১৯০৬ সালে অয়েস্টার বে তে চার্লস হেনরী ওয়ারেন নামে এক ধনী ব্যাংকারের বাড়িতে এগারোজন বাসিন্দার মাঝে ৬ জনই টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়। সেই সময় অয়েস্টার বে তে টাইফয়েড এর প্রকোপ প্রায় ছিলনা বললেই চলে। অবশেষে পরিবারটি জর্জ সোপার নামে এক টাইফয়েড গবেষককে নিযুক্ত করা হয় এই মহামারীর কারন অনুসন্ধানের জন্য। তদন্ত শেষে ১৯০৭ সালে মত দেন যে সম্ভবত এই আইরিশ রাঁধুনী মেরী মেলন এই রোগের বিস্তারের কারন। কিন্তু মেরী ছিলেন শারীরিক ভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ। ম্যারী ততদিনে কাজ বদল করে অন্য যায়গায় চলে গেছে। জর্জ সোপার কৌতুহলী হয়ে খুজতে লাগলেন ম্যারীকে। পার্ক এভিনিউ তে হঠাৎ করে টাইফয়েডের প্রকোপ বেড়ে গেছে এমন খবর শুনে সেখানে ছুটে যায় সোপার দ্রুত সেখানে গিয়ে তিনি দেখতে পেলেন সেখানকার রাঁধুনী মেরী মেলন। অবশেষে পাওয়া গেলো মেলনকে ।
কে এই টাইফয়েড ম্যারী মেলন ?
তার বিশেষ কোন পরিচয় নেই, নিতান্তই একজন সাধারন রমনী। ১৮৬৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আয়ারল্যন্ডে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৮৮৩ সালে মাত্র পনেরো বছর বয়সে তিনি ইউনাইটেড স্টেটস এ মাইগ্রেট করেন, এবং সেখানেই তার চাচা চাচীর সাথে বসবাস শুরু করেন। কর্মজীবন শুরু করেন রাধুনী হিসেবে। বিভিন্ন অভিজাত পরিবারের রাধুনী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেগিয়েই আলোচনায় আসেন তিনি। ম্যারী মেলন অসংখ্য তথ্য গোপন করায় তার কাছে থেকে পুর্ন তথ্য নেয়া সম্ভব হয়নি। ১৯০০ সাল থেকে ১৯০৭ সাল নাগাদ তিনি নিউইয়র্ক ও তার আশপাশের কিছু এলাকায় প্রায় সাতটি পরিবারের রাঁধুনী হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। সর্বপ্রথম উনি যে পরিবারে রান্না শুরু করেন দুই সপ্তাহের মাঝেই সেই পরিবারের সদস্যদের জ্বর এবং পাতলা পায়খানা শুরু হয়ে যায়। সেখান থেকে তখন তিনি চলে যান ম্যানহাটনে। সেই পরিবারেও শুরু হয় একই উপসর্গ, এইবার একজন মারাও যায়। তখন সেখান থেকে তিনি এক আইনজীবীর বাড়িতে কাজ নেন সেখানেও একই ঘটনা ঘটে। এভাবে বারবার উনি কাজের স্থান বদলাতে থাকেন এবং যেখানেই যান একই ঘটনা ঘটতে থাকে। সকলেই টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত।
জর্জ সোপার যখন তদন্তের জন্য মেরীর কাছে যান তখন তিনি পরীক্ষার জন্য নিজের মল এবং মুত্র দিতে অস্বীকৃতি জানান। তখন সোপার মেরীর বিগত পাঁচ বছরের ইতিহাস ঘাটাঘাটি করে দেখেন যে তিনি যে যে পরিবারে কাজ করেছেন প্রায় সব পরিবারই টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়েছে। অবশেষে নিউইয়র্ক সিটি হেলথ এসোসিয়েশন জোসেফ বেকার নামে একজন ডাক্তারকে পাঠায়, এবং বেকার পুলিশ সহযোগে গিয়ে মেরীকে কাস্টডিতে নিয়ে আসে। পরীক্ষা নিরিক্ষা করে দেখা যায় তার মলের সাথে জীবন্ত