বন্ধুত্ব মানে কতগুলো গল্প, কতগুলো নির্বাক হাস্যজ্জল স্মৃতি, কখনোবা বন্ধুত্ব মানে ইতিহাস। কিন্তু এই গল্পে বন্ধুত্ব ছিলো অস্ত্রের মত। গল্পটা তাদের নিয়ে, যারা বন্ধুত্বের প্রয়োজনে তৈরী করেছিলেন গল্প। শিল্প অস্ত্রের সামনে তারা বন্ধুত্বকে করেছেন গেরিলা স্কোয়াড। আর ১৯ বছরের সেই পুরোনো বন্ধুত্বের নাম আর্টসেল !
আর্টসেল : পথচলার গল্প
আর্টসেল বাংলাদেশের প্রোগ্রেসিভ মেটাল ব্যান্ড। শুরুটা হয়েছিলো বন্ধুত্ব থেকে। কয়েকশ বিকেল আড্ডা কিংবা হাজার রাতের স্বপ্ন দেখেছিলো নটরডেমের লিংকন, বিএফ শাহীনের সেজান আর সাজু, আর ঢাকা কলেজের উড়ন্ত এরশাদ। সেই স্বপ্ন থেকেই সেদিনের আর্টসেল। বাজানোর মত গিটার নেই, নেই সাউন্ডপ্রুফ প্যাড। এমনকি ছিলো না সামান্য স্পীকার। তপ্ত গরমে চিলেকোঠায় চলতো প্রেক্টিস। আর সেইসব বাধাকে পেছনে ফেলে এগিয়েছে সেই বন্ধুদের অপরাজেয় আর্টসেল।
নামটা আসে সুনীলের কাছ থেকে। সুনীল মানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তার ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ বইটাতে হাবুডাবু খাচ্ছিলেন এরশাদ। সেখান থেকেই মাথায় ঢোকে আর্ট শব্দটা। তার সাথে সেজান জুড়ে দিলেন সেল। আর্ট আর সেল জুড়ে দিয়ে তৈরী হয় ভালোবাসা আর্টসেল। যার অর্থ দাঁড়িয়েছিলো শিল্পকোষ। যেই কোষ সঙ্গীত মহলকে শুধু নাড়িয়ে দেয়নি, হৃদয় কেড়েছে বহু প্রজন্মের।
পোগ্রেসিভ মেন্টাল ব্যান্ড হিসেবে পরিচিতি পেলেও আর্টসেলের শুরুতে ছিলো বন্ধুদের দ্বন্দ্ব। লিংকন আর সাজু ছিলো ডেথ মেটাল এর ফ্যান। মেটাল গান ছাড়া এক চুমুক চা তাদের পেটে পড়তো না। আর এরশাদ শুনতেন পিংক ফ্লয়েড। এক কথায় ফ্লয়েড পোকা। তার ফ্লয়েড নেশা মাথার ভেতরে ফ্লুয়েডের মতই যেচে ছিলো। আর সেজান ছিলেন আরেকটু ভিন্ন, পিংক ফ্লয়েড – কুইন্স – ড্রিম থিয়েটারের ফ্যান। তবে তাদের মিলটা ছিলো এক জায়গাতেই। সবাই ভালোবাসতেন মেটালিকা। তবে সেই বার সেজান বিজেতা হলেন। তারা প্রথবার স্টেজে উঠে কভার করলেন সেজানের পছন্দের ড্রিম থিয়েটারের “মেট্রোপলিস”। ভয় যতোটুক ছিলো পুষিয়ে নিয়েছিলেন, কারণ প্রথমবার স্টেজ শো করে ততটাও বাজে পারফর্ম করেনি আর্টসেল।
প্রথম অ্যালবামটা আসে ২০০২ এ। নাম অন্য সময়। অ্যালবামটা বেরোবার আগেই আর্টসেল হারায় তাদের একজন অদৃশ্য কিন্তু কাছের জন্য বন্ধুকে। তার নাম ছিলো রুপক। রুপক ছিলো তাদের ইউনিভার্সিটির বন্ধু। রুপককে আজকের এই আর্টসেল নামক অনুভূতির জন্ম কর্তা বললেও ভূল হবে না। ‘ভুল জন্ম, ‘অপ্সরা’ এই সব গুলোই রুপকের লেখা গান। ‘আমার পথ চলা’ শুরুটাও ছিলো রুপকের। শেষ করতে পারেননি। লিরিক্সের তৈরী হওয়ার আগেই পৃথিবীর বুকে পথ চলা থেমে গেছিলো রুপক নামের সেই অদ্ভুত ছেলেটার।
