‘হ্যালো, আমি আসিফ বলছি, বিকাশ হেড অফিস থেকে। আমাদের গ্রাহকদের বিকাশ একাউন্ট আপগ্রেডের কাজ চলছে। আপনার ফোনে একটি ভেরিফেশন কোড পাঠানো হয়েছে। কোডটা জানান প্লিজ। এবং আপনার ৪ ডিজিটের পিন নম্বরটি বলুন।’ – বিকাশের এই সতর্কতামূলক বিজ্ঞাপনটার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে?
শুধু একাউন্ট আপগ্রেডই নয়, মাঝে মাঝে গাড়ি বাড়ি জেতার লোভও দেখানো হয় গ্রাহকদের। সেই লোভের ফাঁদে পড়ে নিজ একাউন্টের তথ্য অপরিচিত কাউকে না প্রদানে সচেতন করাই ছিলো বিকাশের এই বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্য। সাধারণ একটি ফোন কলের মাধ্যমে যে কারো ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য নিয়ে টাকা পাচার করে ফেলতে পারে প্রতারক চক্র। ফোন কল, ইমেইল কিংবা টেক্সট ম্যাসেজ সহ যেকোনো মাধ্যমকেই পুঁজি করে হরদম চলছে এ ধরণের প্রতারণা।
সময়ের সাথে প্রতারণার ধরণেও এসেছে আপগ্রেডেশন। ডিজিটাল প্রযুক্তির চতুর ব্যবহার ও জনগণের সরল বিশ্বাসকে পুঁজি করে দিন দিন কেবল বেড়েই চলেছে এই অপরাধের মাত্রা। আর নেটফ্লিক্সের ব্যানারে যেনো দেখা গেলো এরই এক ঝলক – “জামতারা : সাবকা নাম্বার আয়েগা” !
জামতারা : কাহিনি সংক্ষেপ
জামতারা, ভারতের ঝাড়খণ্ড জেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রাম। এ গ্রামের অধিকাংশ লোকই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। যারা এগিয়েছিলো, তারাও খুব বেশিদূর পড়ালেখা করেনি। অথচ এই গ্রামের বহু যুবকেরই মাসিক আয় প্রায় লাখখানেকের উপরে। অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন কোন উদ্ভাবনী ক্ষমতার জোরে এগিয়েছে গ্রামটি? নাহ, সেরকম কিছু নয়। গ্রামীণ জনতার সহজ স্বাভাবিক জীবনযাপনগত কারণে গোটা ভারতের কাছে এ গ্রামের পরিচিতি মেলেনি। এর পরিচিতি মিলেছে ‘সাইবার ক্রাইমের গ্রাম’ হিসেবে।
সূচনাটা আজ থেকে ১০ বছর আগে। ভারতের জনগণ সবেমাত্র এটিএম কার্ড বা ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের সাথে পরিচিত হয়েছে। নতুন প্রযুক্তির প্রতি অগাধ আস্থা আর অসচেতনতাকেই লক্ষ্য বানিয়ে ব্যবসা ফাঁদে জামতারার কিছু তরুণ। প্রথমে তারা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল করে বিভিন্ন ব্যক্তির এটিএম কার্ডয়ের তথ্য আদায় করে নিতো। এর বিপরীতে লক্ষাধিক টাকার প্রস্তাব, গাড়ি, ফ্ল্যাট বা বিদেশভ্রমণের এয়ার টিকেট জেতার প্রলোভন দেখাত তারা। আর অসেচতন জনগণ সহজেই পা দিয়ে ফেলত সেই ফাঁদে।
এই প্রতারক চক্রের দলটির নেতৃত্ব দেয় দুই জ্ঞাতি ভাই সানি মণ্ডল ও রকি মণ্ডল। এর মাঝেই গোটা দেশ থেকে অভিযোগ আসতে থাকে জামতারা গ্রামের বিরুদ্ধে। গ্রামীণ পুলিশের অজ্ঞতা এবং সানির চাতুর্যে সহজেই মামলা থেকে রেহাই পেয়ে যায় অপরাধ চক্রের তরুণেরা। তাদের আয়ও বাড়তে থাকে। কিন্তু স্থানীয় রাজনীতিবিদ ভ্রাজেশ ভানের এতে বিষম আপত্তি। আয়কৃত অর্থের অর্ধেক দাবি করে বসে সে। এর বিনিময়ে পুলিশি হয়রানি থেকে সানি ও রকির দলকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়। রকি এবং তাদের দলের অন্যান্য যুবকরা এ প্রস্তাবে রাজি হলেও বেঁকে বসে সানি মণ্ডল। প্রেমিকা গুড়িয়াকে সাথে নিয়ে ফিশিং/স্ক্যামিং ব্যবসা আরও জমজমাট করে ফেলে সে। অন্যদিকে জামতারায় নতুন এসপি হিসেবে নিযুক্ত হন ডলি সাহু। ফিশিং অপরাধের সাথে যুক্ত যুবকদের শাস্তির আওতায় আনতে ঢালাও ভাবে সাজান জামতারার পুলিশ স্টেশনকে। সাইবার ক্রাইম ইউনিটকে সাথে নিয়ে আবিষ্কার করেন ভ্রাজেশ ভানের ঘরেই আছে ফিশিং ব্যবসার কল সেন্টার !
