পহেলা বৈশাখ বাংলা সংস্কৃতির সাথে জুড়ে রয়েছে। বর্তমানে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানকে অনেকেই ব্রাজিলের “কার্নিভাল” এর সাথে তুলনা করে থাকেন। স্বভাবতই অনেকের মনে প্রশ্ন আসে,পহেলা বৈশাখ এর উদযাপন শুরু হয় ঠিক কবে থেকে। আর কারাই বা এটা শুরু করেন। চলুন জেনে নেওয়া যাক…
পহেলা বৈশাখ
অনেকেই হয়ত মনে করে থাকেন বাঙালিরা সেই প্রাচীনকাল থেকেই পহেলা বৈশাখ পালন করে আসছে। কিন্তু না, তা নয়…
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, এই পহেলা বৈশাখ এলেই অনেক কৃষক আত্মহত্যা করতেন। তাদের এই আত্মহত্যার পিছনে প্রধান কারণ ছিলো তাদের ঋণ। বিভিন্ন মহাজনের থেকে তারা চরম সুদে ঋণ নিতেন।এবং এই ঋণ শোধ করতে হতো পহেলা বৈশাখে। অনেক গরীব কৃষক এই ঋণ শোধ করতে অপারগ হতেন। ফলে তাদের বেছে নিতে হত মৃত্যুকে।
মজার ব্যাপার হলো, পহেলা বৈশাখ আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয় কিছুদিন আগে। ১৯৬৭ সালে। তখন “উদীচী ” শিল্প গোষ্ঠী বাঙালী জাতীয়বাদের প্রতিক হিসেবে পহেলা বৈশাখ বেশ ঘটা করে আয়োজন করে। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে রমনা বটমূলের এই উদযাপনকে জাতীয়ভাবে মর্যাদা দেওয়া হয়।
পান্তা ইলিশ
আশির দশকে হঠাৎ করেই এই পান্তা ইলিশের প্রচলন শুরু হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৮৪ সালের ১৪ এপ্রিল কিছু ব্যক্তি পান্তা ভাত, ইলিশ মাছ ও বেগুন ভর্তা নিয়ে ঢাকার রমনা বটমূলে খোলা উদ্যানে দোকান দেয়। তারা এই দোকানের নাম দেয় “রমনা রেস্টুরেন্ট”। দোকানের জনপ্রিয়তা এতই বেড়ে যায় যে, খুব দ্রুত সব কিছু শেষ হয়ে যায়।
অন্য আরেকটি সূত্র হতে জান যায় যে, রমনা বটমূলের পান্তা ইলিশের উদ্যোক্তা দৈনিক জনকণ্ঠের সাংবাদিক বোরহান আহমেদ, উনি রমনা বটমূলে পান্তা-ইলিশ চালুর প্রস্তাব দেন, তখন তার সাথে তার সহযোগীরা মিলে ৫ টাকা করে চাঁদা তুলে পুরো আয়োজনের ব্যবস্থা করলেন। বাজার করা হলো, রান্না হলো, রাতে ভাত রেধে পান্তা তৈরি করে, কাঁচামরিচ-শুকনো মরিচ, পেঁয়াজ, ইলিশ ভাঁজা নিয়ে পরদিন ‘এসো হে বৈশাখে’র আগেই ভোরে হাজির হলেন তারা বটমূলের রমনা রেষ্টুরেন্টের সামনে। মুহুর্তের মধ্যে শেষ হলো পান্তা-ইলিশ। এভাবে যাত্রা শুরু হলো পান্তা ইলিশের। অপর দিকে সম্ভবত একই বা পরের বছর শহিদুল হক খান এই প্রক্রিয়ার সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। তিনি দাবি করেছেন, নিজ হাতে পান্তার পোষ্টার লিখেছেন, তার পরিবারের সদস্যবৃন্দ ভাত রেধেছেন, ইলিশ মাছ ভেঁজেছেন, কাঁচামরিচ পেঁয়াজ কেটেছেন, মাটির সানকি সংগ্রহ করেছেন। এবং তার এ নিয়ে বিটিভিতে সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন ! তবে রমনা বটমূলের পান্তা ইলিশের উদ্যোক্তার কৃতিত্ব এককভাবে কেউ নন।
মঙ্গল শোভাযাত্রা
মঙ্গল শোভাযাত্রার যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই। স্বাধীন বাংলাদেশে মঙ্গল শোভাযাত্রাটির প্রচলনও অশুভ শক্তিকে নাশ করে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে যাত্রা করেছিল। স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনের অংশ হিসাবে ১৯৮৯ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রার নতুন রূপ পায়।
স্বৌরাচারী অপশক্তিকে পরাহত করতে ওই নববর্ষে বাঙালিরা ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে শোভাযাত্রায় অংশ নেয়। ১৯৯০ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রা আনন্দ শোভাযাত্রা নামে পথচলা শুরু করে। তখন নানা শিল্পকর্মের প্রতিকৃতি স্থান পায় শোভাযাত্রায়। স্বৈরাচারের পতনের পর ১৯৯১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শোভাযাত্রার নতুন মাত্রা যোগ করে। ১৯৯১ সালের শোভাযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ অংশ নেয়। এভাবেই মঙ্গল শোভাযাত্রাটিও বাংলাদেশের সংস্কৃতি তথা পহেলা বৈশাখের উদযাপনে জায়গা করে নিয়েছে।
সব মিলিয়ে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের সংস্কৃতি এদেশের রক্তের কথা তুলে ধরে বারবার। প্রতিটা সংস্কৃতি ধারণ করে কিছু সংগ্রামের গল্প। জাতীয়তাবাদের জন্যে লড়ার গল্প। প্রমাণ দেখতে চান?
“পহেলা বৈশাখ”!