প্যারাসাইট – প্রথমবারের মত কোনো বিদেশি ভাষায় নির্মিত ইংরেজি সাবটাইটেলের সিনেমা জিতে নিয়েছে অস্কার, বিশ্বসেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার ! সবার শেষে এসেছে এই ঘোষণাটি। তার আগপর্যন্ত এই ছবিটিকে আন্তর্জাতিক বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে সেরা বলে ঘোষণা করা হয়েছিলো। কিন্তু অস্কার ২০২০ এর সেরা সিনেমার বিভাগে ইংরেজি ভাষায় নির্মিত সব ছবিকে পিছনে ফেলে প্যারাসাইট যে জয়ী হবে, তা অনেকেই ভাবতেও পারেননি। কারণ অস্কারের ইতিহাসে এমনটা কখনো ঘটেনি।
১০ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই সারা বিশ্ব থেকে চলচ্চিত্রপ্রেমী দর্শক এবং ডাইহার্ড হলিউড ফ্যানরা চোখে রেখেছিলেন অস্কার লাইভ আপডেটে। যারা প্রকৃত উচ্চমার্গের সিনেমাপ্রেমিক, যারা বিশ্বের বিভিন্ন কোণের সেরা ছবিগুলোর খোঁজখবর রাখেন, তাদের কাছে বং জুন হো অনেক আগে থেকেই আদরণীয়। ২০০৩ সালের ‘মেমরিজ অফ মার্ডার’ সিনেমাটি তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি দেয়। কিন্তু তাই বলে এমনটা ভাববেন না যে, তাঁর ছবিতে প্রযোজকের পয়সা ওঠে না। বরং অত্যন্ত দারুণভাবে ওঠে। ‘দ্য হোস্ট’ (২০০৬) এবং ‘স্নোপিয়ার্সার’ (২০১৩), দুটি সিনেমাই দক্ষিণ কোরিয়ায় রেকর্ড আয় করেছিলো প্রেক্ষাগৃহে মুক্তিতে।
প্যারাসাইট এর অস্কার জয়টা যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ
প্যারাসাইট সিনেমাটি অস্কারে আসার অনেক আগেই আন্তর্জাতিক স্তরে প্রশংসিত এবং স্বীকৃত। প্রকৃত সিনেমাপ্রেমীদের কাছে কান চলচ্চিত্র উৎসবের সেরা ছবির পুরস্কারই শেষ কথা। ২০১৯ সালেই সেই পুরস্কার জিতে নিয়েছিলো এই ছবিটি। কিন্তু তারপরও অস্কারের সেরা ছবির বিভাগে মনোনয়ন পাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এতদিন পর্যন্ত ওই বিভাগে শুধুমাত্র ইংরেজি ভাষায় নির্মিত ছবিই স্থান পেয়েছে। বিদেশি ভাষার সাবটেইটেলযুক্ত ছবির জন্য আলাদা বিভাগ ছিলো, যার নতুন নামকরণ হয়েছে এই বছর। ওই বিভাগেও মনোনীত ছিল এই ছবিটি এবং যথারীতি ওই বিভাগের পুরস্কারও জিতেছে। কিন্তু সেরা ছবির বিভাগে মনোনয়ন এবং শেষমেশ পুরস্কারটি জিতে নেওয়ার অর্থ, হলিউড তার বহু বছরের দাম্ভিকতা থেকে কিঞ্চিৎ হলেও বেরিয়ে এলো…
পেছনের গল্প
পরিচালক বং জুন হো যখন প্রথম ‘The Host’ সিনেমাটি নির্মাণের কথা ভাবেন, তখন বেশিরভাগ মানুষই বলেছিলো, কোরিয়ান সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে এই ছবি নিয়ে কাজ করা প্রায় অসম্ভব। সাগর থেকে একটা দানব উঠে এসে সাধারণ মানুষের জীবন তছনছ করে দিবে, এরকম দৃশ্যে গ্রাফিক্সটা পর্দায় ঠিকঠাকমত দেখাতে না পারলে একদম হাস্যকর হবে। বং জুন হো যে কাঁচা কাজ করার মানুষ না, তা সবাই তখনই টের পেয়েছিলো, যখন তিনি এই সিনেমার গ্রাফিক্সের জন্য নিউজিল্যান্ডের সেই কোম্পানির কাছেই গিয়েছিলেন, যারা ‘লর্ড অফ দ্যা রিংস’ সিনেমার গ্রাফিক্সের কাজ করেছিলো! শেষমুহুর্তে শিডিউল জটিলতার কারণে সেই কোম্পানির সাথে তার আর কাজ করা হয়ে উঠেনি। শেষে পরিচালক বং জুন হো সান ফ্রান্সিসকোর ‘দ্যা অরফানেজ’ নামে অন্য কোম্পানিকে দিয়ে এই সিনেমার কাজ করান। বলা বাহুল্য, দ্যা হোস্ট সিনেমার টিকেট সেই সময়ে সবচেয়ে বেশি বিক্রয় হয়েছিলো !