একদিকে রকি মণ্ডলের অর্থব দল, অন্যদিকে চতুর সানি-গুডিয়ার জমজমাট ব্যবসা। দুই ভাইয়ের দ্বৈরথকে আরো বাড়িয়ে তোলে ভ্রাজেশ ভানের লোভ। অপরাধ জগতের সাথে যুক্ত হয় রাজনীতি। কোটি কোটি টাকা লুটে নেয়া জামতারা যুবকদের ভবিষ্যৎ কি? ভ্রাজেশ ভানের থাবা থেকে কি মুক্তি মিলবে তাদের? পুলিশই বা কিভাবে শাস্তির আওতায় আনবে এই চক্রকে? জানতে হলে দেখতে হবে নেটফ্লিক্স সিরিজ ‘Jamtara – Sabka Number Ayega’ !
শুধুই গল্প নয়, এটা বাস্তব ঘটনা
‘জামতারা’ কে শুধু সিরিজ হিসেবে ভাবলে ভুল করবেন। এটি সত্য অপরাধকে কেন্দ্র করেই নির্মিত। ঝাড়খণ্ডের এই গ্রামেই ভারতের সবচেয়ে বেশি সাইবার ক্রাইম সংঘটিত হয়। ২০১৫ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত এক শতাধিকেরও বেশি মামলা করা হয়েছে এই গ্রামের অধিবাসীদের বিরুদ্ধে। জামতারা তো বটেই, আশপাশের প্রায় ১২টি রাজ্যের পুলিশও এসময় মোট ২৩ বার হানা দিয়ে ৩৮ জনকে আটক করেছে। শুধু ২০১৭ সালেই ১০০ জনের বেশি সাইবার ক্রিমিনাল সাজা পেয়ে জেল খাটতে গিয়েছে।
পরিচালক সৌমেন্দ্র বেশ গবেষণা করেই সিরিজটি নির্মাণে হাত দিয়েছিলেন। ২০১৫ সালে দৈনিক পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে চোখ আটকে যায় তাঁর। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলো, ‘জামতারা গ্রামের একদল যুবকের পাল্লায় পড়ে বহু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী বহু অর্থ খুইয়েছেন। উচ্চশিক্ষিত এই লোকগুলোকে বোকা বানানো যুবকদের পড়াশোনার দৌড় বড়জোর পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত। স্রেফ ফোন কলের মাধ্যমে তারা ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি করে কোটি কোটি টাকা প্রতিমাসে হাতিয়ে নিচ্ছে এদের কাছ থেকে। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, এরা গোটা ভারতের জনতাকে প্রতারণার লক্ষ্যবস্তু বানালেও ঝাড়খণ্ডের লোকদের কোনোপ্রকার ক্ষতি করেনা।
প্রতিবেদনটি পড়েই সৌমেন্দ্র টের পান, সিরিজ তৈরির জন্য এরচেয়ে দারুণ গল্প আর হয়না। পাশাপাশি এই বিশাল চক্রের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার একটা ভিত্তি তৈরির তাড়নাও অনুভব করেন তিনি। তাঁর মতে, “আমরা সবাইই কম বেশি এমন ফোন কল পেয়েছি। প্রচুর লোক প্রতিদিন এভাবে নিজের সর্বস্ব হারাচ্ছেনও। অথচ মিডিয়াতে এই বিষয়ে তেমন শোরগোল নেই। জামতারার তরুণদের প্রধান পেশাই প্রতারণা। পুলিশ যতই চেষ্টা করুক, ওরা তার চাইতে দশ কদম এগিয়ে। ধরুন, কোন পুলিশ চক্রের কাউকে আটক করলো, সাথে সাথেই পুলিশের অ্যাকাউন্টে ১০ হাজার টাকা ডিপোজিট করে দেয় তারা। এরপর কার সাধ্য থাকে এদের নিয়ে ঘাটাঘাটি করার? ভারতে খুব সহজেই লোকের ব্যক্তিগত তথ্য আদায় করে নিতে পারে প্রতারকচক্র। যুক্তরাষ্ট্রে এর বিরুদ্ধে শক্ত আইন থাকলেও আমাদের নেই। খুব বড় ধরণের জালিয়াতি না ঘটা পর্যন্ত সম্ভবত সরকারের টনকও নড়বে না। আমি বিশ্বাস করি, ‘জামতারা’ এই সমস্যাকে তুলে ধরবে জনগণের কাছে, তাদের সচেতন হতে সাহায্য করবে সিরিজটি।”
