সাদ্দাম হোসেন, ইরাকের সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং একজন বিতর্কিত স্বৈরশাসক। যাকে মানবতাবাদী অপরাধের অভিযোগে ফাঁসির দড়িতে পর্যন্ত ঝুলতে হয়েছে ! পুরো নাম সাদ্দাম হোসেন আবদুল মাজিদ আল তিকরিতি। জীবদ্দশায় তিনি ছিলেন বহুল আলোচিত ও সমালোচিত। কারো কাছে তিনি শ্রদ্ধার পাত্র, আর কারো কাছে ঘৃণার পাত্র।
সাদ্দাম হোসেন সম্পর্কিত বেশকিছু তথ্য নিয়ে ছারপোকার এই প্রতিবেদন। এ তথ্যগুলো বেশিরভাগ মানুষেরই অজানা…
একজন অজানা সাদ্দাম হোসেন
১. মাত্র ২০ বছর বয়সে বাথ পার্টিতে যোগদানের মধ্য দিয়ে রাজনীতির ক্যারিয়ার শুরু করেন।
২. ১৯৬৮ সালে বাথ পার্টি ২য় বারের মত রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে। আর সাদ্দাম হোসাইন আল মজিদকে করা হয় ভাইস প্রেসিডেন্ট।
৩. ১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করলে সাদ্দাম হোন ইরাকের প্রেসিডেন্ট।
৪. তার শাসনামলে ইরাকের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়। সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নতি ঘটে।
৫. সাদ্দামের নেতৃত্বে ১৯৮০-৮৮ সাল পর্যন্ত ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালিত হয়। এতে উভয় দেশের অর্থনীতি মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তবে এ যুদ্ধে কেউই জয়লাভ করতে পারেনি। এ যুদ্ধে ইরাককে পেছন থেকে ইন্ধন যুগিয়েছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব।
৬. ইরাক-ইরান যুদ্ধে সাদ্দামের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ উঠে। অভিযোগটি ছিলো ১৯৮৮ সালে কুর্দি শহর হালাফজায় অভিযান পরিচালনা করে কুর্দিদের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে ৫ হাজার কুর্দির মৃত্যু ঘটান।
৭. সাদ্দাম ১৯৯০ সালে কুয়েত দখল করে নেন। আর তাতে বেঁকে বসে ইরাক মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। তারা কুয়েতের পক্ষ নেয়। আর এ বেঁকে বসার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রর গোপন অভিসন্ধি ছিলো ! তা হলো মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করে সামরিক ও বাণিজ্যিক সার্থ হাসিল করা ! ইরাক-কুয়েত যুদ্ধে মার্কিন বাহিনী কুয়েতের পক্ষে অংশ নিলে ইরাক পরাজিত হয়।
৮. ইরাকের কাছে ব্যাপক মানব বিধ্বংসী রাসায়নিক ও জীবাণু অস্ত্র রয়েছে এমন মিথ্যা অভিযোগ দাঁড় করায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। তাদের নেতৃত্বাধীন বাহিনী ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণ করে। এ যুদ্ধে সাদ্দামের বাহিনী পরাজিত হয়। সাদ্দাম আত্মগোপনে চলে যান। একই বছরের ডিসেম্বরে মার্কিন সেনারা সাদ্দামের নিজ শহর তিকরিত থেকে তাকে আটক করে।
৯. সাদ্দামকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। বিশেষ আদালতে তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগটি ছিলো – তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেছে অভিযোগে তিনি ১৯৮২ সালে ১৪৮ নাগরিককে ফাঁসি দিয়েছিলেন।
১০. সাদ্দাম হোসেন আদালতে যেসব বলেছিলেন তার কিছু অংশ –
“আমি সাদ্দাম হোসেন আল মজিদ, ইরাকের প্রেসিডেন্ট। আপনাকে একজন ইরাকি ধরে আমি কথা বলছি। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আমি ইরাকের প্রেসিডেন্ট ছিলাম যখন কুয়েতে আক্রমণ চালানো হয়। দুঃখজনকভাবে একজন ইরাকির থেকেই আমার উপর এই অভিযোগ আসলো, এটা কি ন্যায়বিচার হলো? সেই কুয়েত যারা বলেছিলো, সব ইরাকি মেয়েদের রাস্তার ১০ দিনারের পতিতা বানাবে। আমি ইরাকের সম্মান রক্ষা করেছি এবং কুয়েতের উপর ইরাকের ঐতিহাসিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছি।”
… “কোন সংবিধান দ্বারা বিচার হবে, যে সংবিধান সাদ্দাম হোসেন সাইন করেছিলো, নাকি সেই সংবিধান যা আমেরিকানদের দ্বারা লিখিত?”
