পৃথিবীর ব্যস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রোড প্ল্যান বা যাতায়াত পরিকল্পনা দেখলে যে কেউই নিশ্চিতভাবে বিস্মিত হবেন। বর্তমানে ঢাকা শহরের ভেতরকার যানজট নিরসনের জন্য বেশ কয়েকটি ফ্লাইওভার বা উড়ালসেতু তৈরি করা হয়েছে। যার নৈসর্গিক সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করতে বাধ্য ! ব্যস্ত শহরে নাগরিক জীবনের সময় বাঁচাতে এসব উড়ালসেতু রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। চলুন জেনে নেই, ফ্লাইওভারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের নেপথ্যের গল্প…
ঢাকার যত ফ্লাইওভার
সর্বপ্রথম খিলগাঁও ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ শুরু করা হলেও মহাখালী ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ আগে শেষ হয় এবং খিলগাঁও ফ্লাইওভারের আগেই উদ্বোধন হয়। যে কারণে মহাখালী ফ্লাইওভারকেই দেশের প্রথম ফ্লাইওভার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া যায়।
মহাখালী ফ্লাইওভার
মহাখালী উড়ালপথের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০০১ সালের ডিসেম্বরে এবং যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয় ২০০৪ সালের নভেম্বরে। ১৯টি শক্তিশালী স্তম্ভের সাহায্য নির্মিত এ ফ্লাইওভারের দৈর্ঘ্য ১.১২ কিলোমিটার। যানবাহন চলাচলের জন্য উভয় পাশে ৭.৫ মিটার চওড়া রাস্তা এবং ০.৬ মিটার ফুটপাত রয়েছে। প্রায় ১৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে ফ্লাইওভারটির নির্মাণ কাজ শেষ করতে সময় লেগেছে প্রায় তিন বছর। সন্ধ্যাকালীন অবকাশ যাপনের জন্য কিংবা পথিকের উদাসী পথের সঙ্গী হিসেবে মহাখালী ফ্লাইওভারের ফুটপাতদ্বয় একেবারেই মন্দ নয়। তাই অনেকেই নিন্তান্তই হাঁটাচলার জন্য প্রায়শ এখানে এসে থাকেন।
খিলগাঁও ফ্লাইওভার
খিলগাঁও ফ্লাইওভার ঢাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্যস্ত একটি ফ্লাইওভার। এটি একদিকে রাজারবাগকে সংযুক্ত করেছে অন্যদিকে মালিবাগকে এবং তৃতীয় দিকে সায়েদাবাদকে। ২০১৬ সালে নির্মাণকৃত আরেকটি লুপ মাদারটেক, কদমতলী, বাসাবো ও সিপাহীবাগকেও যুক্ত করেছে ফ্লাইওভারের সাথে। ১.৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০০১ সালে এবং সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয় ২০০৫ সালের মার্চ মাসে। ১৪ মিটার চওড়া খিলগাঁও ফ্লাইওভার নির্মাণে ব্যয় হয় প্রায় ৮১.৭৫ কোটি টাকা। এটি নির্মাণের ফলে খিলগাঁও রেল ক্রসিংয়ের জ্যামের পরিমাণ কিছুটা প্রশমিত হয়েছে।
বিজয় সরণি ফ্লাইওভার
রাজধানীর বিজয় সরণিতে বহুল আলোচিত র্যাংগস ভবন ভাঙার কাজ শুরু করার মাধ্যমে ২০০৭ সালে বিজয় সরণি-তেজগাঁও সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ সড়কের ০.৭ কিলোমিটার অংশে রয়েছে ফ্লাইওভার। তেজগাঁও রেলক্রসিং থেকে যানবাহনকে মুক্ত করতে এবং ঢাকার পূর্ব দিকের সাথে কেন্দ্রের যোগাযোগ স্থাপন করতে এই ফ্লাইওভার বানানো হয়েছে। সোডিয়াম বাতির আলোতে সজ্জিত সম্পূর্ণ সড়কটি নির্মাণে সর্বমোট ব্যয় হয়েছে ১১৪ কোটি টাকা। জমি অধিগ্রহণ বাবদ ৬৯ কোটি টাকা আর সড়ক নির্মাণে তিন কোটি ৫৮ লাখ এবং রেলক্রসিংয়ের জন্য ফ্লাইওভার নির্মাণে ব্যয় হয় ৩৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। ২০১০ সালের এপ্রিলে এটি জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ফ্লাইওভারটি বিজয় সরণির সাথে গুলশান, তিব্বত এবং সাত রাস্তাকে সংযুক্ত করেছে।
কুড়িল ফ্লাইওভার
