লক নেস দানব (Loch Ness Monster) হচ্ছে একটি ক্রিপটিড প্রাণী, যাদের অস্তিত্বের কথা শোনা যায় ঠিকই, কিন্তু বৈজ্ঞানিক কোন প্রমাণ নেই। জনশ্রুতি অনুসারে, এটি স্কটল্যান্ডের লক নেসে বসবাসকারী অনেক বড় অদ্ভুত প্রাগৈতিহাসিক ড্রাগন অাকৃতির পাখাওয়ালা একটি প্রাণী। বিভিন্ন সময় যদিও এর ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে এটি স্কটল্যান্ড ও এর অাশেপাশের হৃদের অন্যান্য রহস্যময় দানবের যে বর্ণনা পাওয়া যায় তার সাথে অনেকটা মিলে যায় বলে মনে করা হয়।
লক নেস দানব
এ প্রাণীর অস্তিত্ব সম্পর্কে বিশ্বাস ও মানুষের মধ্যে ব্যাপক অাগ্রহের সূত্র ধরে এটি প্রথম ১৯৩৩ সালে বিশ্ববাসীর নজরে অাসে। অনেক বিতর্কিত ফটোগ্রাফিক উপাদান এবং অস্তিত্বের প্রমাণ সম্পর্কে অপর্যাপ্ত তথ্যের জন্য এ প্রাণীটিকে কাল্পনিক প্রাণী বলে মনে করে থাকেন। সাধারণ বিশ্বাস অনুসারে কোন প্রাণীর এত দীর্ঘ সময় পৃথিবীতে টিকে থাকা সম্ভব নয়। এছাড়াও হৃদের গভীরে সূর্যালোক প্রবেশ না করার কারণেও এটিকে নিছক একটি গুজব বলেই মনে করা হয়। বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায় এটিকে অাধুনিককালের পূরাণ হিসেবে অাখ্যা দিয়েছেন। তবে এগুলো বাদ দিয়ে লক নেসের দানব পৃথিবীর অন্যতম রহস্য বলে বিবেচিত
১৯৪০ এর দশক থেকে কিংবদন্তি এ প্রাণীটিকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে ডাকা হয়ে থাকে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, নেসী (স্কটিশ নিসাগ থেকে এর উৎপত্তি)। রহস্যময় প্রাণী সম্পর্কিত বিজ্ঞান বা ক্রিপ্টোজুলজি -তে বিগফুট, ইয়েতি, সাসকুয়াচের মত রহস্যঘেরা প্রাণীদের পাশাপাশি নেসীও স্থান করে নিয়েছে।
লক নেস লেক
স্কটল্যান্ডের স্কটিশ উচ্চভূমির একটি লেকের নাম ‘লক নেস’। এ লেকে রয়েছে দানব। এমনটাই রয়েছে জনশ্রুতি। আর এ দানবকে ক্যামেরায় ধারণ করতে অাধুনিক স্ট্রিট ভিউ ক্যামেরা মোতায়েন করেছে টেক জায়ান্ট গুগল। এরপর সে ক্যামেরায় ধারণ করা হয়েছে রহস্যময় এক বস্তুর ছবি। এক প্রতিবেদনে বিষয়টি জানিয়েছে টেলিগ্রাফ।
গুগলের ক্যামেরা চালানোর জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল কয়েকজন স্থানীয় এক্সপার্টকেও। গুগলের স্ট্রিট ভিউ ক্যামেরায় ধরা পড়া সেই ছবিটি কি লক নেস লেকের রহস্যময় দানবের? এ প্রশ্নের উত্তর এখনো মেলেনি। তবে গুগলের এক মুখপাত্র এ প্রসঙ্গে নেতিবাচক তথ্যই জানান।
