খুব ছোটবেলা থেকে এন্টারটেইনমেন্ট হিসেবে আমরা দুটো জিনিসের সাথে পরিচিত হই। বলিউড সিনেমা এবং বলিউড সিনেমার ‘খান’। কোন খান কতোবড় হিরো সেটা নিয়ে ছোটবেলায় আমার স্কুলের বন্ধুদের সাথে আমার মারামারি লেগে যেত। সালমান খানের এক ঘুষিতে দশজনকে ফেলা দেয়া অ্যাকশন নাকি শাহরুখ খানের দু-হাত ছড়ানো রোমান্স কোনটার মধ্যে ‘হিরো’ইজম বেশি সে নিয়ে কি তুমুল তর্ক! এরপরে যখন বড় হতে শুরু করলাম, তখন পরিচয় হলো নতুন এক ‘খানের’সাথে। এই ‘খান’ ঠিক অন্য ‘খান’দের মতো না। সে ঠিক আপনার, আমার মতো। কখনো সে আমাদের সাথে বাসে ওঠা মাঝবয়সী একটা মানুষের মতো, কখনো সে গাউছিয়ার দোকানের কোনও শাড়ি বিক্রেতার মতো। সে ঠিক ‘নায়ক’ না, সে কোন ফ্যান্টাসিও না। সে আপনার আর আমার মতো একজন মানুষ। তার নাম ইরফান খান। শৈশবের রঙিন চশমা চোখ থেকে সরতে সরতে যতোই বাস্তবতাকে চিনতে শিখলাম, ততোই ফ্যান্টাসির ফেরিওয়ালা হিরোদের চেয়ে, এই ‘ এভরিম্যান’ ক্যারেক্টার করা মানুষটা মনে জায়গা করে নিতে শুরু করলো। বাংলাদেশে সিনেমাকে ভালোবাসা একটা পুরো জেনারেশনকে ‘হিরো’ এবং ‘অ্যাক্টরের’ মধ্যে পার্থক্য করতে শিখিয়েছেন ইরফান খান। আমি এখন কথা বলবো ইরফান খানের অভিনীত আমার প্রিয় পাঁচটি চরিত্রকে নিয়ে। যেই চরিত্রগুলো আমার গল্প বলে, আমাদের গল্প বলে।
The Lunchbox ( Saajan Fernandes)
ধাক্কা-ধাক্কি করে যখন বাসে ওঠেন, আপনার পাশে দাঁড়ানো কাঁচা পাকা চুলের মানুষটার দিকে কখনো ভালো করে তাকিয়ে দেখেছেন? মাঝবয়সী মানুষের জীবনের ইমোশন নিয়ে আপনি আমি কিন্তু খুব একটা চিন্তিত না। আপনার-আমার কাছে এই ধরনের মানুষের জীবনের সেট একটা টেমপ্লেট আছে। সে সকালে অফিস যাবে, বিকালে বাসে ফিরবে, বউ-বাচ্চাকে নিয়ে সময় কাটাবে।
Saajan Fernandes এর সাথে পরিচিত হওয়ার পরদিন থেকে, আপনার পাশে দাঁড়ানো পাশে সেই কাঁচা-পাকা চুলের মানুষটার দিকে আপনি নতুনভাবে তাকাবেন। তার জীবনেও নতুন করে খুঁজে পাওয়া ভালোবাসার আনন্দ থাকতে পারে, ভালোবাসার মানুষটার সাথে প্রথমবার দেখা হওয়ার এক্সাইটমেন্ট থাকতে পারে, সেই মানুষটাকে হারানোর ভয় থাকতে পারে, এই প্রতিটা বিষয়ে আপনাকে ভাবতে বাধ্য করবে The Lunchbox এ ইরফান খানের এফোর্টলেস অ্যাকটিং। রিতেশ বাত্রার এই সিনেমাটা ঠিক সিনেমা না, মুম্বাই শহর এবং মুম্বাই শহরের মানুষের প্রতি একটা প্রেমের কবিতার মতো। এবং সেই কবিতার প্রধান কবি হচ্ছেন ইরফান খান। চিঠি আদান-প্রদানের মাধ্যমে এগিয়ে চলে একটা ভালোবাসার গল্প, এবং সেই