… “তারা মিথ্যাবাদী। তারা ঘোষণা দিলো, আমাদের দেশে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে। এখন বলছে তারা পায়নি। কিন্তু সাদ্দাম মিথ্যা বলে নাই, আমি এখনো আমাকে করা আঘাতের চিহ্ন দেখাতে পারি। ইরাক কখনোই মিথ্যাবাদীদের গ্রহণ করেনি, আজও করবেনা।”
১১. আমেরিকা যখন বেঁকে বসেছিলো তখন ইরাকের বিদ্রোহী জনতাকে উসকে দিলো যুক্তরাষ্ট্রর আগ্রাসন। ইরাকে মার্কিন সেনারা এলো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে। গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হলে সাদ্দামের অনুগতরাও ভোল পাল্টে ফেললো। ইরাকে স্বাধীনতা চাই রব উঠলো। সেটাকেই কাজে লাগালেন মার্কিন সেনারা।
১২. ফিরদৌস চত্বর, যেখানে সাদ্দাম নিজের মূর্তি স্থাপন করেছিলেন সেখানে ক্ষোভ নিয়ে জড়ো হলো ভাড়াটে জনতা। ইরাকের বহু সাধারণ নাগরিকও তাদের সঙ্গ দিলো। একটু দূরেই এক হোটেলে এসেছিলেন আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোর পক্ষ থেকে সাংবাদিক ও চিত্রসাংবাদিকরা। রবার্ট ফিস্কের ভাষায়, ইতিহাসের ২য় সেরা সাজানো ফটোগ্রাফির আয়োজন ছিলো এখানে। ইরাকি জনতার একাংশ সাদ্দামের মূর্তি ভাঙতে উদ্যত হলো। মার্কিন সেনারা উত্তেজিত জনতার মাঝেই মূর্তির কাছে পৌছান। মেরিন করপোরাল এডওয়ার্ড চিন মই দিয়ে উঠে সাদ্দামের মূর্তির মুখ আমেরিকার পতাকা দিয়ে ঢেকে দেন। তখনই শুরু হয় শোরগোল। পক্ষে-বিপক্ষে ভাগ হয়ে জনতা হইচই শুরু করলেও মার্কিন সেনাদের অস্ত্রের মুখে তা খুব একটা কাজে লাগেনি। তবুও এক ইরাকি মহিলা চিৎকার করে বলেছিলো, মার্কিন পতাকা সরাও, ইরাকি পতাকা দিয়ে ঢাকো। সে কথা কেউ কানে তুলেনি। তারপর মূর্তি গুড়িয়ে দেয়া হয়।
১৩. এরপরই বিশ্ববাসী দেখলো মার্কিন সেনাদের আসল চেহারা। সাজানো অভিযোগ আর নাটক দিয়েই শেষ হলো সাদ্দাম অধ্যায়। তবে ইরাকি জনগণকে যে স্বাধীনতার স্বাদ ও গণতন্ত্রের সুবাতাস বইয়ে দেয়ার স্বপ্ন তারা দেখিয়েছিলো তা ছিলো পুরোটাই ধোঁকা। এক মাসের ব্যবধানে ফিরদৌস চত্বরে তৈরি হলো এক ইরাকি পরিবারের মূর্তি। তারা ইসলামি শাসনে স্বাধীনতার আনন্দে ডুবে আছে – এমন মূর্তি স্রেফ সিমেন্ট, বালুতেই গড়তে পারলো মার্কিনিরা। আদতে নির্যাতন, দুর্নীতি আর দারিদ্রতায় ডুবলো ইরাক। জঙ্গি সংগঠনগুলো দুর্বিষহ করে তুললো ইরাকিদের জীবন।
