গত কয়েকদিনের চলমান ডেঙ্গু দুর্যোগের সময়ে রক্ত নিয়ে হসপিটাল গুলোয় যখন হাহাকার লেগে গেছে, নিউজফিডে একের পর এক ভেসে আসছে রক্তের অভাবে মারা যাওয়া ফুটফুটে বাচ্চাগুলোর সচিত্র খবর, ঠিক তখনই বেশ হাকডাক ছেড়ে মাঠে নেমে বড় একটা বিপ্লব ঘটিয়ে দিলো ছারপোকার আরেকটি অঙ্গসংগঠন, ছারপোকা ব্লাড ব্যাংক ! রাতারাতি অ্যাপভিত্তিক সেবা চালু করে দিয়ে একদল তরুণ দেশের প্রতিটা অঞ্চলের মানুষজনের হাতে পৌঁছে দিলো রক্তদাতার তালিকা। শুরু হয়ে গেলো ডেঙ্গু সংক্রমণের বিরুদ্ধে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের সাথে নিয়ে তাদের রক্তযুদ্ধ !
কথা বলছিলাম ছারপোকা ব্লাড ব্যাংক অ্যাপ প্রসঙ্গে। অ্যাপটি মুক্তি পাবার পর থেকে আজকের দিন পর্যন্ত মোট ১৪ দিনের অ্যানালাইসিস ঘেটে দেখা গেলো, ছারপোকা ব্লাড ব্যাংক অ্যাপ ব্যবহার করে প্রতিদিন প্রায় ৫ শতাধিকেরও অধিক রক্ত খুব অল্প সময়ের মাঝেই জোগাড় করা গেছে, এবং এই সংখ্যাটা শুধুমাত্র ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা ক্ষেত্রে ! দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশে প্রযুক্তির এমন বড়ধরণের ব্যবহার আগে কখনোই হয়নি, এবারই প্রথম ! ছারপোকা ব্লাড ব্যাংকের ডোনার ম্যানেজমেন্ট বোর্ডের প্রধান জিফরান ইসলাম রবিন তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন।
ফেসবুকে মানুষজনের শোঅফ আর নানানরকম এক্টিভিটি দেখে যারা বিশ্বাস করেন, “দেশটা বোধহয় এবার বদলে গেছে। জনগণ দেশের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। এই রোদ্রের ভেতর আর আমার সোশ্যালওয়ার্কে যাবার দরকার নেই“। তারা আসলে খুবই ভুলের ভেতর আছেন…
বেসরকারি একটি সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর রক্তের চাহিদা থাকে প্রায় ৮-৯ লাখ ব্যাগ ! ফেসবুকে এখন কমবেশ সবার মাঝেই সমাজ নিয়ে ভাবনা আর সচেতনতার ছোঁয়া দেখা গেলেও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় রক্তটাই ঠিকমত মিলছেনা। কোনোখানেই রক্তের যোগান পর্যাপ্ত নয়। কিছূ সংস্থা তো নিজেদের তুলে ধরার জন্য বলেই বসে, “রক্ত কয় ব্যাগ লাগবে? আমার কাছে পাঠিয়ে দাও…”
শেষে দেখা যায়, রক্তদাতার কোনো খবর নেই ! (রক্ত নিয়ে বাদবাকি ব্যবসাগুলোর বিষয়ে আর না যাই)
বেসরকারি তো গেলো, সরকারি পরিসংখ্যানের কথায় আসি। বছরখানেক আগের একটি সরকারি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, দেশের রক্তদাতাদের মধ্যে প্রায় ৩৭ শতাংশ রক্তদাতাই হচ্ছে এই লাইনে পেশাদার। বাকিরা সাধারণ রক্তদাতা। কেউ মানবতার টানে রক্ত দেয়, কেউ রক্ত দেয় শুধুই মানবিক কাজে অংশ নিতে। আর বাদবাকি যারা আছেন, তারা শুধু পরিবারের কোনো আত্মীয়ের অপারেশনের জন্য রক্ত লাগলে চাপে পরে সেখানে গিয়ে রক্ত দিয়ে আসেন।
বাংলাদেশের রক্ত নিয়ে কাজ করছে এমন সংস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি সংস্থা হচ্ছে ছারপোকা ব্লাড ব্যাংক। এটি আমাদের নিজস্ব ব্লাড ব্যাংক। ছারপোকা ম্যাগাজিনের মাসিক আয় থেকে একটি বড় অংশ খরচ করা হয় এই ব্লাড ব্যাংকটি পরিচালনার পেছনে। কোনোপ্রকার আর্থিক লেনদেন ছাড়াই শুধুমাত্র মানবিকতার স্বার্থ্যে আমাদের ম্যাগাজিন পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ এই প্রজেক্টটি চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিদিন অসংখ্য রক্তচাহিদার ঘাটতি পুরনের লক্ষ্যে