গল্পে ইরফান খানের ভয়েস ওভারে ‘ডিয়ার ইলা’ শব্দটা শোনার পর থেকে আপনার মনে হবে আপনি সেই মানুষটার পাশেই বসে আছেন, কানপেতে শুনছেন কিভাবে খাবারের ঝালের পরিমাণের মতো ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে কথা বলতে বলতে তৈরি হচ্ছে দুটো মানুষের অতি সাধারণ একটা ভালোবাসার গল্প। আপনার ভালোবাসার গল্পের সাথে যদি গল্পটি মিলে যায়, অবাক হবেন না মোটেও। শুরুতেই বললাম না, ইরফান খান আপনার গল্পই বলতে এসেছিলেন।
Piku (Rana)
অনেক সিনেমা বোদ্ধাদের মতে ‘Great acting is reacting’ । সুজিত সরকার পরিচালিত পিকু সিনেমায় ইরফানের রিঅ্যাক্টিং অ্যাবিলিটি একদম ফুল ডিসপ্লেতে আপনি দেখতে পাবেন। দুই রগচটা বাঙলীর সাথে একজন দিল্লিওয়ালা যাচ্ছেন রোড ট্রিপে। পুরো সিনেমাটাকে আপনি তিনজন রক্সস্টারের জ্যামিং সেশন হিসেবে দেখতে পারেন, কারণ এই সিনেমার তিনজন মূল অভিনেতার অ্যাক্টিং এবং রিঅ্যাক্টিং অনেকটা লিড গিটারিস্ট, বেজিস্ট এবং ড্রামারের তাল মেলানোর মতোই। এবং এই তিনজনের মধ্যে একজন হচ্ছেন ইরফান খান।
দুই ইন্টেলেকচুয়াল বাঙ্গালিকে সামলাতে না পারার অসহায়ত্ব, সারাক্ষন ঘ্যান ঘ্যান করা মা-বোনের যাতাকলে পিষ্ট হওয়ার বিরক্তি থেকে শুরু করে, দীপিকা পাডুকোনের সাথে রোমান্টিক কেমিস্ট্রি, প্রতিটা ইমোশন ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে ইরফান খান একদমই ন্যাচারাল। তবে দ্য গ্রেট অ্যাক্টর ইরফান খানকে বুঝতে হলে চোখ রাখতে হবে সিনেমাটার ইন্টারভ্যাল পয়েন্টে। অনুরাগ ক্যাশাপ থেকে শুরু করে সুজিত সরকার, বিভিন্ন ইন্টারভিউতে তারা বারবারই বলে থাকেন,বলিউডে একজন ডিরেক্টরের নাইটমেয়ার হচ্ছে ইন্টারভ্যাল পয়েন্ট তৈরি করা। পিকুর ইন্টারভ্যাল সিনটি সম্ভবত আধুনিক বলিউড সিনেমার সেরা ইন্টারভ্যাল পয়েন্ট। মূল তিন ক্যারেক্টারের মধ্যে গাড়িতে ছুরি রাখা নিয়ে চলছে তুমুল ঝগড়া এবং হঠাৎ করেই তিনজন ক্যারেক্টারই কথা বলা বন্ধ করে দেন। ‘নেহি ফেক সাকতা’ খুব ছোট্ট করে এই কথাটা বলে ইরফান খান পুরো শরীরটা ছেড়ে দিয়ে স্রেফ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। কাঙ্গানা রানাউত ইরফান খানের সাথে একটা Flim Companion এর একটা ইন্টারভিউতে পরবর্তীতে ইরফান খানকে বলেন যে ওই ছোট্ট একটা মুভমেন্ট পুরো সিনেমাটাকে ঠিক মাঝপথে নিয়ে আসে। আপনারও অডিয়েন্স হিসেবে মনে হবে এই তিনজন মানুষের পাগলামি থেকে এখন একটু ব্রেক দরকার। দ্যাট ইজ ইরফান খান ফর ইউ। কোনও ডায়লগবাজি ছাড়া খুব সিম্পল কিছু মুভমেন্ট দিয়ে যিনি পুরো একটা সিনকে এক্সপ্রেস করতে পারেন।