গুগল জানিয়েছে, প্রতিমাসে লেকটির বিষয়ে জানতে প্রায় দুই লক্ষ বার সার্চ করা হচ্ছে। এ থেকে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার তথ্য সংগ্রহ ও একত্রিত করা হচ্ছে। এর অাগে ১৯৩৪ সালে তোলা এক ছবিতে রহস্যময় এ প্রাণীটির অস্তিত্ব জানা যায়। তবে সেই ছবিটির কোনো ব্যাখ্যা অাজও পাওয়া যায়নি।
রহস্যের সূচনা ও উদঘাটন
সর্বপ্রথম যে বক্তব্যটি শোনা যায় সেটি হল, ৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে শুরুহয় রহস্যময় ‘নেসী’ ঘটনা। সেইন্ট কলম্বো হৃদে সাঁতার কাঁটা অবস্থায় এক লোক ভয়ংকর এই প্রাণীটির কবলে পড়ে। কোনোরকমে সে বেঁচে ফিরে অাসে। প্রথম প্রথম এটিকে পরিচিত প্রাণী হিসেবে ভাবলেও ধীরে ধীরে এই রহস্য ঘনীভূত হতে থাকে।
১৯৩৩ সালে লক নেস হৃদের মধ্যে ভ্রমণে গিয়েছিলেন দুই বন্ধু। নৌকায় থাকা অবস্থায় পানিতে কিছু অালোড়ন বুঝতে পারেন তারা। যখন ভালো করে লক্ষ করলেন তখন তারা এক অাশ্চর্য কিছু অবলোকন করেন। তাদের ভাষ্য ছিল এটি একটি জীবন্ত প্রাণী যা প্রায় ৩০ ফুটের মত লম্বা। মাথার শুরু এবং দেহের শেষটাও অনেকটা সাপের মত। সেই বছরেই একজন ছাত্র মোটরসাইকেল চালিয়ে অাসার সময় হৃদের পাশের রাস্তায় কোন একটা বিশাল প্রাণীর সাথে প্রায় ধাক্কা খায়। ছেলেটির বর্ণনা অনুসারে প্রাণীটি সরীসৃপ গোছের বিশালাকৃতির, যার মাথা অনেকটা সাপের মত, অাগের বর্ণনার সাথে ছেলেটির দেয়া বর্ণনাও অনেকটা মিলে যায়।
এরপর ১৯৩৪ সালে স্যার এডওয়ার্ড মাউন্টেনের নেতৃত্বে ২০ সদস্যের একটি দল হৃদটির চারপাশে অনেকগুলো ক্যামেরা নিয়ে সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত অবস্থান করে। তারা প্রায় ২৫ টির মত ছবি তুলে। পরবর্তীতে প্রাণীবিদগণ গবেষণা করে কিছু একটা সমস্যা চিহ্নিত করেন।
১৯৬৩ সালের জুলাই মাসে নেসিকে দেখতে পান এক ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা। তারা হৃদটির পাশ দিয়ে গাড়ি চালানোর সময় দেখলেন ডাঙ্গায় শুয়ে রোদ পোহাচ্ছে কোন একটা বিশাল অাকৃতির প্রাণী। মানুষের উপস্থিতি টের পেয়েই প্রাণীটি সঙ্গে সঙ্গে তলিয়ে গেল।
রবার্ট রাইসন, তিনি দীর্ঘদিন ধরে জলদানব রহস্য নিয়ে কাজ করছেন। ১৯৭২ সালে তিনি সূক্ষ কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে হৃদে অভিজান চালালেন। অাগস্টের ৮ তারিখে তার দলের সদস্যরা নৌকার অপেক্ষা করছিল। রাত একটার দিকে পর্যবেক্ষণে এক বিচিত্র প্রাণীর অস্তিত্ব ধরা পড়ে। যার রয়েছে বিরাট অাকারের ডানা। রাইসনের মতে, অাজ থেকে সাত কোটি বছর অাগে পৃথিবীতে এরকম প্রাণী ছিল।
