আফ্রিকা মহাদেশ নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোসহ অন্যান্য দেশের কিছু ভুল ধারণা রয়েছে। আফ্রিকা মহাদেশ সম্পর্কে না জেনে অনেকই অনেক মন্তব্য করে বসেন। সম্প্রতি আমেরিকান টেলিভিশন রিয়্যালিটি শো অ্যামাজিং রেইসের এক অনুষ্ঠানে এক প্রতিযোগী বলেন, আফ্রিকা মহাদেশের কোথাও তুষারপাত হয় না। অথচ কয়দিন আগেই দক্ষিণ আফ্রিকায় জোহানেসবার্গে তীব্র তুষারপাত হলো। এর আগে ২০০৭ সালেও দেশটিতে তুষারপাতের ঘটনা ঘটেছে।
এরকম আরো কিছু ভ্রান্ত ধারণা আছে আফ্রিকা নিয়ে। চলুন জেনে নেয়া যাক…
আফ্রিকা একটি দেশের নাম
বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, অনেকেরই ধারণা আফ্রিকা মহাদেশ নয়, একটি দেশের নাম। যদিও ৫৪টি স্বাধীন দেশ আছে আফ্রিকা মহাদেশে। ২০১১ সালের জুলাই মাসে দক্ষিণ সুদান নামে একটি স্বাধীন দেশের জন্ম হয়। এ মহাদেশের প্রতিটি দেশের রয়েছে স্বতন্ত্র মুদ্রা, জাতীয় সঙ্গীত, ইতিহাস, স্বকীয়তা ও সংস্কৃতি। দুই হাজার ভাষাভাষীর এক বিলিয়ন মানুষ বাস করে আফ্রিকায়। তিন হাজার স্বতন্ত্র জাতি-গোষ্ঠী রয়েছে এখানে। অনেকে জানেন এটি একটি ক্ষুদ্র মহাদেশ। অথচ আয়তনে এটি দ্বিতীয় বৃহত্তম। এর আয়তন তিন কোটি দুই লাখ ২১ হাজার বর্গকিলোমিটার। অর্থাত্ আমেরিকা, চীন, কানাডা, ইউরোপ ও জাপান একত্রে পুরে দেয়া যাবে আফ্রিকায়।
আফ্রিকা বিপদজনক ও হিংস্র
এটা ঠিক যুদ্ধ, বিদ্রোহ, জলদস্যুতা, শিশু সৈন্যর কারণে প্রায়ই আফ্রিকার নাম আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আসে। এমন নয় সেখানে কোনো ভালো খবর নেই। বতসোয়ানা ও ঘানার নাম কী কখনো সংবাদে এসেছে? আফ্রিকার পরিশ্রমী মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিয়ে ইতিবাচক সংবাদ তেমন একটা হয় না আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।
কোনো পর্যটক যদি কাউকে জিজ্ঞেস করে আফ্রিকার সমুদ্র সৈকতে ছুটি কাটাতে যাবেন কিনা। সেখানে যেতে তাকে নিরুৎসাহ করার লোকের অভাব হবে না। এক বাক্যে বলবে সোমালিয়ায় জলদস্যুদের আক্রমণের আশংকার কথা। অথচ আফ্রিকার কয়েকটি দেশ পর্যটকের জন্য অত্যন্ত নিরাপদ। সেখানে সহিংস ঘটনা খুব কমই হয়। আমস্টারডাম থেকেও রাতের বেলা হাঁটার জন্য নিরপাদ ঘানার আক্রা।
আফ্রিকা গরীব ও রোগ-বালাই জর্জরিত
আফ্রিকার কিছু কিছু দেশের দারিদ্র্য যে কাউকেই নাড়া দিতে পারে। তবে সব দেশের অবস্থা একরকম নয়। আফ্রিকায় দারিদ্র্যের অন্যতম প্রধান কারণ সম্পদের সুষম বণ্টনের অভাব। আফ্রিকা মহাদেশের একটি সম্পদশালী ও ধনী দেশের নাম দক্ষিণ আফ্রিকা। বেলজিয়াম ও সুইডেনের সমান এখানকার জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার। প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য, আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয়, চমত্কার ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র এবং বেশকিছু উন্নত হাসপাতাল রয়েছে দেশটিতে। কাগজে-কলমে অর্থাৎ জিডিপি ও পিপিপি’র ভিত্তিতে বিচার করলে ডেনমার্ক ও নরওয়ে থেকে মিসর, নাইজেরিয়া এবং আলজেরিয়ার অবস্থান অনেক ভালো।