Paan Singh Tomar ( Paan Singh Tomar)
হিরোদের এন্ট্রি শট হয় গাড়ি উড়িয়ে, হেভি মেটাল মিউজিকের সাথে। নিজের ক্যারিয়ারের করা সবচেয়ে শক্তিশালী চরিত্রে ইরফানের খানেরও একটা এন্ট্রি শট আছে, কিন্তু সেটা ইরফানের মতোই। ঠান্ডা, স্থির কিন্তু অসম্ভব পাওয়ারফুল। সাংবাদিকের করা প্রশ্ন ‘অ্যাপ ডাকেয়েত ক্যাসে বানে? এর জবাবে ইরফানের চোখে হালকা বিরক্তি এবং ঠান্ডা গলায় উত্তর ‘ বিহার মে বাগী (বিপ্লবী) হোতে হ্যায়, ডাকেয়েত মিলতে হ্যায় পার্লামেন্ট মে” ।
সিনেমা শুরু হওয়ার পাঁচ মিনিটের মাথায় আপনি জানেন, একজন বিপ্লবীর রোলে ইরফান খান আগামী দুই ঘন্টা আপনাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো আটকে রাখবেন। ওভার অ্যাকটিং করে এই ধরনের রোলকে কমিক্যাল বানিয়ে ফেলা খুবই সোজা, কিন্তু ইরফান খান ইজ ইরফান খান। এই লার্জার দ্যান লাইফ রোলেও তিনি মনুষ্যত্ব ফুটিয়ে তোলার কাজটা করেছেন খুব তীক্ষ্ণভাবে। নেটফ্লিক্সে এই সিনেমার সামারিতে লেখা ‘Paan Singh Tomar goes from celebrate runner to star brigand and rebel when life after sports doesn’t unfold as planned’ . দুই লাইনের এই পুরো সামারিটা লেখা যতোটা সহজ, কারো ট্র্যাকের চ্যাম্পিয়ন থেকে বিদ্রোহী হওয়ার জার্নিটা ফুটিয়ে তোলা ঠিক ততোটাই কঠিন। চ্যাম্পিয়ন রানার, অবহেলিত এক্স অ্যাথলিট এবং তারপর সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামা এক বিদ্রোহী, প্রতিটা রোডব্লকে ইরফান খানের পারফরম্যান্স আপনাকে এক মিনিটের জন্য মনে করতে দেবে না যে আপনি ইরফান খান দেখছেন, আপনার চোখের সামনের সেই মানুষটা পুরোপুরিই সুবেদার পান সিং তোমার। প্রথম সপ্তাহে মাত্র ৮০ লাখ রুপির ব্যবসার করা এই সিনেমাটি পরবর্তীতে হয়ে উঠে তার প্রথম দিকের ক্যারিয়ারের অন্যতম ব্যবসাসফল সিনেমা। ইরফান খান অর্জন করেন তার প্রথম ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড।
Hindi Medium (Raj Batra)
‘পয়সা আসলেই ক্লাস আসে না’ খুব ছোট অবস্থান থেকে নিজের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করা মানুষদেরকে নিচু করে দেখানোর জন্য এটা আমাদের সবচেয়ে প্রিয় লাইন। রাজ বাত্রা চরিত্রে ইরফান খান বলেছেন এমনই এক ‘ক্লাস না আসা’ মানুষের গল্প। মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য হতে হবে ‘ক্ল্যাসি’ প্যারেন্ট। সাধারণ একজন শাড়ি বিক্রেতা থেকে ক্ল্যাসি প্যারেন্ট হওয়ার জার্নিতে রাজ বাত্রা ঠিক কোথায় অবস্থান করেন, এই সিচুয়েশনাল কমেডি সিনেমাতে ইরফানকে খুঁজতে হয়েছে সেই উত্তর।
