যুগ যুগ ধরে প্রচলন চলে আসছে মূত্যুর পর মানুষের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার। ধর্ম বর্ণ ভেদে বর্তমান বিশ্বে আমাদের কাছেই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মাধ্যম হিসেবে কবরে সমাহিত করা বা আগুনে দাহ করার দুটি পদ্ধতিই সর্বাধিক পরিচিত। কিন্তু এতটা সহজ রীতি সবসময় ছিলো না। প্রাচীনকালের রীতি নীতিগুলো মোটামুটি সহজ মনে হলেও মধ্যযুগ ছিলো বর্বর। সে সময় নানান উদ্ভট, বিকৃত ও সৃজনশীল প্রক্রিয়ায় মরদেহের শেষকৃত্য করা হত, যা শুনে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। শকুন দিয়ে লাশের মাংস খাওয়ানো থেকে শুরু করে মৃতদেহ মণ্ডে প্রহার করা পর্যন্ত – মৃতদের সৎকার করার উদ্ভট সব প্রথা প্রচলিত ছিলো একসময়। এমনই কয়েকটি অস্বাভাবিক রীতি নিয়ে আজকের এই প্রতিবেদন। পড়ুন বিস্তারিত…
প্রিয়জনের মৃত্যুতে নিজের আঙুল কেটে ফেলা
পাপুয়া নিউ গিনির দানি সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে প্রিয়জনের মৃত্যু হয়েছে বোঝাতে মৃতের সঙ্গে সম্পর্কিত যেকোনো জীবিত নারী ও শিশুকে নিজের একটি করে আঙ্গুল কাটতে হয়। তাদের ধারণা, আঙ্গুল কেটে ফেলার মাধ্যমে প্রিয়জনের আত্মার কুদৃষ্টি থেকে মুক্তি পাওয়া যায় বা অশুভ আত্মাকে দূরীভূত করা যায়। তবে বর্তমানে এই রীতিটি নিষিদ্ধ হয়েছে।
মৃতের চোখ বেঁধে প্রবেশদ্বারে ঝুলিয়ে রাখা
নর্থওয়েস্টার্ন ফিলিপাইনের বেনগেট গোত্রের লোকেরা তাদের পরিবারের কেউ মারা গেলে তার চোখ খুলে রেখে দেয় এবং তা বাড়ির দরজার সামনে বেধে ঝুলিয়ে রাখে। তাদের বিশ্বাস, এর মাধ্যমে বাড়িতে মৃত প্রিয়জনের আত্মার যাতায়াত থেকে তারা রক্ষা পাবে।
মৃতকে রঙিন পুঁতিতে রুপান্তরিত করা
দক্ষিণ কোরিয়ায় অনেকে মৃত ব্যক্তির দেহাবশেষ কম্প্রেস করে বিভিন্ন রঙের রত্ন সাদৃশ্য পুঁতিতে পরিণত করেন, যা পরে বাড়িতে প্রদর্শন করা হয়। প্রিয়জনকে ভালোবেসে অমর করে রাখার জন্যই নাকি তাদের এই প্রয়াস। তারা কখনো আপনজনদের পঁচাগলা ফুলে ফেপে ওঠা দেহের কথা ভাবতে পারেন না।
মৃত ব্যক্তির দেহাবশেষ খেয়ে ফেলা
আগেকার দিনে পাপুয়া নিউ গিনির মেলানসিয়ান এবং ব্রাজিলের ওয়ারী গোত্রের মানুষেরা ভয় এবং মৃত্যুর ধারণা ঘিরে থাকা রহস্যকে বিতাড়িত করার জন্য মৃত ব্যক্তির দেহাবশেষ খেয়ে ফেলতেন। ইয়ানোমামী গোত্রের লোকদেরও এই অভ্যাস ছিল।
মৃতের হাড় ঘিরে নৃত্য করা
মাদাগাস্কারের মালাগাসি গোত্রের মানুষেরা প্রতি ৭ বছরে একবার তাদের মৃত স্বজনদের হাড় কবর থেকে উত্তোলন করে। এই হাড়গুলো সাজা কাপড়ে মুড়িয়ে নিয়ে তারা হাড়গুলো কাঁধে তুলে নাচ গান করে। লাশের হাড়গোড় অত্যন্ত বাজে গন্ধ ছড়ায়। তাই তারা এর উপর ওয়াইন স্প্রে করে। উৎসব শেষে তারা তাদের অন্য এলাকার পরিবার পরিজনের কাছে গিয়ে সে গল্প শোনায়।
