-চিংড়ি-কাকড়া,গরু বা খাশির মাংস, নারকেল বা নারকেলযুক্ত খাবার, ডিমের কুসুম ইত্যাদি খাওয়া উচিৎ নয়।
- শাকসবজি অল্প ভাত, পাঙ্গাশ-চিংড়ি বাদে যে কোন মাছ, বাচ্চা মুরগী ও ডিমের সাদা অংশ খেলে কোন ক্ষতি হয় না।
- নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। বাড়তি ওজন কমাতে হবে। স্ট্রোক অবশ্যই একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। একবার আক্রান্ত হয়ে গেলে চিকিৎসা অত্যন্ত জটিল, ব্যয়বহুল এবং কষ্টসাধ্য। আক্রান্ত রোগী নিজে মানসিক এবং শারীরিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, পরিবারের জন্য অনেক সময় বোঝা হয়ে দাড়ায়। তাই প্রতিরোধ করাই সর্বোত্তম।
(তথ্যসুত্রঃ উইকিহেলথ, ডক্টরস গাইড ও মেডিভয়েস ম্যাগাজিন)