চারটি লুপের সমন্বয়ে তৈরি কুড়িল ফ্লাইওভার ঢাকার অন্যতম দৃষ্টিনন্দন একটি সড়ক। বিশেষ করে রাতের ঝলমলে আলোতে কুড়িল ফ্লাইওভারের সৌন্দর্য আরও বর্ধিত হয়। স্থানীয় অনেক মানুষ সন্ধ্যাকালীন অবকাশ যাপনের জন্য এখানে এসে থাকেন। ৩.১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের কুড়িল ফ্লাইওভারের চারটি লুপ দিয়েই ওঠা-নামা করা যায়। এই লুপগুলো হলো বনানী, কুড়িল, খিলক্ষেত ও পূর্বাচল প্রান্তে। প্রথমে এর নির্মাণ ব্যয় ২৫৪ কোটি টাকা ধরা হলেও নির্মাণকাজ শেষে ব্যয় বেড়ে ৩০৩ কোটি টাকায় গিয়ে থামে। এর সম্পূর্ণ অর্থায়ন করা হয় রাজউকের নিজস্ব তহবিল থেকে। ৬৭টি পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এ ফ্লাইওভারের উচ্চতা ৪৭.৫৭ ফুট এবং প্রস্থ ৩০.১৮ ফুট। ২০১০ সালের মে মাসে শুরু হওয়া এই ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ শেষ হয় ২০১৩ সালের আগস্টে। সরকারিভাবে এটি কুড়িল বহুমুখী ফ্লাইওভার নামে পরিচিত।
মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার
প্রায় ১১.৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ফ্লাইওভার। ১৯৯৮ সালে এই ফ্লাইওভার তৈরি হবার কথা থাকলে ১৫ বছর পর ফ্লাইওভারটি পূর্ণতা পায়। ১০০ বছর আয়ুর এ ফ্লাইওভারের কারণে উপকৃত হচ্ছেন দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রায় ৩০টি জেলার জনগণ। ২০১০ সালের জুনে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় এবং ২০১৩ সালের অক্টোবরে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ফ্লাইওভারটির লেন সংখ্যা চারটি এবং এতে প্রবেশের জন্য পথ রয়েছে ছয়টি। মোট ওঠানামার পথ রয়েছে ১৩টি। মেয়র হানিফ বা যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভারের প্রতি কিলোমিটার নির্মাণ ব্যয় হয়েছে ২৩০ কোটি টাকা এবং সম্পূর্ণ প্রকল্পে খরচ হয়েছে ২,৩০০ কোটি টাকারও বেশি, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যয়ে নির্মিত। নির্মাণ ব্যয় তুলে নেবার প্রক্রিয়া হিসেবে টোল প্লাজা বসানো হয়েছে এ ফ্লাইওভারে।
জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভার
ঢাকার যাতায়াত ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভারের মাধ্যমে। আগে মিরপুর থেকে এয়ারপোর্ট যাতায়াত করতে গেলে বিজয় সরণি ঘুরে মহাখালী হয়ে তারপর এয়ারপোর্ট যেতে হতো। মিরপুর থেকে এয়ারপোর্টগামী একজন যাত্রীর ন্যূনতম দু-তিন ঘণ্টা সময় লেগেই যেত। আর জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভার দিয়ে একই দূরত্ব যেতে সময় লাগছে মাত্র ২০-২৫ মিনিট। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এই ফ্লাইওভারটির কাজ শুরু হয়। নির্ধারিত সময়ের প্রায় তিন মাস আগেই ২০১৩ সালের মার্চে এর নির্মাণকাজ শেষ হয় এবং এটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভারের দৈর্ঘ্য ১.৭৯৩ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ১৫.৫২ মিটার। ফ্লাইওভারটি নির্মাণ করতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা।
মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার
ঢাকার আরো কিছু ফ্লাইওভার নির্মীয়মাণ রয়েছে, যার মধ্যে সর্বশেষ সচল হয়েছে মৌচাক-মালিবাগ রেলগেট রুটের মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার ফ্লাইওভারটি। বাকি ফ্লাইওভারগুলোরও কাজ চলছে ধাপে ধাপে। আশা করে যায়, সবগুলো চালু হলে ঢাকা শহরের যানজট থেকে কিছুটা নয়, অনেকাংশেই কমে যাবে।