আফ্রিকার প্রায় সব দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি প্রতিদিন কাজে যায়। করের ব্যাপারে অভিযোগ তুলে এবং প্রতি সপ্তাহের ছুটির দিনে বাচ্চাদের ফুটবল খেলা উপভোগ করে। অসুখ-বিসুখে প্রতিবছর আফ্রিকায় লাখো শিশু মারা যায়। এর কারণ হলো শিশু বয়সের সংক্রমণ বিরোধী কর্মসূচি গ্রহণ ও প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার অভাব। তার মানে এই নয় মহাদেশটিতে রোগ-বালাইয়ে ভরা। সফল সংক্রমণবিরোধী কর্মসূচি নেয়ায় গত দশকে আফ্রিকায় পোলিও এবং হাম আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা কমেছে। এইডস প্রতিরোধে নানা কর্মসূচি নেয়ায় গত কয়েক বছরে এইডসের ব্যাপারে একটি জনসচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। ম্যালেরিয়ার প্রকোপও আগের কম। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে বিভিন্ন দেশে।
আফ্রিকার সব রাজনীতিবিদরাই দুর্নীতিগ্রস্ত
রাজনৈতিক নেতাদের দুর্নীতি শুধু আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলোতে নয়, অন্য দেশেও অহরহ ঘটছে। নেলসন ম্যান্ডেলা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছেন যে আফ্রিকা সৎ ও যোগ্য নেতার জন্ম দিতে পারে।
কিছু রাজনৈতিক সংকট আফ্রিকা পেয়েছে ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার সূত্রে। কিন্তু অধিকাংশ দুর্নীতির ঘটনার জন্য দায়ী বিভিন্ন দেশের ক্ষমতাসীন ও রাজনৈতিক দলগুলো। আর আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পরাশক্তির রাজনীতির মেরুকরণে এ সুযোগ পান ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা। সাধারণ মানুষের মধ্যে দুর্নীতির প্রবণতা খুব বেশি দেখা যায় না। তিউনিসিয়া, মিসর ও লিবিয়ার স্বৈরশাসককে মসনদ থেকে সরিয়ে দিয়েছে এখানকার রাজনীতি সচেতন জনগণ। নারীর ক্ষমতায়নেও আফ্রিকার সাফল্য রয়েছে। লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট এলেন জনসন সারলিফসহ আরো দুইজন নারী শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। জাম্বিয়ায় একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পতন হয়েছে।
আফ্রিকার কোন ইতিহাস নেই
মিসরের প্রাচীন স্থাপনা, ইথিওপিয়ায় শিলা নির্মিত প্রাচীন চার্চ প্রভৃতি প্রমাণ করে আফ্রিকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য হাজার বছরের পুরনো। ১১ শতকে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে একটি উদীয়মান রাজত্ব গড়ে উঠে যা এখন গ্রেট জিম্বাবুয়ে হিসাবে পরিচিত। ওই সময়কার কিছু এখনো দেয়াল এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ১২ শতকে অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ যখন যাত্রা শুরু করে তখন মালির তিমবুকতুতে তিনটি প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। ধারণা করা হয় কালাহারি মরুভূমিতে বুশম্যানরা সেই পাথর যুগ থেকে বসবাস করে আসছে। আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় শতাধিক গুহা রয়েছে যা ২০ হাজার বছরের পুরনো।