১৪. বিশ্ব চলে তেলের দামে। মধ্যপ্রাচ্যর তেলের দিকে যুক্তরাষ্ট্রর নজর বহু আগে থেকেই। বিশ্বের প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর একটি ইরাক। ইরাক-ইরান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের পক্ষে ছিলো, কারণ তখন তাদের দু দেশের মধ্যে একরকম গলায় গলায় ভাব ছিলো। কিন্তু সেই বন্ধুত্বে ফাঁটল ধরলো যখন সাদ্দাম তার দেশের তেল দেশের উন্নয়নেই কাজে লাগাতে চাইলেন। ইরাকের তেল শুধু নিজের দেশের জন্য নয়, মধ্যপ্রাচ্যে জাতীয়করণের মাধ্যমে সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে ছিলেন সাদ্দাম। তখনই বাধলো ঝামেলা। ইরাককে অস্থিতিশীল করতে ইরাক-কুয়েত যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরি চেহারা বদলে ফেললো। কুয়েতের পক্ষ নিলো যুক্তরাষ্ট্র। তেলের জন্যই যুক্তরাষ্ট্রর এই খেলাটা টের পেয়ে যান সাদ্দাম। যুক্তরাষ্ট্রও তা আর গোপন করেনি।
১৫. মধ্যপ্রাচ্যে তেল জাতীয়করণের পেছনে সাদ্দামের অবদান অনেক। তিনিই প্রথম তেল জাতীয়করণ করেছিলেন এবং একই পথ ধরে বাকি আরব রাষ্ট্রগুলোও তেল জাতীয়করণ করেছিলো। ফলাফলে তেল থেকে প্রাপ্ত মুনাফা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো নিজেরাই ব্যবহার করতে পারছে ও অবকাঠামো গড়ে তুলছে। তবে তেলের এই রমরমা বাজারের প্রথমসারির ক্রেতা পশ্চিমিরা। যে কারণে তেলের বাজারে হস্তক্ষেপ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে তারা। মধ্যপ্রাচ্যের এই দামী তেলের দখল নেওয়া ও রাজনৈতিক প্রভাব বাড়ানো, দুটোই দরকার। কিন্তু সে পথে বাঁধা ছিলেন সাদ্দাম। তাই তাঁকে উপড়ে ফেলা হয়েছে।
১৬. বাগদাদ কারাগারে থাকাকালীন সাদ্দাম কখনো কারাগারের বাগানে সময় দিতেন, কখনো মাফিন খেতেন।কখনো বা রেডিওতে মেরিজে বিজের গান শুনে কাটিয়েছিলেন।তিনি আমেরিকা শিল্পীদের পারিবারিক ব্যাপারগুলো নিয়ে গাওয়া গানগুলো পছন্দ করতেন।
১৭. সাদ্দাম ইরাক শাসন করেছিলেন ২৪ বছর। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করার জন্য তিনি যেমন আলোচিত ছিলেন তেমনি সমালোচিত ছিলেন বিলাসী খরচের জন্য। ২৪ বছরে তিনি ৭০টিরও বেশি প্রাসাদ বানিয়েছিলেন। বিলাসী আয়োজনে একেকটি প্রাসাদ ছিলো একটির চেয়ে আরেকটি স্বপ্নপুরী।
১৮. সাদ্দামের পতনেই জন্ম নেয় আইএস। সাদ্দামের আমলের শতাধিক সেনা কর্মকর্তা আইএসের নেতৃত্বে আছেন।এমনকি আইএস ইরাকে যুদ্ধ শুরু করার পর সাদ্দাম হোসেনের মামলার সেই বিচারককে হত্যা করে।