মেজবান বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান। মেজবান সাধারণত কারো মৃত্যুর পর কুলখানি, চেহলাম, মৃত্যুবার্ষিকী, শিশুর জন্মের পর অাকিকা, নিজেদের কোনো সাফল্য, নতুন বাড়িতে প্রবেশ, মেয়েদের কান ছেদন, সুন্নতে খতনা ইত্যাদি উপলক্ষে অায়োজন করা হয়।
মেজবান এর উৎপত্তি
‘মেজবান’ শব্দটি ফার্সী শব্দ থেকে এসেছে।যার অর্থ ‘নিয়ন্ত্রণকর্তা’। অতিথি অাপ্যায়নকারীকে বলা হয় ‘মেজবান’ এবং অাতিথেয়তাকে বলা হয় ‘মেজবানি’। মেজবানকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ‘মেজ্জান’ বলা হয়। কোন উপলক্ষকে কেন্দ্র করে একটি গণভোজই হলো মেজবান। মেজবানির উৎপত্তির সঠিক কোনো সময় জানা যায়নি। চট্টগ্রাম অঞ্চলে সুদীর্ঘকাল ধরে এই প্রথা চর্চিত হয়ে অাসছে।
মেজবানি খাবারদাবার
মেজবানে প্রধানত সাদা ভাত, গরুর মাংস, গরুর পায়ের ঝোল (চট্টগ্রামের ভাষায় যাকে ‘নলা-কাঁজি’ বলা হয়) ও বুটের ডাল পরিবেশন করা হয়। সাদা ভাতের সাথে সাধারণত তিন বা চার পদের তরকারি পরিবেশন করা হয়।
মেজবানি রন্ধনপ্রণালীর বৈশিষ্টগুলো হলঃ
- মরিচ ও মসলা দিয়ে রান্না করা ঝাল মাংস।
- মাসকলাই ভেজে খোসা ছাড়িয়ে গুঁড়ো করে একধরণের ডাল রান্না করা হয়। একে ‘ঘুনা ডাল’ বলে।
- কলইর ডালের পরিবর্তে বুটের ডালের সাথে হাঁড়, চর্বি ও মাংস দিয়ে ঝালযুক্ত খাবার।
- গরুর পায়া বা নলা দিয়ে কম ঝালযুক্ত মসলাটেক শুরুয়া বা কাঁজি। যা নলা-কাঁজি নামে পরিচিত। এই ‘নলা-কাঁজি’ চট্টগ্রামের বিখ্যাত একটি খাবার।
এছাড়াও ছাগলের মাংস ও মাছ দিয়েও মেজবান দেয়া হয়।ছাগল দিয়ে বিশেষ করে নবজাতকের খতনা বা অাকিকা উপলক্ষ্যে মেজবানি দেয়া হয়
অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ত্রিপুরা, চাকলা রওশনবাদ ও চট্টগ্রামের(তৎকালীন ইসলামাবাদ) উত্তরাঞ্চলের জমিদার শমসের গাজী তাঁর মা কৈয়ারা বেগমের নামে দীঘি খনন শেষে অাশপাশের দীঘি ও চট্টগ্রামের নিজামপুর অঞ্চলের দীঘিপুষ্করিণী থেকে মাছ ধরে এনে বিশাল একটি ভোজ দেন। চট্টগ্রামের হিন্দু সম্প্রদায় চট্টগ্রাম পরিষদের ব্যানারে মাছ, সবজি ও শুঁটকির তরকারি রান্না করে প্রতিবছর মেজবান অায়োজন করে।
মেজবানের দাওয়াত
মেজবানের দাওয়াত সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকে। অাগেকার দিনে গ্রামাঞ্চলে কোনো ধনাঢ্য ব্যক্তি মেজবানির অায়োজন করলে বিভিন্ন লোকের মাধ্যমে সেই মেজবানের দাওয়াত বিভিন্ন গ্রাম-পাড়া-মহল্লায় পৌছে দেয়া হতো। শহরাঞ্চলে অনেকসময় দাওয়াতকার্ড ছাপিয়ে অতিথিদের মাঝে বিলি করা হয়।
মেজবান চট্টগ্রামের সামাজিক মর্যাদার প্রতীক।
মেজবানের রীতি
কোনো এলাকায় মেজবানি হলে অাশপাশের এলাকা থেকেও শরীক হতে মানুষ অাসে। মৃত ব্যক্তির স্বজনেরা মনেকরে যত মানুষ এসে মেজবানে শরীক হচ্ছে, তত মানুষের রুহের সন্তুষ্টি মৃত মানুষের দোয়া হয়ে যাচ্ছে।
মেজবানের দিন কোরঅান খতম ও দোয়া পড়ানো হয়। গরীব-মিসকিনদের একবেলা খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। এমন কোনো মেজবান নেই যেখানে এতিমখানার শিশুদের দাওয়াত দেওয়া হয়না। তারাই দোয়া মাহফিল করে মেজবানির প্রথম অায়োজন শুরু করে।
তবে মেজবানির অায়োজন করার কোন বাধ্যবাধকতা নেই।
অন্যান্য জেলায় মেজবান
রাজধানী ঢাকায় মেজবানির প্রচলন শুরুহয় জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলামের চট্টগ্রাম সমিতি, ঢাকার সভাপতি থাকাকালে (১৯৬৮-৮৩)। তাঁর অনুরোধে তেজগাঁওস্থ বাবলী ইন্ডাষ্ট্রিজের মালিক প্রয়াত মোজাম্মেল হক মেজবানির প্রচলন করে যা পরবর্তীতে বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টারের ক্ষুদ্র গন্ডি ছাড়িয়ে ধানমন্ডির সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সে প্রায় অর্ধলক্ষ লোকের মিলনমেলায় পরিণত হয়।
নোয়াখালী অঞ্চলে মেজবানি ‘জেয়াফত’ নামে পরিচিত ও জনপ্রিয়। এছাড়াও সিলেট, খুলনায়ও মেজবানি অায়োজন করতে দেখা যায়। যা অতি সামান্য।
দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও চট্টগ্রামের মেজবানের খ্যাতি পৌছে গিয়েছে। ইউরোপ,অামেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে মেজবান। ব্যক্তি উদ্যোগ ছাড়াও সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে মেজবানের অায়োজন করা হয়।
সাধারণত দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত একনাগারে মেজবান খাওয়ানো হয়। অাগেরদিন রাতে অায়োজকের বিশেষ অামন্ত্রণে অাসা লোকদের, মেজবানির কর্মী এবং পাড়া-প্রতিবেশিরা একসাথে বসে সলাপরামর্শ শেষে খাবার খান। যাকে চট্টগ্রামের মুসলমানেরা ‘অাগদাওয়াত’ বা ‘অাগদাওতি’ বলে। মূলত পরদিনের মেজবানি উপলক্ষেই এ ‘অাগদাওতি’ অনুষ্ঠান। মেজবানি উপলক্ষে বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী, এমনকি তাদের অাত্নীয়স্বজন ও অন্যান্য জেলার লোকদের অামন্ত্রণ জানানো হয়।
সাধারণত চট্টগ্রামের কেউ নিজেকে মেজবানির খাওয়ার থেকে বিরত রাখেনা বা রাখতে পারে না। চট্টগ্রামের মেজবানি রান্নার বাবুর্চি ও তাদের সহকর্মী সকলেই চট্টগ্রামের লোক। তারা রান্নায় চট্টগ্রামের বিশেষ অঞ্চলে উৎপাদিত বিশেষ স্বাদযুক্ত মরিচ-হলুদ ইত্যাদি ব্যবহার করেন।