আপনার যদি কখনো স্লিপ প্যারালাইসিস হয়ে থাকে, তাহলে আপনি অবশ্যই বলবেন, এটা ছিলো নিঃসন্দেহে আপনার জীবনের অন্যতম ভয়ংকর একটি অভিজ্ঞতা, যা কখনোই ভুলে যাবার নয় !
বলাটাই স্বাভাবিক। কারণ এরকম হলে আপনার শরীর নিশ্চল হয়ে যায়, হাত-পা অথবা মাথা নাড়াতে পারেন না আপনি। শব্দ করতে চাইলেও মুখ খুলতে পারেন না। আপনার শ্বাসকষ্ট হয় এবং মনে হয় যেনো বুকের উপরে কিছু একটা চেপে বসে আছে। এই অনুভূতির ফলে স্বভাবতই আপনি ভয় পেয়ে যান। পুরো সময়টা জুড়ে এমন মনে হয়, যেনো অবাস্তব কিছু আপনার কক্ষে উপস্থিত হয়েছে। মূলত এই সমস্যাটিই হচ্ছে স্লিপ প্যারালাইসিস (Sleep Paralysis Symptoms) !
স্লিপ প্যারালাইসিসকে প্যারাসমনিয়াও বলা হয়। এটি আসলে বিপদজনক নয় এবং কোন মারাত্মক রোগের উপসর্গ নয়। স্লিপ প্যারালাইসিস নারকোলেপ্সি এর লক্ষণ। নারকোলেপ্সি এমন এক ধরনের রোগ যাতে আক্রান্ত রোগি প্রায়ই আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। কিন্তু অনেক স্লিপ প্যারালাইসিসই নারকোলেপ্সি বা অন্য কোন স্লিপ ডিজঅর্ডারের কারণে হয় না। স্লিপ প্যারালাইসিস এর পর্বটি কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট পর্যন্ত হতে পারে। ঘুম থেকে জেগে যাওয়ার সময় বা ঘুম আসার সময় হতে পারে স্লিপ প্যারালাইসিস। ঘুমের এই সমস্যাটির কারণ এখনো অজানা রয়ে গেছে। স্লিপ প্যারালাইসিসের ঘটনাটি ঘটে থাকে সাধারণত ঘুমের বিভিন্ন স্তরের মধ্যকার রূপান্তরের কারণে। নির্দিষ্টভাবে র্যাম (REM) স্লিপ এর স্তরে প্রবেশ করা ও বাহির হওয়ার সময়ে।
REM স্লিপ এর সময় আপনার শরীর প্যারালাইসিসের এমন একটি পর্যায়ে যায়, যাকে রেম অ্যাটোনিয়া বলে। এটি ঘুমের একটি স্বাভাবিক অংশ, যেখানে শরীরের প্রধান পেশীগুলো অবশ হয়ে যায়। ঘুমের সময় শরীরে যেন কোন আঘাত না লাগে সেজন্যই হয়ে থাকে এ রনের প্যারালাইসিস। REM অবস্থাতেই মানুষ স্বপ্ন দেখে।
ঘুম বিজ্ঞানীগণ বিশ্বাস করেন যে, REM স্লিপ এ প্রবেশ করা ও বাহির হওয়া এবং ঘুমের অন্যান্য পর্বগুলো যদি সঠিকভাবে সম্পন্ন না হয় তাহলে স্লিপ প্যারালাইসিস হয়। ঘুমের মধ্যে পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থা সাধারণত REM স্লিপ এবং ঘুমের অন্য পর্যায়েরও সময় হয়ে থাকে। সেসময় যদি আপনি জেগে যান, তাহলে আপনি আপনার শরীরের পক্ষাঘাতের বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠেন। এবং কথা বলতে বা নড়াচড়া করতে পারেন না বলেই ভয় পেয়ে যান। স্লিপ প্যারালাইসিসের কারণে হ্যালুসিনেশন ও হতে পারে। মানুষ প্রায়ই এধরনের অভিজ্ঞতাকে তার কক্ষে ভূতের উপস্থিতির অনুভূতির মত বলেন। এই হ্যালুসিনেশনের কারণে মানুষ অদ্ভুত শব্দ এবং গন্ধ পান, পড়ে যাওয়া বা ওড়ার অভিজ্ঞতার কথাও বলেন অনেকে। যদিও স্লিপ প্যারালাইসিসের ঘটনা শ্বাস প্রক্রিয়ায় কোন সমস্যা সৃষ্টি করেনা। কখনো কখনো মানুষ শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসার কথা বলেন এবং বুকের উপর অনেক চাপ অনুভব করার কথাও বলেন। স্লিপ প্যারালাইসিসের অভিজ্ঞতাটি খুবই ভয়ংকর হতে পারে, বিশেষ করে যদি তা প্রথমবার হয়ে থাকে।
