চলচ্চিত্রে যৌন নির্যাতন

ভেবে দেখুন তো একটা গ্রামে কোনো মেয়ে মানুষ নেই। সব ছেলে মানুষ। ১০-১৫ বছর ধরে সেই গ্রামে কোনো বিয়ে হয়না। হবেই বা কি করে? মেয়ে ছাড়া তো বিয়ে সম্ভব না ! রান্না-বান্না থেকে শুরু করে যাবতীয় সব ঘরোয়া কাজকর্ম সব করে ছেলেরা। মেয়ের অভাব পূরণ করতে ছোট ছেলেদেরকে মেয়ে সাজিয়ে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হত।

হ্যাঁ, বলছিলাম ২০০৩ সালে মণিশ ঝা পরিচালিত সিনেমা “Matrubhoomi : A Nation without Women” আমার মতে এটি বলিউডের সবচেয়ে আন্ডার রেটেড সিনেমার একটি।

ভারতের বিহারের একটি গ্রাম। যেখানে কন্যা সন্তান জন্মের সাথে সাথে মেরে ফেলে হয়। সিনেমা শুরুই হয় এক বাচ্চা প্রসব হওয়ার দৃশ্য দিয়ে। গ্রামের এক মহিলা একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। কিন্তু সন্তানের পিতা কন্যা হওয়াতে খুশি নয়। কারণ সে চেয়েছিল একটা পুত্র সন্তান ! তাই হতাশ বাবা গ্রামের সব লোকজনের সামনে তার সেই কন্যা সন্তানকে দুধের মধ্যে ডুবিয়ে মেরে ফেলে। বুঝতেই পারছেন কতোটা নিষ্ঠূর হলে বাবা তার নিজ সন্তানকে হত্যা করতে পারে !! এই সিনেমার প্রতি পরতে পরতে আপনি খুজে পাবেন নিষ্ঠূরতা , বর্বরতা , হিংস্রতা ।

একটা সময় পুরো গ্রামটা হয়ে যায় নারীশুন্য। গ্রামে আর কোনো মেয়েমানুষ থাকে না। শুধু এই গ্রাম না। আশেপাশের কোন গ্রামেই কোনো মেয়ে নাই। মেয়েদের যাবতীয় সব কাজকর্ম তখন ছেলেরাই করে। নারীশুন্য একটা গ্রামে পুরুষরা বেপরোয়া হয়ে পরে। পুরুষরা তাদের জৈবিক চাহিদা মেটানোর জন্য লিপ্ত হয় সকল অনৈতিক কর্মকাণ্ডে। লিপ্ত হয় সমকামিতা, পর্ণোগ্রাফিতে। শুধু তাই নয় অবলা প্রানী গরুও তাদের সঙ্গমের হাত থেকে রেহায় পায়নি !

মাত্রুভূমি

এরকম বিভিন্ন নির্মম পরিস্থিতির মাঝে সিনেমার কাহিনী আগাতে থাকে । এরই মাঝে একদিন হঠাৎ গ্রামের পণ্ডিত মশাই একটা মেয়ের সন্ধান পান । মেয়েটির বাবা মেয়েটিকে লুকিয়ে রেখেছিল , জন্মের সাথে সাথেই হত্যা করে নি । মেয়েটির নাম কাল্কি । পণ্ডিত মশাই সেই কাল্কির খবর নিয়ে যায় রামচরণ নামের এক লোকের কাছে । রামচরণ গ্রামের প্রভাবশালী লোক । তার বিবাহযোগ্য পাঁচ জন ছেলে আছে । প্রথমে রামচরণ তার বড় ছেলের সাথে সেই মেয়ের বিয়ে দিতে চায় । কিন্তু কাল্কির বাবা বড় ছেলেকে পছন্দ করে না । ছোট ছেলেকে পছন্দ করে । কিন্তু বড় ছেলেকে রেখে ছোট ছেলের বিয়ে দেয়ার নিয়ম নেই । তাই রামচরণ একই সাথে তার পাঁচ ছেলের সাথে কাল্কির বিয়ে দেয় । হ্যাঁ ! পাঁচ জনের সাথে এক জনের বিয়ে ! বিনিময়ে কাল্কির বাবাকে পাঁচ লক্ষ টাকা আর পাঁচটি গরু যৌতুক হিসেবে দেয় ।

বিয়ের পর কাল্কির সাথে শুরু হয় ভয়ানক অত্যাচার ! এরকম নির্মম অত্যাচার যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয় ! বিয়ের পর কাল্কির সাথে কি হয় আর কাল্কি কি সেই ভয়ানক অত্যাচার থেকে রক্ষা পায় নাকি ? তা জানতে হলে আপনাকে সিনেমাটি দেখতে হবে ।

যুগে যুগে নারীরা নির্যাতিত হয়েছে , লাঞ্চিত হয়েছে । নারীদেরকে ব্যাবহার করা হয়েছে বাচ্চা উৎপাদন করার মেশিন হিসেবে ।যুগে যুগে নারীকে ব্যাবহার করা হয়েছে জৈবিক চাহিদা মেটানোর জন্যে । শিশুকে যেমন খেলনা দিয়ে ঘরের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখা হয় নারীকেও তেমনি তার গর্ভে ঘন ঘন কয়েকটি বাচ্চা দান করে রক্তের মমতা ও পরিবারের নানাবিধ কাজকর্মের দায়িত্ব ঘাড়ে চাপিয়ে তাকে বন্দি করা হয়। আমাদের সমাজে বিবাহিত নারীকে রাত্রির অন্ধকারে তার রোগা শরীরের উপর বুভুক্ষের মতো যৌনক্রিয়া চালানো ছাড়া আর কোন কাজে ব্যাবহার করা হয় না । আমাদের এই রক্ষণশীল এবং আধুনিক শিক্ষা বিবর্জিত সমাজে পুরুষের মনের চোখে নারী শুধুই ভোগের বস্তু । তাই নারীকে আড়াল করে রাখা একান্ত জরুরি। সে যার দখলে যাবে সে’ই তার ভোগের সামগ্রী হিসেবে ব্যবহৃত হবে । নারীর সকল আশা আকাঙ্খা ও প্রতিভাকে বিকশিত করার কোনো মুক্ত সুযোগ না দিয়েই তাকে দাসী হিসেবে পাষাণ পর্দা ও পরিবারের গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখা হয় । একজন নারী সারাজিবন পুরুষের কামনাকে প্রশান্ত করার দৈহিক উপাদান হিসেবে বেঁচে থাকে । এছাড়া তার আর কিছুই করার থাকে না ।

Matrubhoomi

সিনেমার মূল চরিত্রে (কাল্কি) অভিনয় করেছে টিউলিপ জোশি । নিজের সবটা দিয়েছেন চরিত্রের জন্য । এছাড়াও বাকি সবাই যার যার চরিত্রে যথেষ্ট ভালো অভিনয় করেছে ।

সিনেমাটি রিলিজের পর পরিচালক মনিষ ঝা অনেক সমালোচিত হন । কিন্তু তারপরেও ২০০৩ এর টরেন্টো ফিল্ম ফেস্টিভালে অনেক গুলো এওয়ার্ড বগলদাবা করেছেন । সিনেমাটি ভারতে হিন্দি, বাংলা ,তেলেগু , ভোজপুরী , তামিল এবং গুজরাটি এই ছয় ভাষায় রিলিজ হয় ।