বলিষ্ঠ গল্প, দুর্বল চিত্রনাট্য
নেটফ্লিক্সের ছায়াতলেই মুক্তি পেয়েছে সিরিজটি। তবে গল্পের ভিত দৃঢ় হলেও বেশি কিছু অংশে দুর্বলতা ছিল চোখে পড়ার মত। পশ্চিমবঙ্গের সাথে সীমানা ভাগাভাগি করায় জামতারার ভাষা মূলত বাংলা ও সান্থালি ভাষার মিশ্রণে গড়ে উঠেছে। কিন্তু সেদিকটা একেবারে এড়িয়েই গেছেন এ গল্পের চিত্রনাট্যকার।
বছরের শুরুর দিকে নেটফ্লিক্সে মুক্তি পায় ১০ পর্বের ক্রাইম-ড্রামা জনরার সিরিজটি। প্রতিটা পর্বের দৈর্ঘ্য ছিলো ৩০–৪০ মিনিট। দুর্দান্ত সিনেমাটোগ্রাফি আর মাল্টি ক্যামেরায় জামতারার তীক্ষ্ণ অপরাধ র্যাকেটের সমস্তটাই এসেছে প্রগাঢ়ভাবে। সরল ভাষায় চিত্রনাট্য লেখা হলেও অভিনেতাদের আন্তরিকতায় ঘটনার ভয়াবহতা ঠিকই টের পেয়েছেন দর্শক, তা নিশ্চিত করে বলা যায়…
প্রতিটা মুখই অপরিচিত মুখ !
সিরিজের সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নতুন অভিনেতাদের দিয়ে কাজ করানো। ভ্রাজেশ ভানের চরিত্রে অমিত সিয়াল তুলনামূলক প্রবীণ অভিনেতা হলেও বাকি সবাই ছিলেন আনকোরা মুখ। কাস্টিং ডিরেক্টর বিকাশের হাত ধরেই এরা সুযোগ পেয়েছেন জামতারা সিরিজে। রকি হিসেবে অংশুমান পুষ্কর মডেলিং এর জন্য অডিশন দিয়েছিলেন। সেখান থেকেই বিকাশ তাকে ডেকে অডিশনের প্রস্তাব দেন। মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে পাঁচ কেজি কমিয়ে অডিশন দেয় অংশুমান। অন্যদিকে সানি চরিত্রে স্পর্শ শ্রীবাস্তব অবশ্য স্টার প্লাসের ‘বালিকা বধূ’ দিয়েই যাত্রা শুরু করেছিলেন। তবুও চারবার অডিশনের পরেই ডাক মেলে তার। মেয়েলি কণ্ঠে স্ক্যামিং এর দৃশ্যগুলোয় অনন্য ছিলো স্পর্শ শ্রীবাস্তব …
তবে সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম গুডিয়া চরিত্রে মনিকা পানওয়ারকেই দিতে হয়েছে। পাহাড়ের মেয়ে হওয়ায় কথার টানে কিছুতেই ঝাড়খণ্ডের আঞ্চলিকতা আনতে পারছিলেন না। ৩ পর্ব চিত্রায়নের পর ছেড়ে দেবার কথাও ভাবছিলেন। পরিচালকের প্রেরণাতেই ফের চরিত্রে মেশেন মনিকা। আকশা পারদাশানি ছিলেন সিরিজের অন্যতম বলিষ্ঠ চরিত্র এসপি ডলি সাহু হিসেবে। নবীনদের মধ্যে তিনিও নজর কেড়েছেন।
জামতারার তরুণদের কাছে আধুনিক প্রযুক্তির সবকিছুই আছে। তারা ইন্টারনেট, ভিওআইপির সর্বোচ্চ ব্যবহারটা জানে। গ্রামের বয়স্কদের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে সেখানে জালিয়াতির অর্থ হস্তান্তর করে। প্রত্যেকে গড়ে ৩০০ টা কল করে প্রতি মাসে। এই বিশাল চক্রের হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় সচেতনতা। বিশ্বের প্রতিটা দেশেই এরকম কিছু পথভ্রষ্ট কিছু মানুষ আছে। কিছু নয়, অসংখ্য আছে। এদের থেকে সতর্ক থাকুন, সচেতন থাকুন। ভুলেও কাউকে ব্যক্তিগত কোন পাসওয়ার্ড দিবেন না। ফেসবুকে অচেনা লিংকে ক্লিক করবেন না। আর হ্যাঁ, পর্নোগ্রাফিক ওয়েবসাইটে অবশ্যই ঘুরবেন না। এই সাইটগুলোই মূলত স্ক্যামিং, ফিশিং ও ভাইরাসের সবচেয়ে বড় আখড়া। এছাড়াও এটিএম বুথে লেনদেন করার ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকুন…