‘Murad Takla’ অন্তর্জালিক বাংলা লেখালিখিতে মোড় ঘোরানো দু’টো শব্দ। যারা অন্তর্জালের বিভিন্ন মাধ্যমে লেখালিখি করে অভ্যস্ত তারা কমবেশি সবাই মুরাদ টাকলা’র সাথে পরিচিত। অপ্রত্যাশিতভাবেই ‘মুরাদ টাকলা’ রোমান হরফে (ইংরেজি বর্ণমালা) লিখিত বাংলা উচ্চারণের মাপকাঠি হয়ে গিয়েছে। সর্বোপরি রোমান হরফ ব্যবহার করে বাংলা লেখার যে চল, সেটার গোড়ায় প্রায় কুঠারাঘাত করলো এই মুরাদ টাকলার আবির্ভাব।
এতক্ষন যাঁরা মুরাদ টাকলার পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছেন, তাঁদের জ্ঞাতার্থে জানাই, ‘মুরাদ টাকলা’ মুরাদ নামক কোন টেকো ব্যক্তিকে আদর করে ডাকা নাম নয়। এটি একটি উচ্চারণের অপভ্রংশ। ঘটনাটি এই রকমঃ
বহুকাল আগে ফেইসবুকে দু’ব্যক্তির মধ্যে কোন একটি বিষয় নিয়ে উত্তপ্ত কথোপকথন চলছিল। তখন রোমান হরফেই লোকে বাংলা লিখতো; মানে অন্তর্জালিক লেখালিখির ক্ষেত্রে আর কি। তখন বাংলা হরফ লেখার জন্য একমাত্র মাধ্যম – বাংলার স্টিভ জবসের ‘বিজয়’ সফটওয়্যার, যেটি কিনা দু’দিন অন্তর অন্তর ভার্সন বদলিয়ে নতুন দাম চাপিয়ে দিত হতভাগ্য ব্যবহারকারীদের ওপর। তাছাড়া বিজয় কি-বোর্ড ছিল অত্যন্ত জটিল যেটি শিখতে কালঘাম না ছুটলেও ব্রহ্মতালু উত্তপ্ত হয়ে উঠতো।
যাই হোক, সেই কথোপকথনে এক পক্ষ কোন একটি ব্যাপার নিয়ে সম্ভবত আরেকপক্ষকে মাঝারি মানের হুমকি প্রদান করে। প্রত্যুত্তরে দ্বিতীয়পক্ষ অন্তর্জালের ইতিহাসে সেই যুগান্তকারী শব্দগুচ্ছের অবতারণা করে অনেকটা এইভাবেঃ
‘Murad takla aye… = Murod thakle aye = মুরোদ থাকলে আয়’। তাৎক্ষণিকভাবে এর প্রসবকারীকে ‘মুরাদ টাকলা’ উপাধিতে ভুষিত করা হয় এবং পরবর্তীতে বিভ্রান্তিকর উচ্চারণে রোমান হরফে বাংলা লেখকদের জন্য সর্বোচ্চ (অ)সন্মানজনক উপাধি হিসেবে ‘মুরাদ টাকলা’ প্রচলিত হয়ে যায়।
The Daily Star মুরাদ টাকলাকে সজ্ঞায়িত করেছে এভাবেঃ ‘Murad Takla’ is a generic term for anybody who writes Bangla using English alphabet but does it completely and often hilariously wrong. ২২শে ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সালের সংখ্যায় ‘The Legend of Murad Takla: origin, examples and other issues’ শিরোনামের প্রবন্ধে এই বিষয়ে বিশদ আলোচনা আছে। ইচ্ছে হলে পড়ে নিতে পারেন।
যাই হোক, এই লম্বা ভূমিকার অবতারণা শুধুমাত্র হাস্যরস সৃষ্টির জন্য নয়। আসলে এই লেখাটা একটা কি-বোর্ডের গল্প শোনানোর জন্য। এই লেখাটা অদ্যবধি ঘুরে বেড়ানো মুরাদ টাকলাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যও। সর্বোপরি এই লেখাটা ‘ইংরেজি অপেক্ষা বাংলা লেখা অনেক সহজ’ – এই অনেক সহজ ব্যাপারটাকে উপস্থাপন করার জন্য। প্রিয় পাঠক, আপনি যদি এতদূর পর্যন্ত পড়ে থাকেন তাহলে আশা করাটা অন্যায় হবে না যে বাকিটুকুও আপনি পড়বেন। তো চলুন, এগোই।