আপনার যদি এই অভিজ্ঞতাটি হয়ে থাকে তাহলে আপনি একা নন। জীবনের যেকোন পর্যায়েই এটি হওয়া স্বাভাবিক একটি ঘটনা। ৬৫ শতাংশ মানুষই স্লিপ প্যারালাইসিসের সমস্যায় ভুগে থাকেন জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে। এ ধরনের ঘটনা একজন মানুষের জীবনে ১/২ বার হতে পারে, আবার কারো কারো ক্ষেত্রে তা ঘন ঘন হতে পারে। নির্দিষ্ট কিছু মানুষ এই ভয়ংকর ঘুমের সমস্যার ঝুঁকিতে থাকেন। যাদের বিঘ্নিত ঘুম চক্র এর সমস্যা আছে, আঘাত পেয়ে থাকলে, উদ্বিগ্নতা বা বিষণ্ণতায় ভুগলেও স্লিপ প্যারালাইসিসের সমস্যা হতে পারে।
নতুন গবেষণায় স্লিপ প্যারালাইসিসের সম্ভাব্য কারণগুলোর বিষয়ে অনুসন্ধান করা হয়েছে এবং এর ফলাফলে নির্দেশ করা হয়েছে যে, জেনেটিক কারণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীরা স্লিপ প্যারালাইসিসের ক্ষেত্রে বংশগতির ভূমিকা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন ৮৬২ জন যমজ ভাইবোনের উপর। অংশগ্রহণকারীদের বয়স ছিলো ২২ থেকে ৩২ বছরের মধ্যে।
গবেষকেরা অভিন্ন যমজ, ভিন্ন চেহারার যমজ এবং ভাইবোনদের মধ্যকার স্লিপ প্যারালাইসিসের ঘটনার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখেন। তারা দেখেন যে, অভিন্ন যমজদের মধ্যে একই রকম DNA থাকে, ভিন্ন চেহারার যমজ এবং সহোদর ভাইবোনদের মধ্যে ৫০ শতাংশ DNA থাকে প্রায় একই রকম। তাদের পর্যালোচনায় তারা এটাই খুঁজে পান যে, স্লিপ প্যারালাইসিসের ঘটনার ৫৩ শতাংশই জেনেটিক কারণে হয়েছিলো।
গবেষকেরা জেনেটিক লিংক এর বিষয়টি আরো ভালোভাবে বোঝার জন্য জিনের বিভিন্ন রুপ গুলোর প্রতি নজর দেন যা সারকাডিয়ান রিদম নিয়ন্ত্রণের সাথে সম্পর্কিত। সারকাডিয়ান রিদম হচ্ছে ২৪ ঘন্টার জৈবিক ছন্দ যা ঘুম-জাগরণ চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। তারা আবিস্কার করেন যে, PER2 জিন এর নির্দিষ্ট প্রকরণ ছিলো যাদের তাদের স্লিপ প্যারালাইসিস হওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছিলো বেশি। এছাড়াও ঘুমের সমস্যা, উদ্বিগ্নতা, স্ট্রেস বা মানসিক বা শারীরিক আঘাতের অভিজ্ঞতা ছিলো যাদের তাদের মধ্যে স্লিপ প্যারালাইসিস হওয়ার প্রবণতা বেশি ছিলো।
স্লিপ প্যারালাইসিস হওয়ার সম্ভাবনাকে কমানোর উপায়
- স্বাস্থ্যকর ঘুমের প্রতি ফোকাস করা
- নিয়মিত ঘুমের রুটিন মেনে চলা
- উদ্দীপক এড়িয়ে চলা (বিশেষ করে অ্যালকোহল)
- নিয়মিত ব্যায়াম করা
- ভালোভাবে খাওয়া এবং রাতে দেরি করে খাওয়া এড়িয়ে চলা
- স্ট্রেস ও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেয়া
- উদ্বিগ্নতা এবং বিষণ্ণতা দ্রুত কাটিয়ে উঠা
এই সমস্যাগুলো হয়ত আপনি একাই ঘরে বসে সমাধান করতে পারবেন না। তাই এর জন্য চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে নিন। কেবলমাত্র এই সমস্যাগুলো সমাধানের মাধ্যমেই ভালো ঘুম হওয়া সম্ভব। যা কিনা স্লিপ প্যারালাইসিসকে এড়িয়ে চলতে আপনাকে অনেকদুর সাহায্য করবে।
যদি আপনার স্লিপ প্যারালাইসিসের সমস্যা হয়, তাহলে আতংকিত হবেন না। নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিন যে, যদিও এটি ভয়ংকর এবং উত্তেজনা সৃষ্টিকারী একটি অভিজ্ঞতা, তারপরও এটি অস্থায়ী এবং অক্ষতিকর একটি সমস্যা, যা খুব তাড়াতাড়ি দূর হয়ে যাবে। কি হচ্ছে তা বুঝতে পারলে ঘুমের সাথে সম্পর্কিত ভয়ের সমসZfটিকে মানসিকভাবে এড়িয়ে যেতে পারবেন।