আমাদের সবার জীবনেই এমন একটা সময় আসে, যখন বেঁচে থাকার আর কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। মাথায় আসে আত্মহত্যা করার ভাবনা ! ইচ্ছে হয়, এখানেই সব থেমে যাক। বহুদিনের পুরনো বন্ধু, আমাদের বাবা-মা, ভাইবোন সহ পরিবারের কারো কোনো কথাই এসময় আমাদের ভালো লাগেনা। বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম যে ইচ্ছেটা থাকা দরকার, কোনো না কোনো কারণে সেটাও মরে যায়। হয়ত জীবনে সফলতা না পেয়ে অথবা কারো দ্বারা বিশ্বাস ভেঙ্গে গেলে, আমারা বঞ্চিত হলে কোন কিছু থেকে তখন খুবই স্বাভাবিক এরকম একটি সময় নিজেকে শেষ করে দেবার চিন্তা করা।
আত্মহত্যা হচ্ছে একটি কমদামী অংক। নিজের জীবন শেষ করার মত এমন কোনো কারণ কখনোই থাকতে পারেনা এবং কোনোদিনই থাকতে পারেনা। পরিস্থিতির শিকার হয়ে কিছু মানুষ সাধারণ বিষয়গুলোকে অনেক বড় করে দেখে ফেলে। এই বিষয়গুলোকেই “নিজেকে শেষ করে দেয়ার মত যথেষ্ট কারণ” হিসেবে মেনে নিয়ে মানুষ আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। যারা আত্মহত্যা করে থাকেন, তাদের মধ্যে প্রায় ৯০% মানুষ মানসিক সমস্যায় ভুগেন।
মানসিক সমস্যা ছাড়াও আত্মহত্যার কথা বলা, চেষ্টা করা বা পদক্ষেপ নেয়ার জন্য কিছু কারণ রয়েছে –
- পূর্ববর্তী আত্মহত্যার চেষ্টা
- কারো দ্বারা অপব্যবহার হলে
- কারারুদ্ধ অবস্থায় থাকলে
- আত্মহত্যার পারিবারিক ইতিহাস থাকলে
- চাকরীর নিরাপত্তাহীনতা বা নিন্মপদস্থ চাকরী হলে
- নির্যাতনের শিকার হলে বা ক্রমাগত নির্যাতিত হলে
- গুরুতর কোনো ব্যাধি হলে
- সামাজিকভাবে বর্জিত হলে
- সবার সামনে হেয় প্রতিপন্ন হলে
যাদের মধ্যে আত্মহত্যা করার প্রবণতা বেশি থাকে –
- নারীদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি থাকে।
- ৪৫ বছর কিংবা এর অধিক বয়সী মানুষের মধ্যে এই সম্ভাবনা বেশি থাকে।
এক গবেষণায়, আত্মহত্যা করার প্রবণতার পেছনে থাকা কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বেশ কয়েকটি কারণ পাওয়া গেছে –
- আশাহীন অবস্থায় থাকা
- নিজেকে সবসময় অসহায় মনে করা
- একা থাকা
- অতিরিক্ত চিন্তা করা
- বেঁচে থাকার মত কারণ খুঁজে না পাওয়া
- খুব দ্রুত মানসিক স্থিতিশীলতা হারানো
- দীর্ঘদিন নেশাগ্রস্থ থাকা
এসমস্ত কারণ ছাড়াও রয়েছে আমাদের সমাজগত কিছু ব্যাপার, যার কারণে অনেক মানুষই আত্মহত্যার কথা ভেবে থাকেন –
- অনেকদিনের মূল্যবান কোনো সম্পর্ক হারিয়ে গেলে
- সবার সামনে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য হলে
- সবসময় নিজের অক্ষমতা অন্যদের জন্য হাসির কারণ হলে
- দীর্ঘদিন বেকার থাকলে
- কারো কাছে সাহায্য চেয়ে না পেলে
আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে সবার আগে উপরে আলোচিত এই সমস্যাগুলোর সমাধান করা প্রয়োজন। এসব সমস্যাগুলোর প্রতিকার করা গেলে আত্মহত্যা অনেকাংশে কমে যাবে। আর এজন্য সচেষ্ট এবং সোচ্চার হতে হবে আমাদের সবাইকে !
কিভাবে এসব সমস্যা থেকে নিজে বের হবেন, বা অন্যকে বের হতে সাহায্য করবেন?
- কথা বলুন, সবার সাথে মিশুন। নিজের কথা, নিজের অবস্থা অন্যকে জানান।
- ভাল বন্ধু বানান। তাদের নিয়ে ঘুরে বেড়ান, আড্ডা দিন।
- মেডিটেশন করুন (এন্টি ডিপ্রেশন, এন্টি সাইকোটিক, এন্টি-এংজ্যাইটি মেডিটেশন)
- লাইফ স্টাইল পরিবর্তন করুন। স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান হন।
- মাদক বা যেকোনো প্রকার নেশায় আসক্তি থাকলে তা ছেড়ে দিন।
- ঠিকমত ঘুমানোর অভ্যাস করুন।
হঠাৎ করেই যদি আত্মহত্যার ইচ্ছে হয়, তখন কি করবেন?
- আশেপাশে যে আছে, তার সাথে কথা বলুন
- কেউ না থাকলে নিজের ভালো কোনো বন্ধুকে ফোন করুন
- ভালো স্মৃতিগুলো ভাবুন। খুঁজে বের করুন সেই সময়ের মানুষদের !
- দ্রুত লোকালয়ে চলে আসুন। কখনোই একা থাকবেন না
- পরিচিত কোনো ডাক্তার থাকলে তার সাথে যোগাযোগ করুন
- সর্বোপরি শান্ত থাকার চেষ্টা করুন
- হাতের কাছে ধারাল কিছু থাকলে তা সরিয়ে ফেলুন, বা সেই জায়গা থেকে নিজে বের হয়ে আসুন।
পরিশেষে আর একটা কাজই করার থাকে। সেটা হচ্ছে, নিজেকে ভালোবাসুন। হ্যাঁ, নিজেকে সবসময় ভালবাসুন, নিজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন। আপনি তাদের কথা ভাবুন, যারা আপনার মত এভাবে আত্মহত্যা করে সব কিছু শেষ করে দিতে চায়। তাদের পরিবারের কথা ভাবুন। একবার মিলিয়ে দেখুন, আপনি না থাকলে আপনাকে ভালোবাসা সেই মানুষগুলোর কি হবে, যারা সেই ছোট্ট আপনাকে এত বড় করেছে। যারা আপনার পাশে থেকে এতদুর পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। সেই প্রতিটা মুখের কথা ভাবুন। আর ভাবুন, কিভাবে নিজে বেঁচে থেকে আরেকটা মানুষের জীবন বাঁচানো যায়…
চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়, বিচ্ছেদ নয়
চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন করা আর্দ্র রজনী
চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে
আমার না-থাকা জুড়ে…– রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