বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। বিসিবি’র প্রেসিডেন্ট হওয়ায় নানান সময় নানান কারণেই ট্রলের শিকার হন এই মানুষটি। তবে তাঁর পরিচয় কিন্তু এই একটাই নয়। তিনি শুধু বিসিবি’র প্রেসিডেন্টই নন। বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট-পুত্র তিনি ! তাঁর বাবা জিল্লুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি। পরিচয়পর্ব এখানেই শেষ নয়, বাকি আছে আরো। যা কিনা অনেকেরই অজানা !
একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলায় নিহত আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানের সন্তান নাজমুল হাসান পাপন ! অনেক ঘটনাবহুল তাঁর জীবন। বলা যায়, জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করে এসেছেন তিনি। গ্রেনেড হামলার দিনে মাকে ক্ষতবিক্ষত হতে দেখার পর থেকে মায়ের মৃত্যুদিন পর্যন্ত প্রত্যক্ষ হয়েছেন নানান ঘটনাগুলোর। সেই কঠিন সময়গুলো পাপন কিভাবে কাটিয়েছিলেন, সেসব নিয়েই একদা তিনি স্মৃতিচারণ করছিলেন। নাজমুল হাসান পাপনের স্মৃতিচারণ থেকে সেই দিনগুলোর কথা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। পড়ুন বাকিটুকু…
মা আইভি রহমানকে নিয়ে পাপনের স্মৃতিচারণ
“আমার সামনে তখন লাশের স্তুপ। আম্মার কাছে যেতে হলে লাশের সেই স্তুপটা ডিঙিয়ে যেতে হবে। এছাড়া যাওয়ার মত আর কোনো উপায় নাই। আমি তখন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘আম্মা তুমি চিন্তা কইরো না, আমি চলে আসছি।’ জানি না আম্মা ক্যান জানি মাথাটা নাড়লেন তখন। বুঝতে পারলাম, আম্মা তখনো বেঁচে আছেন। ওখানে যারা ছিলো তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখন কি করতে হবে।’ ওরা একটা লিস্ট দিয়ে বললেন, ‘এই এই ওষুধগুলা লাগবে। এক্ষুণি নিয়ে আসেন।’ আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, আপনাদের এখানেই তো ফার্মেসি আছে, তাই না?’ ওরা বললো, ‘না। হাসপাতালের ফার্মেসি বন্ধ। এটা আজকে আর খুলবে না।’ আশেপাশে অনেক ওষুধের দোকান। কিন্তু সবই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কেউ কোনো ওষুধ পাবেনা!”
এরমধ্যে অবস্থার আরো অবনতি হচ্ছে, কারণ রক্তক্ষরণ থামানো যাচ্ছে না। একজন এসে বললো, ‘এই মূহুর্তে অপারেশন করাতে হবে।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ডাক্তারের অভাব নাই। আমি বললাম, ‘তাহলে তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডাকেন।’
ওরা বললো, ‘কাকে ডাকবো? কোন ডাক্তার নাই।’ আম্মাকে যে একটু দেখবে, সার্জারী করবে, সেরকম একটা ডাক্তারও তখন নাই। সবাইকে সেখান থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে…
এভাবে দেখতে দেখতে প্রায় তিন ঘন্টা চলে গেল। আমরা ঠিক করলাম, আম্মাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে হবে। এমন একটা জায়গায় নিয়ে যেতে হবে, যেখানে আম্মা একটু চিকিৎসা পেতে পারে। অলরেডি এত রক্তক্ষরণ হয়েছে। কোনোরকমে আম্মাকে ধরে তুললাম। একটা অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করে সেটাতে উঠালাম। পিজি হাসপাতালে নিয়ে যাবো।
গেট দিয়ে বের হবো, এমন সময় চারদিক থেকে পুলিশের বাধা এলো। কোথায় নাকি যাওয়া যাবে না। আহত কাউকে কোথাও নিয়ে যাওয়া যাবে না ! আমি বললাম, ‘তাহলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন আপনারা। ডাক্তার আনেন, ওষুধ আনেন।’ ওরা বললো, ‘উপরের নির্দেশ, আমরা কাউকেই কোথাও যেতে দিতে পারব না’ !