অ্যাকাডেমি পুরস্কারের ভোটদাতারা মূলত মধ্যবয়সী সাদা চামড়ার আমেরিকান। তাঁদের যেন হঠাৎ জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হল যে বিদেশী ছবিও ‘সেরা’ হওয়ার উপযুক্ত। ২০১৯ সালে আলফানসো কুয়ারনের ছবি ‘রোমা’-কে বিদেশি ভাষার সেরা ছবির পুরস্কার ছাড়াও সেরা পরিচালকের পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছিল। তবে সে ছবি মেক্সিকোর, অর্থাৎ পড়শি দেশের ছবি। আর বং জুন হো দক্ষিণ কোরিয়ান। বেশিরভাগ মার্কিনিরা এখনও এশিয়া বলতে চিন ও জাপান বোঝেন। তাঁদের কাছে দক্ষিণ কোরিয়া এখনও প্রায় এলিয়েনল্যান্ড। বং খাঁটি এশিয়ান। আর একজন এশিয়ান হিসেবে সাদা চামড়ার এই ক্লাবে স্থান পাওয়া বেশ বড় ব্যাপার। বিশেষ করে যেখানে বং-এর ছবিগুলি ভীষণভাবে তাঁর দেশের সংস্কৃতি ও পারিবারিক মূল্যবোধে সম্পৃক্ত।
অর্থাৎ এক্ষেত্রে ৯০ বছরের রক্ষণশীলতা থেকে বেরিয়ে এল অ্যাকাডেমি পুরস্কার অথবা বকলমে হলিউড। অনেকেই হয়ত জানেন না, হলিউড অত্যন্ত স্বজনপোষণসম্বলিত মার্কিনি রক্ষণশীলতায় দুষ্ট। হলিউডে বহু এশীয় অভিনেতা-অভিনেত্রী, টেকনিশিয়ান কাজ করেন ঠিকই কিন্তু সেখানে দেশ ও জাতিগত শ্রেণিবৈষম্য আছে। ‘প্যারাসাইট’-এর অস্কার জয় কিছুটা হলেও হলিউডের সেই অন্তর্লীন জাতিবিদ্বেষী মনোভাবকে আঘাত করবে।
তা বাদে সিনেমার উৎকর্ষতার সম্মান কান চলচ্চিত্র উৎসবে আগেই পেয়েছেন বং জুন হো।
আরও একটি কারণে এই অস্কার জয় গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার পরিচালক-নির্মাতাদের কাছে এই স্বীকৃতি এক ধরনের অনুপ্রেরণার কাজ করবে। সিনেমার জ্ঞান অর্জন করে হলিউডে গিয়ে হলিউডি কায়দায় ছবি বানানোর ভাবনা বর্জন করে, নিজেদের দেশেই নাড়ির টান, মাটির টান নিয়ে ভাল ছবি তৈরি করার উৎসাহটা পাবেন। অর্থাৎ এদেশের এবং বাংলারও আশা আছে বইকি! এখন কে বা কারা এই গুরুদায়িত্বটা নেবেন, সেটা দেখবে আগামী সময়।