রুপকের কষ্ট পেরিয়ে বের হয় আর্টসেলের প্রথম অ্যালবাম ‘অন্য সময়’। অ্যালবামটা উৎসর্গ করা হয় রুপককে। আর সেই অন্য সময় থেকেই যাত্রা শুরু হয় আর্টসেল নাম অনুভূতির।
আর্টসেল অনুভূতির পেছনের আরেকজনের নাম রুম্মান। রুপকের মত তিনিও আর্টসেল অনুভূতির সৃষ্টিকর্তা। পাগল করা, “অনিকেত প্রান্তর” তারই লেখা। তবে অনিকেত প্রান্তর নিয়ে মজার একটা ব্যাপার আছে। অনিকেত প্রান্তর ছিলো পাঁচ পৃষ্ঠার একটা গান। সেখান থেকে কেটে কুটে দুই পৃষ্ঠায় আনা হয় আনিকেত প্রান্তর। আর তৈরী হয় ১৬ মিনিটের অনিকেত প্রান্তর।
লিরিসিস্ট রুপক-রুম্মান ছাড়াও একটা গান আছে আর্টসেলের। গানটার নাম ‘তোমাকে’। আর্টসেলের ফ্যান কিন্তু তোমাকে গানটা পছন্দ করেনা, এমন ফ্যান কি আদৌ পাওয়া যায়? না পাওয়া যায় না। আর এই অনবদ্য গানটাই লিখেছিলেন এরশাদ। তবে এই গানটা নিয়ে ভীতিকর ব্যাপারটা ছিলো গানটার লিরিক্স তৈরীর হওয়ার আগেই তৈরী হয়েছিলো গানটার প্লাকিং। আর সেখান থেকেই অনেকটা জোর করে বের করে আনা হয়েছিলো ‘তোমাকে’ গানের লিরিক্স। আর সবশেষে যা তৈরী হলো তা অনবদ্য একটা মিউজিকাল নোভেল।
একজন লিংকনের কথা !
পাগলাটে লিংকনের কথাই বলতে ভুলে গেছি। লিরিক্স ব্যাবচ্ছেদের পর গানটা রুপ পেত ওর হাতেই। সামান্য কিছু শব্দকে ও জীবন দিত। এক কথায় সুরের স্রষ্টা। যে স্রষ্টা জীবন দিয়েছে আমাদের হাজারো ভালোলাগার।
আর্টসেল হিসেবে প্রথম স্টেজে ওঠাটাও ছিলো সেই বন্ধুদের জন্য একটা গল্প। আর্টসেলের প্রথম অ্যালবাম তখনো রিলিজ হয়নি। কিন্তু স্টেজে উঠে আর্টসেল হতোবাক। তাদের সাথে মুখস্ত গান গেয়ে যাচ্ছে শ্রোতাদর্শক। আর সেই স্টেজ শো আর্টসেলের মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছিলো শতগুন।
আর এরকম হাজারো টুকরো টুকরো স্মৃতিতে গড়া আজকের আর্টসেল। যদিও আর্টসেলটা এখন আগের মতো নেই। সময়ের প্রয়োজনে আর্টসেলের দুই বন্ধু এখন দেশের বাহিরে। কেউ কেউ চাকরী পরিবার সন্তান নিয়ে ব্যাস্ত। তবুও আর্টসেল নামক অনুভূতি এখনো মরে যায়নি। এই অনূভূতি মৃত্যু দেখতে আসেনি। এই অনুভূতি বেচে থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।
#আর্টসেল যতটুক নয় একটি ব্যান্ডের নাম, ঠিক ততটুকই একটি অনুভূতির নাম !
যে অনুভুতি কখনো প্রকাশ পায় ‘ভুল জন্মে’ কখনোবা ‘লীন’ ‘ধূসর সময়ে’। সে অনুভূতিগুলো প্রকাশ হয়েছিলো ‘তোমাকে’ নিয়ে আমার ‘গন্তব্যহীন’ ‘ঘুণে খাওয়া রোদে’ ‘অবিরাম পথ চলায়’। যখন ‘ধূসর সময়’ গুলোতে তুমি ছিলেনা অনূভূতিগুলো ‘স্মৃতির স্বারকে’, ‘ছায়ার নিদান’ হয়ে আমায় নিয়ে গিয়েছিলো ‘অন্য সময়ে’ !
তবু ‘দুঃখবিলাস’ অনুভূতিগুলো হার মানেনি। ‘মুখোশের’ অন্তরালে আমায় করেছে ‘কৃত্রিম মানুষ’। যে আমি ‘অবশ অনুভুতির দেয়াল’ জড়িয়ে দেখতে চেয়েছিলাম এক ‘অনিকেত প্রান্তর’…
অগ্রিম শুভ জন্মদিন আর্টসেল !