রাজ বাত্রার মতো চরিত্রগুলোর কারণে ইরফানকে কেউ ‘আর্ট হাউজ সিনেমার সিরিয়াস অ্যাক্টর’ ব্র্যাকেটে কোনওদিন ফেলতে পারেনি। চাঁদনী চকে নিজের প্রতিবেশীদেরকে ছেড়ে আসার সিনটায় কাঁদো কাঁদো চেহারার ইরফানের কমিক টাইমিং আপনার মুখে এক চিলতে হাসি আনতে বাধ্য। চাঁদনী চকের রাজ বাত্রাকে দেখতে দেখতে হয়তো আপনার মনে পড়েছে পুরান ঢাকার কোনও এক ব্যবসায়ীর কথা। ওই যে, আপনার চারপাশের মানুষগুলোকে বড় পর্দায় দেখানো। খুব সাদামাটা-সাধারণ মানুষের চরিত্রগুলোই ইরফান ফুটিয়ে তোলেন সবচেয়ে নিখুঁতভাবে।
Talvar (Ashwin Kumar)
আরুশী তালওয়ার মার্ডার কেস অবলম্বনে বানানো এই সিনেমাটি সম্ভবত বলিউডের ইতিহাসের সেরা ক্রাইম থ্রিলার। ‘Morally Ambiguous’ এই রোলে ইরফান খান এক কথায় অনবদ্য। অশ্বীন কুমারের চরিত্রে ইরফান খান ‘সৎ ডিটেক্টিভ’ হওয়ার চিন্তায় ছিলেন না। চরিত্রটির উদ্দেশ্য একটাই, খুনীকে খুঁজে বের করা। বেপোরয়া সিবিআই অফিসারের চরিত্র ইরফান প্রচন্ড রেগে গিয়ে কখনো এক অযোগ্য পুলিশ অফিসারকে তার অফিসে পেটাচ্ছেন, আবার কখনো অন্য ডিটেক্টটিভের হাস্যকর যুক্তিতে উড়িয়ে দিচ্ছেন ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি আর সার্কাস্টিক লজিকের মধ্যে দিয়ে।
‘Quintessential Detective’ এর রোলে আপনি যা যা দেখতে চান,’ অশ্বীন কুমারের’ রোলে সে সবকিছু তো আছেই, ইরফান বলেই হয়তো আছে আরও বেশি কিছু। শেষ পর্যন্ত অশ্বীন কুমারকে আপনি পছন্দ করতে না পারেন, কিন্তু আপনার মার্ডার কেসের আসামীকে খুঁজে বের করার জন্য আপনি অশ্বীন কুমারকেই ইনভেস্টিগেটর হিসাবে চাইতেন, সেটা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি। ইরফানের অনান্য অনেক চরিত্রের চেয়ে এই চরিত্রটি একেবারেই ভিন্ন এবং সে কারণেই চরিত্রটি খুব স্পেশাল।
এই পুরো লেখাটার দিকে খেয়াল করলে দেখতে পারবেন আমি একবারের জন্যও ইরফানকে খানকে কোথাও ‘Past Tense’ লিখিনি। ‘আর্টিস্ট তার আর্টের মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকবেন’ এই লাইনটা খুব ক্লিশে, আমি সেটা খুব ভালো করেই জানি। সমস্যা হচ্ছে, আই রিয়েলি ডোন্ট কেয়ার। ইরফানকে আবার কোনওদিন স্ক্রিনে দেখবো না, এই বাস্তবতাটা আমি অন্তত আজকে মানতে প্রস্তুত না। ইরফান খান ছিলেন,আছেন, থাকবেন। ইরফান খান আপনি, ইরফান খান আমি, ইরফান খান আমরা সবাই।