নারীদের পথেঘাটে কর্মস্থলে নীরব যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়াটা এদেশে নতুন কিছু নয়। ঘুম থেকে উঠে কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বেরোনো মাত্রই তার শরীরের উপর পড়তে শুরু করে তথাকথিত পুরুষ ট্যাগধারী পশুদের নখের আঁচড়। তারপর বাসে উঠার সময় পিঠে হেলপারের হাত রাখা থেকে শুরু করে ‘নারীদের জন্য সংরক্ষিত সিট’ না পেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাতায়াতের পুরোটা সময় ধাক্কা খাওয়ার বিষয়টা তো রয়েছেই। কর্মস্থলে নেমেও শান্তি নেই তাদের। কর্মস্থলকে নিজের ঘরের মত নিরাপদ ভাবতে পারেনা তারা। ভাববেই বা কিভাবে? সহকর্মী থেকে শুরু করে অফিসের দারোয়ানের লোলূপ দৃষ্টি পর্যন্ত ছাড় দেয় না তাদের। অভিযোগ কাকে জানাবে? উপরে ভারী চেয়ার নিয়ে বসে থাকা অফিসাররাও তো সুযোগ বুঝে ফাঁদে ফেলে গায়ে হাত দিতে ভুলে না।
এই নির্যাতনের হাত থেকে বাদ পড়েনা কেেই। স্কুল কলেজ ভার্সিটির স্টুডেন্ট থেকে শুরু করে চাকরীজীবি নারী, এমন কি গার্মেন্টসকর্মীরাও এই নীরব যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে প্রতিদিন প্রতিক্ষণ প্রতিটা মুহুূর্তে !
ফিরে আসি আগের প্রসঙ্গে…
বাসে উঠতে গিয়ে কখনো কখনো এমনটাও হয় যে‚ একই পরিবারের মা, বোন‚ দাদী বা নাতনী বাসে উঠতে গিয়ে শরীরের স্পর্শকাতর জায়গায় হেলপারের হাতের স্পর্শ অনুভব করে। কিন্তুু একজন আরেকজনের দিকে লজ্জা এবং ভীত চোখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় খুঁজে পায় না ! হেলপাররা নারীদের বাসে উঠানোর সময় এই বিকৃত যৌন হেনস্তা করে থাকেন। বাসের দরজায় দাঁড়িয়ে যাত্রী উঠার সময় খুব সচেতনভাবে নারীদের পিঠে হাত রাখেন হেলপারেরা। আর ওই কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই ঘটে যায় যৌন হেনস্তার মত ঘৃণিত একটা ব্যাপার।
প্রায় সব মেয়েই এই নির্যাতনের শিকার হলেও তেমন কেউই চক্ষুলজ্জার কারণে মুখ খুলতে চায় না। এছাড়াও রয়েছে সামাজিক এবং পারিবারিক নানান রকমের বাধ্যবাধকতা। আর বছরের পর বছর এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে হেলপারেরা তাদের নীরব যৌন নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে।
সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপারপ হলো‚ এসব যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করেও পরিবার এবং প্রশাসনের কাছে উল্টো হেনস্তার শিকার হন ভুক্তভোগী নারীরা।
২০১৬ সালের মে-জুন মাসে নারায়ণগঞ্জসহ দেশের সাতটি বিভাগীয় শহরে ৮০০ জন নারী ও কিশোরী এবং ৪০০ জন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের মধ্যে যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া নিয়ে বিশেষ এ গবেষণাটি চালানো হয়। এই গবেষণার কাজে অর্থায়ন করেছে বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশন এইড। এ থেকে প্রাপ্ত জরীপে দেখা যায়, দেশের ৯৫ শতাংশ নারী মনে করেন, পুলিশি সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে হেনস্তার শিকার হতে হয়। যৌন নির্যাতনের শিকার ৮৪ শতাংশ নারী এব্যাপারে কোথাও অভিযোগ করা দরকার বলে মনেই করেন না। উত্তরদাতাদের ৬৫ শতাংশ মনে করেন, পুলিশ নাকি অভিযোগকারীকেই দোষারোপ করে। ৫৭ শতাংশের মতে মামলা নিতে পুলিশ গড়িমসি করে, ৫৩ শতাংশের মতে অভিযোগ করে কোনো ফল পাওয়া যায় না। আর পুলিশ কর্তৃক পুনরায় হয়রানির আশঙ্কায় ৩০ শতাংশ নারীই কোনো অভিযোগ করেন না !
বছরের পর বছর ধরে বাসের হেলপারদের কাছে নারী যাত্রীরা যেই নীরব যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে, তার সমাধানের জন্য আমাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। আপনার পাশের নারীটিকে নিরাপদ রাখার দায়িত্ব আপনার। প্রশাসনকে অভিযোগ না নেয়ার ব্যাপারে দোষারোপ করতে চাচ্ছিনা। তবে হ্যাঁ, অনুরোধ জানাচ্ছি এ নীরব যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে তারা কোনো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করুক বা না করুক, অন্তত নিরাপদ যাতায়াতের সুবিধার্থে নারীদের জন্য আলাদা বাসের ব্যবস্থা করুক। আমরা চাইলেই পারি এই সমস্যাগুলোর সমাধানের রাস্তা বের করে আনতে। চাইলেই পারি এই সমস্যাগুলো সমাধার করতে। প্রয়োজন সচেতনতার…
এই রাষ্ট্রের কোথাও কোনো নারী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারবেনা। ঘরে কিংবা বাইরে, সবখানেই নারীরা থাকুক শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার পবিত্র স্থানে !