উদ্ভট কফিনে সমাহিত করা
ঘানার জনগণ মৃত ব্যক্তির জীবনকে প্রতিনিধিত্ব করে এমন ধরনের কফিনে তাকে সমাহিত করে। যেমন পাইলটকে বিমান আকারের কফিনে, জেলেকে মাছের আকৃতির কফিনে, গাড়ি ব্যবসায়ীকে মার্সেডিজ গাড়ি আকৃতির কফিনে সমাহিত করে।
মৃতদেহ পাখিদের অর্পণ করা
তিব্বতে বিশেষ করে বৌদ্ধরা মাঝে মাঝে মৃত ব্যক্তির শরীর টুকরো টুকরো করে কেটে পাখিকে তৃপ্তি করার জন্য একটি পাহাড়ের ওপর রেখে আসে। বৌদ্ধরা মৃত ব্যক্তির দেহাবশেষকে খালি পাত্র হিসেবে বিবেচনা করে এই আকাশ সমাধিকে দানশীলতা এবং সমবেদনা হিসেবে দেখে।
মৃতের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় জাজ সংগীত
বড় বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে সংগীত সংস্কৃতি ম্যাক্সিকোর নিউ অর্লিন্স এর মানুষের হৃদয়ের সঙ্গে মিশে আছে। এমনকি এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, তারা কেউ মারা গেলেও সংগীত বাজায়। মৃতের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া যাত্রার শুরুতেই থাকে বড় বাদ্যযন্ত্রের ব্যান্ড, যারা প্রথমে বিষণ্ণ সুর বাজায় এবং যা ক্রমান্বয়ে আনন্দময় জ্যাজ ও ব্লুজ সংগীতে পরিণত হয়, সঙ্গে শুরু হয় নাচ।
মৃতকে জীবন্ত মানুষের মতো সাজানো
ফিলিপাইনের টিংগুইন গোত্রের মানুষেরা মৃতদেহে তাদের সেরা পোশাক পড়ায়, তাদের একটি চেয়ারের ওপর বসায় এবং তাদের ঠোঁটে একটি জ্বলন্ত সিগারেট ধরিয়ে দেয়।
গাছের ফোঁকরে সমাধি
ম্যানিলার কাছাকাছি বসবাস করা ক্যাভিটেনো সম্প্রদায়ের লোকেরা নিস্প্রাণ গাছের কোটরে মৃতদেহ সমাহিত করে। ব্যক্তির মৃত্যুর আগেই গাছটি নির্বাচন করা হয়ে থাকে।
রান্নাঘরে সমাধি
উত্তর ফিলিপাইনে বসবাসকারী অ্যাপায়ো সম্প্রদায়ের লোকেরা নিজেদের রান্নাঘরের মধ্যে মৃতদেহ কবর দেয়।
পরিবেশবান্ধব সমাধি
এই পদ্ধতিতে কফিনে সুবাসিত করার পদ্ধতি বাদ দিয়ে, জীবাণুবিয়োজ্য পেতে হাতে বোনা বেতের কফিনে মৃতদেহ সমাহিত করা হয়, যা মাটিতেই পঁচে যাবে।
শকুন দ্বারা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া
প্রায় ৩৫০০ বছর আগে পার্শি ধর্মগ্রন্থ জেন্দাবেস্তার বর্ণিত জরথুস্ট্রের আমলে মৃতদেহকে প্রথমে ষাঁড়ের প্রস্রাব দিয়ে ধৌত করা হতো, যা পরে কুকুর দ্বারা পরিদর্শন করানো হতো। তারপর নীরবতাপূর্ণ একটি দুর্গের ওপরে মৃত রাখা হতো, যেখানে এটিকে শকুন দ্রুতগতিতে খেয়ে ফেলতে পারে।
প্রতীক চিহ্নে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া
উত্তর আমেরিকার হাইডা সম্প্রদায়ের মানুষেরা তাদের প্রধান ব্যক্তি কিংবা ওঝার মৃত্যুতে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো। সেখানে মৃত্দেহ চূর্ন করে বাক্স বন্দি করে, বাক্সটি মৃত ব্যক্তির বাড়ির সামনে তাদের গ্রোত্রের প্রতীক চিহ্ন আকারে স্থাপন করে রাখা হতো।