গত সপ্তায় আমরা অ্যান্ড্রয়েড ফোনের জন্য গুগল প্লেস্টোরে রিলিজ দিয়েছি আমাদের নিজস্ব ব্লাড ব্যাংক অ্যাপ ! ২০২০ সালের মধ্যে কমপক্ষে ২০ লক্ষ্য রক্তদাতার তালিকা দেশের প্রতিটা প্রান্তের প্রতিটা মানুষের হাতে পৌঁছে দিতে এই প্রজেক্টের পেছনে নিঃস্বার্থভাবে যেমন খরচ করে গেছি, তেমনি বিসর্জণ দিয়ে হাজার রাতের ঘুম। পরিশেষে আমরা সফল ! বাংলাদেশের সবচেয়ে একটিভ/স্বক্রীয় রক্তদাতাদের নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনার ঝড় তুলে দিয়েছে ছারপোকা ব্লাড ব্যাংক। আর এরইমাঝে জানা গেলো, দেশে চলমান এই ডেঙ্গু বিপর্যয়ের সময়ে প্রতিদিন আমাদের অ্যাপটি ব্যবহার করে রক্তের সন্ধান পাচ্ছেন প্রায় পাঁচ শতাধিক মানুষ ! মানে হচ্ছে, সামান্য ২ মেগাবাইট সাইজের এই অ্যাপটিই প্রতিদিন ৫০০ ব্যাগ রক্ত জোগাড় করে দিচ্ছে ! ২০ লাখ রক্তদাতার ডাটাবেজ নির্মাণের কাজে আমরা এখন অনেক দুর…
এই সফলতার পরিমাপটা আরো বাড়াতে চাইলে নিজ দায়িত্ববোধ থেকেই এবার ছারপোকার জন্য কিছু করুন। কি করবেন? তেমন কিছু না। আপনার কাছের পাঁচ দশজন বন্ধুকে ছারপোকা ব্লাড ব্যাংক অ্যাাপটি ইনস্টল করান। কেউ রাজি না হলে প্রয়োজনে তাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে আসুন। দুধ চা খেয়ে গুলি করে দেয়ার ভয় দেখান। কথায় কথায় ডিপজলের ডায়ালগ গুলো ব্যবহার করুন। মানবিক কাজে আপনার এতটা উৎসাহ দেখে অন্তত লজ্জায় পরে হলেও ৫ জন মানুষ এগিয়ে আসবে আপনার মত হবার জন্য !
অ্যাপটির কার্যক্রম সম্পর্কে জিফরান ইসলাম রবিন বলেন –
“রক্তদান একটি মহৎ কাজ, দিন দিন আমাদের দেশের তরুণরা রক্তদানে আগ্রহী হচ্ছে, কিন্তু যোগাযোগ রক্ষার অভাবে ডোনার যথেষ্ট থাকা সত্বেও রক্ত সময়মত পাওয়া যাচ্ছেনা। তাছাড়া বর্তমানে ডেংগু জ্বরের মহামারী আকার ধারণ করার কারণে রক্তের চাহিদা প্রচুর বেড়ে গেছে। এমতাবস্থায় ফেসবুক এবং অ্যাপসের মাধ্যমে আমরা গড়ে দৈনিক ৫০০ ব্যাগ এর মত রক্তের ব্যবস্থা করে দিতে পারছি। ৫০০ ব্যাগ রক্ত জোগাড় হয়ে যাওয়াটা কিন্তু সহজ কথা নয়। এটাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। এটা জানি যে, দেশের প্রতিষ্ঠিত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো এবং বাজারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রক্তব্যবসায়ীদের কারণে আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় সুযোগসুবিধা পাবোনা। কর্পোরেটদের চোখে ধুলো দিয়ে তারা স্পন্সরশিপ নিবে। রক্ত ব্যবসার টাকা হয়ত তাদের সম্পদ বৃদ্ধির পেছনে ঢালবে। কারো সাহায্য ছাড়াই শুধুমাত্র নিজেদের চেষ্টায় আমরা যেহেতু এতদুর আসতে পেরেছি, এখন আরো কয়েক লাখ মানুষের সাপোর্ট আছে আমাদের সাথে। তারা এভাবে সবার মাঝে আমাদের অ্যাপটি ছড়িয়ে দিতে থাকলেই আমরা পুরো বাংলাদেশে একটি ভিন্নরকম রক্তদান সেবা প্রতিষ্ঠা করতে পারবো। ডোনার ডাটাবেজ সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে আমাদের টিম কাজ করে যাচ্ছে। আশা করছি, ২০২০ সালের ভেতর দেশের প্রায় ২০ লাখ ডোনারকে আমরা একটি ইউনিটের ভেতর নিয়ে আসতে পারবো। যেখানে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে শহরের মানুষরাও থাকবে। দেশের কোনো স্থানেই আর রক্তের অভাবে কোনো রোগীর মৃত্যু হবেনা।”
গুগল প্লে-স্টোর থেকে ছারপোকা ব্লাড ব্যাংক অ্যাপটি ডাউনলোড করে নিতে ভিজিট করুন : Charpoka Blood Bank app