বলছিলাম জটিল অক্ষর বিন্যাসের কি বোর্ড ‘বিজয়’ দিয়ে বাংলা লেখার চ্যালেঞ্জের কথা। লেখালিখির সেই জটিলতার সময় মেহেদি হাসান খান নামের এক তরুণ ২০০৩ সালের ২৬শে মার্চ অভ্র নামের একটি বিনামূল্যের সফটওয়্যার তৈরি করে ছেড়ে দিলেন আর বলা যায় অন্তর্জালে বাংলা লেখালিখির ব্যাপারটা এক ধাক্কায় রকেট সাইন্স থেকে বাদাম খাওয়ার পর্যায়ে নামিয়ে আনলেন। অভ্রর সবচেয়ে বড় সুবিধা, এতে ‘ফোনেটিকস’ ব্যবহার করে রোমান হরফে বাংলা লেখা যায়। সহজ করে বললে অভ্রর রিদ্মিক কিবোর্ড দিয়ে আপনি যদি ‘Ami banglay likhte chai’ টাইপ করেন তাহলে সেটা ‘আমি বাংলায় লিখতে চাই’ হয়ে যাবে। এই সফটওয়্যারটি সব ধরনের অপরেটিং সিস্টেমে চলে বলে এবং সবার হাতে হাতে স্মার্ট মুঠোফোন থাকার ফকে বাংলা টাইপিং হয়ে গেল ডালভাত।
অভ্র আসার পর মুরাদ টাকলাদের প্রাদুর্ভাব বেশ কমে গেলেও এখনো যা আছে তা যথেষ্ট আশংকাজনক। চাইলেই এটা বন্ধ করা যায়। কিভাবে? বলছি। তার আগে একটা মুরাদ টাকলা জাতীয় কথোপকথন শোনাই…
– kaman asan?
– জি, ভালো আছি।
– apnar sala kaman asa?
– জি, ভালো আছে।
– kon klasa pora?
– ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে।
– ki ja bolan na apna. Apnar sala intara porar mato baro holo koba?
– মেট্রিক পরীক্ষার পরে।
– assa bolanto apnar salar boyos kato?
– ১৬ বছর।
– ki??? Bussi apnar mata kharap hoae gasa. Assa apna bia korsan kato bosor hoesa?
– ৭ বছর।
– apna bia korsan 7 bosor tahola apnar salar boyos 16 bosor hoy kamna?
– কারণ আমার বিয়ের ৯ বছর আগে আমার শালা জন্মগ্রহন করেছে।
– ha ha ha ara boka apnar salar kota janta sainito.
– তাহলে কার কথা জানতে চাইছেন?
– apnar salar kota.
-!?!?!? ****
– apne to vi darun mogar lock.
– আমি মগার তালা !
– Are eta voli nai toh. Bolci apne darun mogar lock.
– mogar lock = মগার তালা
– Hu ha hi ha hi hu hi ha….majar look to apne
– আমি আবার কার মাজায় তাকাই?
– ame majar look volleo problam..! Taila ki volvo volen apne
– এইখানে আবার ভলভো গাড়ি আসলো কোথা থেকে?
তো, এই ধরনের বাক্যালাপ যদি চালাতে হয় তাহকে দ্বিবিধ সমস্যা। নিজের মস্তিষ্ককে চতুর্গুণ খাটিয়েও এই মুরাদিয় বাংলার অর্থোদ্ধার সম্ভব হয় না সব সময়। এর ওপর ব্যাপক ভুল বোঝাবুঝিরও আশংকা থাকে। যেমন এক ছেলে তার বান্ধবীকে বলতে চাইছেঃ “সেদিন তোমার পাশে তোমার ছোট্ট ভাগিনাকে দেখে ভাল লাগলো।”
যেহেতু সে মুরাদ টাকলা তাই সে সবাইকে দেখিয়ে খোলাখুলি প্রশংসা করে লিখলোঃ Sadin tamar pasay tamar sotto vagina k deka bal lagla.