এরপরই হয়ে যায় নেসিকে নিয়ে হইচই। হৃদের চারপাশে বসানো হয় অসংখ্য ক্যামেরা। কিন্তু এতসব ক্যামেরার পক্ষেও পরিষ্কার কিছু তোলা সম্ভব হয়নি। ক্যামেরায় যে ছবিগুলো তোলা হয়েছিল সেগুলোতে দেখা যায় শধুমাত্র পানির অালোড়ন ও কিছু ভি অাকৃতির ফেনার ছবি।
তবে লন্ডনের এক ডাক্তারের তোলা ছবিতে নেসিকে মাথা তোলা অবস্থায় দেখা যায়। ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত ছবিটিকে অনেকে সত্য বলে মেনে নিয়েছিল। এরকম অারো অনেকে রহস্যময় এই জলদানবটিকে দেখেছেন বলে দাবী করেন। কিন্তু নেসি চিরকালই পুরোপুরি ধরা না পরে মানুষকে ফাঁকি দিয়ে গেছে।
নেসির অাকৃতি
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিজ্ঞানীগণ এই প্রাণী সম্পর্কে নানা ধারনা দিয়েছেন। কানাডার ভেসকুভারের সমুদ্রবিজ্ঞানী পল ব্লড এর মতে, লম্বা গলা, অনেক কুঁজ, মাছের মতো ডানা,হলুদ পেট, বাইন বা সাপ জাতীয় মাছের মতো,ভোঁদর জাতীয়,চতুষ্পদ সরীসৃপ যেমন কুমিরের মতো, কচ্ছপের পূর্বসূরিয় জাতের মত।
১৯৮৪ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকৌশলী জিন থমসন মাছ ধরতে বেরিয়েছিলেন ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঁচ মাইল দূরে। হঠাৎ জিন দেখলেন তার ২০০ ফুট দূরে হঠাৎ একটি প্রাণী ভেসে উঠেছে। জিন সেই প্রাণীটির বর্ণনা দিচ্ছেন, “২০ ফুট লম্বা ও দুই ফুট চওড়া হবে প্রাণীটি। সাদা তামাটে রঙের গলা এবং তার লম্বা লম্বা কানগুলো দোল খাচ্ছিলো। লাজুক ও কৌতুহলী এই প্রাণীটি অামাকে দেখে অবাক হয়েছে বলে মনে হল। তারপর সে চলে যেতে চাইলো। কয়েকবার মাথা ঝাঁকিয়ে সাঁতার কেটে চলে গেল সে।সাঁতার কাঁটার সময় তার দেহ মোচড় খাচ্ছিল।”
১৯৫১ সালে বনবিভাগের কর্মী মি. এল স্টুয়ার্ট নেসিকে পানি ছিটাতে ছিটাতে বহুক্ষণ ভেসে থাকতে দেখেছেন। তার বর্ননায়,” লম্বা গলার উপর মাথাটা অবিকল ভেড়ার মত। পিঠে কয়েকটি কুঁজ এবং সব মিলিয়ে লাম্বা প্রায় ১৫ মিটার।”
সাম্প্রতিককালে ইকো ব্যবহার করে লক নেসের তলদেশে বিশাল এক গুহা বা খাদ অাছে বলে ধারণা করেছেন গবেষকরা। অনেকের মতে ১৫০০ বছর অাগের কোনো এক প্রাণীর উত্তরসূরি হলো অাজকের নেসি। তবে এটি শুধু গবেষকদের ধারণা কিংবা মতামত। অাধুনিক এই বিজ্ঞানের যুগেও পৃথিবীর বুকে এক অপার রহস্য হয়ে অাছে জলদানব নেসি।
লক নেস দানব সংক্রান্ত বেশকিছু সিনেমাও নির্মাণ হয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্যঃ
- Loch Ness
- The Water Horse: Legend of the Deep
- Incident at Loch Ness
- Beneath Loch Ness