এরদোগানের দল এ.কে পার্টির ছাত্র সংগঠন একে গেন্সের আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে তাদের পার্টি অফিসে সাধারণ সভায় অংশগ্রহন করলাম। অনেকের মনে হতে পারে ১৭ বছর ধরে টানা ক্ষমতায় থাকা এক পার্টির ছাত্রসংগঠন না জানি কত দাপটের সাথে ভার্সিটিগুলো নিয়ন্ত্রন করছে। বাস্তবে কিন্তু ঠিক উল্টো চিত্র। তিন বছর তুরস্কে পড়াশুনা করেও ভার্সিটিতে এ.কে পার্টির ছাত্র সংগঠনের কোন তৎপরতা চোখে পড়েনি।কারন তুরস্কে ভার্সিটির ভেতরে সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ। তবে ছাত্রদের দ্বারা নির্বাচিত ছাত্র সংসদ আছে। তারা সরাসরি কোন দলের ছাত্র সংগঠন নয়।
তুরস্কে পড়াশোনা করা একজন বাংলাদেশির চোখে
৮০’র দশকে তুরস্কের ভার্সিটিগুলোর অবস্থা ছিল বাংলাদেশের চেয়ে ভয়াবহ। নিয়মিত গান ফাইটে মারা যাচ্ছিলো ছাত্ররা। বিশেষত কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর শ্রেনী শত্রু খতমের অংশ হিসেবে মারা যাচ্ছিল জাতীয়তাবাদী ছাত্র নেতারা। তারা আবার বুজ তুর্ক গেরিলা বাহিনী বানিয়ে কমিউনিস্ট খতমে নেমেছিল। পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রনের বাহিরে চলে যায়। ১৯৮০ সালে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে সব ছাত্র সংগঠন নিষিদ্ধ করে পরিস্থিত শান্ত করে।
পরে ধীরে ধীরে ছাত্র রাজনীতি আবার ফিরে আসে, তবে নিরস্ত্রভাবে। তারপরও সহিংসতা, উত্তেজনা এবং আশংকা ছিল।
২০০১ সালে ক্ষমতায় আসে এরদোগানের দল এ.কে পার্টি। এরদোগান নিজে তুরস্কের অন্যতম বৃহৎছাত্র সংগঠন মিল্লি তুর্ক তালাবা বিরলিইর সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন। প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল, স্পিকারসহ অনেক মন্ত্রী ছিল এই সংগঠনের সাবেক নেতা। তবে তারা এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয়। রাজনৈতিক স্বার্থে ছাত্রদের ব্যবহার না করার।লেজুড় দল না বানানোর। অন্তত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ পড়াশুনার পরিবেশ নিশ্চিত করার।
অনেক রাজনৈতিক নেতা তখন এরদোগানকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিল যে, এভাবে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে না এরদোগান। তবে নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য ছাত্রদের পড়াশুনা বলী দেয়নি এরদোগান।
ভার্সিটিগুলোর বাজেট বাড়ানো হয়েছে দশগুন। অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি বাজেট বাড়ানো হয়েছে গবেষণায়। লাইব্রেরীর জন্য। ছাত্রদের পিছনে রয়েছে বিপুল ভর্তুকি। মাত্র ২ থেকে ৩ লিরার ভার্সিটির কেন্টিনে মিলছে বুফে খাবার। দুপুরের খাবারে থাকছে সুপ,মাংস,পোলাও, টক দই, বাকলাভা মিষ্টি, আপেল, কমলা বা আঙ্গুর, সাথে আছে সালাদ বুফে, মিনারেল ওয়াটার। আবারও বলছি সবই মাত্র ২ থেকে ৩ লিরায়।বাইরে এসব খেতে ৩০ থেকে ৪০ লিরা লাগবে। কেউ এখানে ফাও খায় না। দেশের টাকায় মেধাবী ছাত্ররা খায়। দেশের সেবায় তৈরী হয়।
যাই হোক, রেংকিং বাড়ছে তরতর করে। প্রচুর বিদেশী ছাত্র আসতে তুরস্কে। ২০২৩ সালে তুরস্কে বিদেশী শিক্ষার্থী সাড়ে তিন লাখ ছাড়িয়ে যাবে। শিক্ষক রাজনীতি না থাকায় পড়াশুনা ছাড়া শিক্ষকদের কোন কাজ নেই। প্রতিটি শিক্ষকের রয়েছে নিজস্ব বই ও পাবলিকেশনস। আছে বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পে কাজ করার সুযোগ।
তুরস্কের রয়েছে টুবিটাক নামক জাতীয় গবেষণা পরিষদ। তারা দেশের জন্য ড্রোন, ফাইটার জেট, বিমানবাহী রণতরী, মেডিকেল যন্ত্রংশ, নিজস্ব মোটরগাড়ী, হেলিকপ্টারসহ নানা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রকল্প পরিচালনা করছে। এরসাথে যুক্ত করা হচ্ছে ভার্সিটিগুলোর শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের। পাশাপাশি নিজস্ব স্বাধীন গবেষণা প্রজেক্ট দেখিয়েও ফান্ড পাওয়া যায় টুবিটাক থেকে। শিক্ষক হতে নেই দলীয় সার্টিফিকেটের পরিচয়। প্রমেশনে নেই কোন দলীয় পরিচয়ের সুবিধা বা অসুবিধা। একাডেমিয়াতে সারা বিশ্বে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে এগিয়ে চলছে তুরস্ক।
আমাদের দেশ কি চিরদিন এভাবে চলবে? সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়ায় বা তুরস্কে এই জাতের ছাত্ররাজনীতি না থাকায় দেশগুলোতে কি কোন নেতার জন্ম হচ্ছে না? তথাকথিত কিছু রাজনৈতিক সংগঠন নিজেদের উদ্যেশ্য হাসিল করার জন্যই ছাত্ররাজনীতি নিয়ে খেলা করছে।
বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্ররা ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে ছিল। তখন ছাত্র রাজনীতি কিংবা সংগঠন পূর্ব থেকেই পরিচালিত হয়ে আসেনি। বাংলার দামাল ছেলেরা যেকোনো মুহূর্তেই দেশের জন্য তৈরি। সেটা ছাত্র রাজনীতি করে শিখার অভিজ্ঞতা প্রয়োজন নেই। ছাত্রদের শেষ কয়েকটি আন্দোলন করতে কোনো সংগঠনের প্রয়োজন পড়েনি। দেশের স্বার্থ এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার দাবিতে এক হয়েছিল। আন্দোলন করেছে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করে।