টাইফয়েডের জীবানু বের হচ্ছে। আরও পরীক্ষা নিরিক্ষার পর দেখা যায় তার পিত্তথলিতে এই জীবানুগুচ্ছ আছে যেগুলো তার কোন ক্ষতি করছে না কিন্তু সে বাহক হিসেবে ছড়িয়ে দিচ্ছে সবার মাঝে। যেহেতু টাইফয়েড ফিকো ওরাল রুট অর্থাৎ জীবানুগুলো মলের সাথে বাইরে বেরিয়ে আসে এবং খাবারে সাথে দেহের ভিতরে যায়, সুতরাং রাঁধুনী হিসেবে খুব সহজেই সে এই রোগ সবার মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছে। কর্তৃপক্ষ তখন তার পিত্তথলি কেটে ফেলার পরামর্শ দেয় কিন্তু সে সেটা করতে অস্বীকৃতি জানায়, এমনকি নিজের পেশা বদলের ব্যাপারেও সে আপত্তি জানায়।
প্রথম হোম কোয়ারেন্টাইন
ঝামেলা থেকে বাঁচার জন্য টাইফয়েড ম্যারী কে নর্থ ব্রাদার আইল্যান্ড এর এক ক্লিনিকে গৃহ বন্দী করে রাখা হয়। অবশেষে ইউজিন এইচ পোর্টার, নিউ ইয়র্ক স্টেট কমিশনার অফ হেলথ, ১৯১০ সালে এই শর্তে মুক্তি দেন যে, সে আর রান্নার কোন কাজ করবে না। মুক্তি দেয়ার পর তাকে কাপড় ধোঁয়ার কাজে নিযুক্ত করা হয়, কিন্তু এই কাজটা তার খুব একটা পছন্দ হচ্ছিল না, তাছাড়া এই কাজের বেতন তার আগের কাজের চেয়ে বেশ কম ছিল কয়েক বছর এভাবে কাজ করার পর তিনি এই কাজ ছেড়ে দেন এবং নিজের নাম পালটে আবার রান্নার কাজ শুরু করেন। এই সময় তিনি নিজের নাম পালটে মেরী ব্রাউন রাখেন। এর পরবর্তী কয়েক বছর তিনি বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেছেন, এবং প্রত্যেক জায়গাতেই টাইফয়েড মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি এত দ্রুত কাজ এবং জায়গা বদলাতেন যে, তাকে খুঁজে পাওয়াই মুশকিল হয়ে গিয়েছিল কর্তৃপক্ষের জন্য। অবশেষে ১৯১৫ সালে নিউইয়র্কের এক মহিলা হাসপাতালে হঠাৎ টাইফয়েড মহামারী আকারে দেখা যায়। ২৫ জনের বেশি আক্রান্ত হয়, তার মাঝে দুই জন মারাও যায়। এবারও তিনি কাজ ছেড়ে পালান। তবে পালানো তার বৃথা যায় কারন পুলিশ ধরে ফেলে তাকে।
দ্বিতীয় হোম কোয়ারেন্টাইন
দ্বিতীয়বারের মত তাকে নর্থ ব্রাদার আইল্যান্ড হসপিটালে গৃহবন্দি হিসেবে পাঠানো হয়। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি গৃহবন্দি ছিলেন। কাগজে কলমে আমেরিকার সরকারী হিসেব মতে তিনজন লোক মারা গিয়েছিলো তার জন্য যদিও অন্যসূত্রমতে তার থেকে ছড়ানো টাইফয়েডে মারা গিয়েছিলো পঞ্চাশেরও অধিক মানুষ। নিজে টাইফয়েডের বাহক হলেও তার মৃত্যুর কারন ছিল মূলত নিউমোনিয়া। এমন কুখ্যাত কর্মকান্ডের জন্য তার নাম টাইফয়েড ম্যারী নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৩৮ সালে মারা যান ম্যারী। তখন তার লাশ আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয় যেন সেখান থেকে জীবানু না ছড়াতে পারে।
মেডিকেলের ভাষায় এই ধরনের বাহককে বলা হয়ে থাকে এসিম্পটোমেটিক কেরিয়ার। এই ধরনের কেরিয়ার টাইফয়েড ছাড়াও এইচ আই ভি, এপস্টিন বার ভাইরাস এই গুলোর ক্ষেত্রেও পাওয়া যায়।