যাই হোক, তখন আমিও এদিক-ওদিক ফোন করা শুরু করলাম। একটা পর্যায়ে তারা বললো, ‘আম্মাকে শুধু সিএমএইচে আমরা নিয়ে যেতে পারবো, অন্য কোথাও না।’ ভেবে দেখলাম, এখানে তো কোন চিকিৎসাই হচ্ছে না। শরীর থেকে সব রক্ত পানির মত বের হয়ে যাচ্ছে। সিএমএইচ তো ভালোই। ওইখানে গেলে নিশ্চয়ই চিকিৎসা হবে…
এই কাহিনীগুলা আসলে বলার মত না। ক্যান্টনমেন্টের গেটে আমাদেরকে বসিয়ে রাখলো এক ঘন্টা। ভেতরে ঢুকতে দিবে না। সিএমএইচে যাওয়ার পর বলে, আর্মি অফিসারের রিকমেন্ডেশন লাগবে ! আমার আম্মা ওখানে পড়ে আছে রক্তাক্ত অবস্থায়। মানুষটা মারা যাচ্ছে। এরকম অবস্থায় টানা ৮-৯টা ঘন্টা আমার আম্মাকে কোনো চিকিৎসা দেয়া হয় নাই।
একুশ তারিখে গ্রেনেড হামলাটা হয়। তেইশ তারিখ রাত বারোটায় আমি সিএমএইচ থেকে বাসায় আসি। পরদিন থেকে আওয়ামীলীগ আটচল্লিশ বা বাহাত্তর ঘন্টার হরতাল ডেকেছিলো। ঠিক রাত দুইটার সময় আমাকে ফোন করা হলো। বললো, ‘খবর পেয়েছেন তো?’ আমি বললাম, ‘কি খবর?’ ওপাশ থেকে বললো, ‘আপনার আম্মা তো মারা গেছেন।’
… একটু আগে দেখে গেলাম মানুষটা বেঁচে আছেন, এরমধ্যেই মরে গেলেন !
আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, আমি আসতেছি।’ ফোনের ওপাশ থেকে বললো, ‘এসে কোনো লাভ নাই। আমরা দাফন করে দিচ্ছি।’ আমি বললাম, ‘দাফন করবেন মানে? আমাদের আত্মীয় স্বজন আছে। আমার আব্বা আছেন। সবাইকে জানাতে হবে। জানাজা পড়াইতে হবে। এগুলো আমরা করবো।’ ওরা বললো যে, “সম্ভব না। উপরের নির্দেশ, সব এখানেই করতে হবে ! লাশ বাইরে নেয়া যাবে না।”
কিসের মধ্যে দিয়ে যে গেছি আমি, আজ পর্যন্ত এগুলা কাউকে বলি নাই…
কি বলব বলেন? এত কিছু করার পরও মানুষের মধ্যে তো মনুষ্যত্ববোধ বলে একটা জিনিস থাকে। এরা কি রাজনীতি করে? বোমা মারলো, হামলা করলো, শত শত মানুষ আহত হইলো, নিহত হইলো, তাদের চিকিৎসাটাও করতে দিলো না। লাশও নাকি দিবে না ! এটা কিসের রাজনীতি রে ভাই?”
এভাবেই নিজের গল্পটা বলেছিলেন নাজমুল হাসান পাপন।
২০০৪ সালের একুশে আগস্টে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে গ্রেনেড হামলায় নাজমুল হাসান পাপনের মা আওয়ামীলীগ নেত্রী আইভি রহমান মারা যান। একটা রাজনৈতিক দলকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্যে এমন ষড়যন্ত্র আর কখনো বাংলাদেশের মাটিতে হয়েছিলো কিনা আমার জানা নেই। সেই দলটি এখন ক্ষমতায়। তাদের হাতে যে বিরোধীদলের নেতাকর্মীরা নিপীড়নের শিকার হচ্ছে, এমন দাবী করছি না। হয়ত হচ্ছে। কিন্ত ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের কালো দিনে যে ঘটনাটি ঘটেছিলো, তার নির্মমতার সাথে আর কোনো ঘটনাকেই মেলানো যাবেনা। আর কারো পক্ষেই এতটা হিংস্র হওয়া সম্ভব হবেনা…
… জানুক সবাই পাপনের গল্পটা। জানা দরকার !