তিনি বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তী, যার প্রতিটা কথায়, প্রতিটা শব্দচয়নে বদলে যায় মানুষের আবেগ, বদলে যায় অনুভব করার দৃষ্টিভঙ্গি ! আজ ১৯ জুলাই হুমায়ূন আহমেদ এর সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী। শোকের এই দিনটাতে বছরদুয়েক আগে প্রিয় বাবাকে স্মরণ করে ফেসবুকে দু’লাইন লিখেছিলেন তাঁর মেয়ে শীলা আহমেদ। পাঠকদের জন্য শীলা আহমেদের লেখাটি ছারপোকায় প্রকাশ করা হলো…
“আমার বাবা ছিলেন লেখক মানুষ। তার ছোট্ট কাঠের একটা টুল ছিল। সেটা নিয়ে যেখানে সেখানে লিখতে বসে যেতেন। আমাদের খেলা-ঝগড়া-হাসাহাসি কোনো কিছু্ তার লেখালেখিতে সমস্যার সৃষ্টি করতে পারতো না। এবার প্রথম আমার বরকে দেখলাম লেখক হিসেবে। একেবারে বাবার উল্টো। ওর লেখার জন্য পিসফুল মাইন্ড লাগে। চুপচাপ বাসা লাগে। আর লেখার সময় কেউ ওর সাথে কথা কথা বলতে পারবে না।
বেচারারা জন্য বিরাট ঝামেলা হয়ে গেল! পিসফুল মাইন্ড সম্ভব না, কারণ ছোটবেলা থেকে আমি খুব ঝগড়াটে। চুপচাপ বাসা সম্ভব না, কারণ বাসায় চারটা বাচ্চা। আর ওকে একটু পর পর ডাকাডাকি করা আমার স্বভাব। এতো ঝামেলার মধ্যে ও যখন একটা উপন্যাসের অর্ধেকের মতো লিখে ফেললো, তখন আমাকে পড়তে দিল। বলল-পড়ে দেখোতো কেমন হয়েছে? কোন জায়গা ঠিক করতে হলে, বোলো!
আমি বললাম- অবশ্য্ই পড়বো, কিন্তু কোনো জায়গা ঠিক করতে হবে কিনা, বলতে পারবো না। আমি তো লেখকের মেয়ে, সারাজীবন দেখেছি লেখকরা আলোচনা সহ্য করতে পারেনা। বাবাকে কোনো লেখা নিয়ে একটু কিছু বললে প্রচণ্ড রেগে যেত। এমন বকাবকি শুরু করতো ভয়ে অনেকক্ষণ সামনে যেতাম না! ও হাসতে হাসতে বললো- আরে ধুর আমি কি তোমার বাবার মতো ছেলেমানুষ নাকি! আমাকে চিনো না? আমি খুব ভালোভাবে সমালোচনা নিতে পারি। তুমি নির্দয়ভাবে সমালোচনা করবে।
– কেমন হয়েছে?
– ভালো!
– ভালো মানে কি? ঠিকমতো বল।
আমি ওকে অল্পকিছু বলি। মনে হয় এই জায়গাটায় একটু তাড়াহুড়া করছো…
কিছুক্ষণ স্বাভাবিকমুখে আমার কথা শুনে। তারপর রাগীরাগী হয়ে যায়। আমাকে বলে- “থাক তোমার আর বলা লাগবে না। আমি তো দেখলাম তুমি লাইন বাদ দিয়ে দিয়ে পড়ছিলে। তোমার মন ছিল না পড়ার মধ্যে”।
আমি ওর হাত ধরি। বলি-“রাগ করছো কেন?” ও আরো রেগে যায়। উঠে চলে যায় আমার সামনে থেকে। রাতে ভাত খায় না ঠিকমতো। আমি বকা খাওয়ার ভয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে চলে যাই। অনেক সকালে ও আমাকে ডেকে তুলে। বলে- আসোতো, পড়ে দেখ এখন। আমি ঠিক করেছি।
ওর লেখা পড়তে গিয়ে আমার কান্না চলে আসে। কতোদিন পর আবার এক রকম ঘটনা ফিরে আসলো! বাবাও তো কিছুক্ষণ পর পর ডাকতো-“শীলা বাবা, এখন পড়ে দেখতো ঠিক করেছি।” যেন আমি (!) কতোবড় একজন ক্রিটিক! যেন কতোকিছু যায় আসে আমার ভালো লাগায়, আর না লাগায়!
আমার বাবা ছিলেন একজন লেখক। আর আমার কাছে আমাদের বাসাটা ছিল লেখকের বাসা। ছোট্ট কাঠের টুলে বাবা লিখতো। মা চা বানিয়ে দিতো একটু পরপর। প্রকাশকরা আসতেন। মা প্রুফ দেখে দিত। ধ্রুব এষ প্রচ্ছদ নিয়ে এসে চুপচাপ বসে থাকতেন ঘরের কোনায়! যখন বই বের হতো বইয়ের সাথে সাথে বাসায় মিষ্টি আসতো। আমার চারজন (মা, নোভা, আমি আর বিপাশা) চারটা বই খুলে বসতাম। বাবা পায়চারী করতে করতে সিগারেট খেতো। বই পড়তে পড়তে কখনো হেসে উঠলে সাথে সাথে জিজ্ঞেস করতো-” কোন জায়গাটা পড়ছো বাবা?” বই পড়া শেষ হলে বলতো-“বাবা চোখে পানি এসেছে?” আমরা খারাপ কোয়ালিটির পাঠক ছিলোম, বাবার সব বই পড়েই চোখে পানি চলে আসতো।
আমার বরের উপন্যাস লেখা শেষ হয়। একরাতে ও আমার হাতে ওর নতুন বইয়ের একটা কপি তুলে দিয়ে বলে-এটা তোমার জন্য! তুমি খুশী তো? প্রিয়তম স্বামী, আমি প্রচন্ড খুশী। তোমার বই মাস্টারপিস হয়েছে অথবা কিছু্ হয়নি তার জন্য খুশী না। খুশী এজন্য যে তোমার এই বই আর বই লেখার জার্নি আমাকে প্রাউড করেছে, নষ্টালজিক করেছে, একটু একটু জেলাস (প্রথম প্রেম নিয়ে উপন্যাস লিখলে তো একটু জেলাস হবোই!) করেছে।
হ্যাঁ এটা ঠিক যে, আমাদের এখন কোনো ছোট্ট লেখার টুল নাই, প্রকাশকদের আড্ডা নাই, চুলায় সারক্ষণ চা নাই, ধ্রুব এষের প্রচ্ছদ নিয়ে আসা নাই (এখন প্রচ্ছদ নেটে চলে আসে!), মিষ্টিও নাই । তাতে কি! এটা না হয় আমাদের অন্যরকম লেখকের বাসা হলো! তোমার জন্য অনেক শুভকামনা আর দোয়া।”