প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতার সাফল্যের অন্যতম একটি কারণ নীল নদের সঙ্গে এই সভ্যতার মানুষের মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতার মধ্যে। যা এই অঞ্চলের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ ত্বরান্বিত করে। সম্পদ তৈরির পাশাপাশি উপত্যকা ও পার্শ্ববর্তী মরু অঞ্চলে খনিজ পদার্থ উত্তোলন, একটি লিখন পদ্ধতির উদ্ভাবন, স্থাপনা ও কৃষিজপণ্যের সুসংহত ব্যবহার, পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন এবং সামরিক বাহিনী বহিঃশত্রুদের পরাজিত করে মিসরীয় সভ্যতার বিকাশকে স্থায়ী রূপ দেয়। ঐতিহাসিক মিসরীয় পিরামিড, মন্দির, মিসরীয় গণিত ব্যবস্থা, একটি ব্যবহারিক ও কার্যকরী চিকিত্সা ব্যবস্থা, সেচব্যবস্থা ও কৃষি উত্পাদন কৌশল, প্রথম জাহাজ নির্মাণ, মিসরীয় চীনামাটি ও কাঁচশিল্পবিদ্যা, একটি নতুন ধারার সাহিত্য এবং বিশ্বের ইতিহাসের প্রাচীনতম শান্তিচুক্তি প্রভৃতি কারণে মিসর স্মরণীয় থাকবে।
ভয়ংকর প্রাণী অবাধে ঘুরে বেড়ায় আফ্রিকাতে
অনেকের ধারণা আফ্রিকার বিভিন্ন শহরে-নগরে ভয়ংকর জন্তু-জানোয়ার ঘুরে বেড়ায়। এ ধারণা কিছুটা সত্য কিছুটা ভুল। এটা সত্যি পূর্ব আফ্রিকার বড় শহর নাইরোবির কেন্দ থেকে কয়েক মাইল দূরেই গন্ডার চড়ে বেড়ায়। দক্ষিণ আফ্রিকার কয়েকটি গলফ কোর্সের মধ্যের জলাশয়গুলো কুমিরে ভরা।
রাতের বেলা মালাবির রাজধানীতে বের হলেই ভয়ংকর হায়েনার সামনে পড়তে হবে। তবে আফ্রিকার বণ্যপ্রাণীগুলো ন্যাশনাল পার্ক ও সংরক্ষিত এলাকায় অবাধে ঘুরে বেড়ায়। ওসব এলাকা গড়ে তোলা হয়েছে বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণে। আফ্রিকার দক্ষিণের দেশুগুলোতে রাস্তার পাশেই দেখা যায় উট পাখিও বেবুন। কিন্তু হাতি, জিরাফ, সিংহ, বন্য মহিষ কখনোই শহর কিংবা শহরের আশেপাশে দেখা যায় না। আফ্রিকার বর্ধমান জনসংখ্যার কারণে হুমকির মুখে ছিল প্রাণীকুল। অনেক সময় কৃষকের ফসলের ক্ষতি করতো এই প্রাণীরা।
কারিগরি প্রযুক্তির দিক দিয়ে আফ্রিকা পিছিয়ে
কারিগরি উদ্ভাবনী শক্তির অভাব আছে আফ্রিকায় গিয়েছে কেউ এ কথা শুনলে হাসবে। কোনরকম কারিগরি ডিগ্রি ছাড়াই ঘানায় পুরাতন জঞ্জাল থেকে গাড়ি তৈরি করা হয়। জাম্বিয়ার স্কুলগুলোর বিশাল খেলার মাঠে শিক্ষার্থীরা ঘরে তৈরি খেলনা দিয়ে খেলে। প্রায়ই সব দেশের মানুষের হাতে রয়েছে মোবাইল ফোন। কেনিয়াতে চালু হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবস্থা।
সবসময়ই গরম থাকে আফ্রিকায়
পশ্চিমা আফ্রিকার দেশগুলোতে সব সময়ই গরম পড়ে। উত্তর ও দক্ষিণ আফ্রিকার দেশগুলোতে বছরের একটি সময় তুষারপাতের সঙ্গে তীব্র শীত অনুভূত হয়। গ্রীষ্মকালে ভয়াবহ গরম পড়ে। দেশভেদে পাহাড়, উপত্যকা, শীতল সাগর , গরম সাগর, বর্ষা ও শুষ্ক মৌসুমের কারণে এখানে আবহাওয়ারও বৈচিত্র্য দেখা যায়।
ত্রাণে চলে আফ্রিকা
ত্রাণের অর্থে চলে আফ্রিকা। সেলিব্রেটিদের অর্থে জীবন চলে আফ্রিকান শিশুদের। এ ধারণাগুলো সম্পূর্ণ ঠিক নয়। মূলত আন্তর্জাতিক ক্ষমতাশালী দেশগুলোর বিভিন্ন তথাকথিত উন্নয়ন কর্মসূচির কারণে এখানে অভাব ও দারিদ্র্য রয়েই যায়। ভুল পরিকল্পনা গ্রহণ ও ভুল প্রজেক্টে অর্থ ব্যয়ের কারণে এ অর্থ ব্যয় হয়। অনেক দেশের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে যেখানে ত্রাণের দরকারও নেই।
পরিশেষে একটা কথাই বলা যায়, আফ্রিকা মহাদেশ বাকী মহাদেশের মতই সাধারণ একটা মহাদেশ। “অন্ধকারের দেশ” নামক উপাধিটা তার সাথে মানায় না এখন। এটা মুছে দেওয়ার সময় চলে এসেছে।
আরো পড়ুনঃ