ফলাফল – সহজেই অনুমেয়। মেয়েটি ছেলেটিকে জুতোপেটা করেছিল। সেইটাই করার কথা।
সুতরাং বাংলা শব্দ উচ্চারণের ন্যুনতম ক্ষমতা যদি থাকে তাহলে অভ্রর ফোনেটিকস ব্যবহার করে অতি সহজেই মনের ভাবটা খাঁটি বাংলায় লিখে ফেলা যায়। এরজন্য কোন বাড়তি দক্ষতার প্রয়োজনই নেই। দুঃখজনকভাবে এরপরও অদ্যবধি বহু অন্তর্জালীয় লেখক (এ ক্ষেত্রে যিনি একটি লাইনও লেখেন, তাকেই আমি লেখক হিসেবে বোঝাতে চাইছি) স্বেচ্ছায় নিয়মিত মুরাদ টাকলা হিসেবে নিজেকে প্রতিপন্ন করে চলেছেন এবং বাকিদেরও ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিয়ে চলেছেন ক্রমাগত। একবার কল্পনা করুন, কী ভীষণ শাস্তি এই মুরাদ টাকলাদের লেখা বোঝা।
প্রিয় মুরাদ টাকলাগণ, একটাই অনুরোধ। দরকার হলে অল্প করে লিখুন কিন্তু অভ্রর রিদ্মিক কিবোর্ড দিয়ে বাংলায় লিখুন। বাংলাকে ভাল না বাসলেও আমাদের জীবন অন্তত বাঁচান।
আমরা এবার লেখাটার শেষ অংশে চলে এসেছি। আমি বলেছিলাম, ইংরেজির থেকে বাংলা ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করা অনেক, অনেকগুন সহজ। আমরা আসলে সবকিছুই বাংলায় কল্পনা করি। কথাও বেশিরভাগ বলি বাংলায়। শুনিও তাই। এটাই আমাদের মস্তিষ্কের গহিনে গেঁথে যাওয়া ভাষা। তাই যেহেতু সাধারণ কথাবার্তাই লিখছেন, সেটা বাংলায় লেখাটাই কি যৌক্তিক নয়? অন্য ভাষা নিয়ে আমার কোন ধরনেরই বিদ্বেষ নেই। আমি শুধু বোঝাতে চাইছি, মনের কথাটা মনের ভাষাটাতেই লেখা সবচেয়ে আরামের। এটা স্রেফ বেরিয়ে আসে, তাই না? নিজের ভাষাটাকে সন্মান দেখানোর উপায়টা আমাদের সামনে প্রথম এনেছিলেন ‘৫২ ভাষা শহীদেরা, নিজেদের জীবন দিয়ে। এরপর ছাপার অক্ষরে একে মুক্ত করলেন মোস্তফা জব্বার তাঁর ‘বিজয়’য়ের মাধ্যমে। আর বাংলায় পুরো লেখালিখিটাকে এক পলকে আনাচে-কানাচে সহজতম উপায়ে পৌঁছে দিলেন মেহেদি হাসান খান তাঁর অভ্র দিয়ে। এই মানুষগুলো যদি এত বেশি আত্মত্যাগ, এত বেশি কষ্ট করতে পারেন শুধুমাত্র বাংলা ভাষাটাকে সবার জন্য সহজ করে দেয়ার জন্য, আমরা কি পারি না তাঁদের সেই অবদানগুলোকে সামান্য সন্মান দেখিয়ে এখন থেকে অন্তত একটা জায়গায়, এই লেখালিখিতর ব্যাপারটায় যেখানে সম্ভব সেখানে বাংলা ব্যবহার করতে? আমরা পারি। চাইলেই পারি। সেই সুযোগ সুবিধা এখন আমাদের প্রত্যেকের মুঠোর মধ্যে।
দরকার শুধু বিশুদ্ধ ইচ্ছের আর নিজের ভাষাটার জন্য হৃদয়ের ভেতরে সামান্য একটু রক্তক্ষরণের। আসুন, আমরা পৃথিবীর মিষ্টিতম ভাষা আমাদের এই বাংলাভাষায় আজ থেকেই লেখা শুরু করি। ভাল থাকবেন সবাই।
তওহিদ মাহমুদ হোসেন, শুদ্ধ বানান চর্চা (শুবাচ)
(বিঃদ্রঃ ছারপোকা ম্যাগাজিনে কপিকৃত কোনো কন্টেন্ট প্রকাশিত হয় না। এই লেখাটি ব্যতিক্রমী এবং শেয়ার পাবার যোগ্য বিধায় সরাসরি শুবাচ থেকে নিয়ে প্রকাশিত করা হলো)