এরশাদ বিরোধী আন্দোলন : দেশ কাঁপানো শেষ ১০ দিন

স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদেরকে লড়তে হয়েছিলো মাত্র ৯ মাস। আর সেই স্বাধীন দেশেই গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে দীর্ঘ ৯টা বছর। হতকাল ১৪ই জুলাই ২০১৯ তারিখে বর্ষীয়ান এ নেতা ‍মৃত্যুবরণ করেন। তাকে নিয়ে অনেক ঘটন-অঘটনই এ প্রজন্মের অজানা। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় ঘটনাটি হচ্ছে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন বা এরশাদ সরকারের পতন !

কিভাবে এত বড় শাসকের পতন হলো? কেমন ছিলো এরশাদের সেই দিনগুলো? ক্ষমতার শেষ ১০ দিন এরশাদ কি করেছেন? এসব নিয়েই আজকের এই প্রতিবেদন ! পড়ুিন বিস্তারিত…

দেশ কাঁপানো শেষ ১০ দিন

১৯৮২ সালে ২৪ মার্চ থেকে এদেশে যে রক্তাক্ত সংগ্রামের যাত্রা শুরু হয়েছিলো, তা শেষ হয় নব্বইয়ের ৪ ডিসেম্বর। নব্বইয়ের ২৭ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর ছিলো স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে গণবিস্ফোরণ। ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের সেনাপতি শাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে যে গণঅভ্যুত্থান হয়েছিলো, তারপর সেরকম নিরস্ত্র গণআন্দোলন ঘটে নব্বইয়ে। দীর্ঘ ২৮ বছর পর সেই সামরিক শাসক এরশাদ একাদশ জাতীয় সংসদে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বিরোধী দলীয় নেতা। কিন্তু গুরুতর অসুস্থবস্থায় সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন থাকার কারণে ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে তিনি যোগ দিতে পারেননি।

এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ‘জেহাদ’ নভেম্বর মাসের প্রথমদিকে পুলিশের গুলিতে নিহত হলে ছাত্রসমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তখন থেকে সামারিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন তীব্রতর হতে থাকে। বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহ এবং আইনজীবী, ডাক্তার, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হতে থাকেন। ১৯৯০ সালের ১৯ নভেম্বর ৩ জোট স্বৈরাচারের পতন এবং পরবর্তীকালে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি রূপরেখা প্রকাশ করে। এই ঐতিহাসিক রূপরেখা প্রকাশের ৮ দিনের মাথায় অর্থাৎ ২৭ নভেম্বর গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনের অন্যতম কর্মী ডা. মিলনকে এরশাদের লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসীরা টিএসসির মোড়ে গুলি করে হত্যা করে। এর ফলে সারাদেশে আগুনের মতো বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভ দমনে সরকার জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে। তাতেও কোনো লাভ হয়নি। বরং আন্দোলন আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে এবং স্বৈরাচারী এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য হয়।

এরশাদের পতনকে ঘিরে শেষ ১০দিন বিদ্রোহের আগুনে জ্বলছিলো পুরো দেশ। সেই দেশ কাঁপানো ১০ দিনের চিত্র নিচে তুলে ধরা হলো…

২৭.১১.৯০

মিলনের মৃত্যু সারাদেশে ক্ষোভের আগুন

এ দিন এরশাদীয় স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বাংলার আকাশে-বাতাসে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। বিকেলে গৃহবন্দি করা হয় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে। বিএনপি সভানেত্রী বেগম খালেদা জিয়া পুলিশের চোখে ধুলা দিয়ে প্রায় পুলিশের সমনে দিয়ে গোপন আস্তানায় চলে যান এবং সেখান থেকে আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বদলীয় ছাত্র-ঐক্যের লাঠি মিছিলকে ঘিরে লাঠি মিছিল শেষে পিজি হাসপাতার যাওয়ার পথে সরকারের সর্বোচ্চ মহলের নির্দেশে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা টিএসসি’র মোড়ে গুলি করে হত্যা করে বিএমএ’র অন্যতম নেতা ডা. শামসুল আলম খান মিলনকে। ডা. মিলনের মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশ দ্রুত বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ডা. মিলনের মৃত্যুর প্রতিবাদে স্বৈরাচার সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত ডাক্তাররা ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। ডাক্তারদের এ ঘোষণার পর আইনজীবীরাও স্বৈরাচারী সরকাররের পতন না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘটের ডাক দেন। রাত ৯টা থেকে সরকার জরুরি অবস্থা জারি করলে এর প্রতিবাদে সরকারবিরোধী ৩ জোট লাগাতার হরতাল কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। এই ঘোষণার পর থেকে একই সঙ্গে চলতে থাকে কারফিউ এবং লাগাতার হরতল।

এদিকে ১৯৯০ সালের এই দিনে সামরিক স্বৈরাচারী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সকল সংবাদপত্রের উপর সেন্সরশিপ জারি করে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিবকে সাংবাদিকদের লিখিত প্রতিবেদন দেখিয়ে ছাড়পত্র আনার বিধান করা হয়। এরই প্রতিবাদে বিএফইউজে ও ডিউজের ডাকে সাংবাদিকরা এরশাদের পতন না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট পালনের ঘোষণা দেয়। ফলে সারাদেশে সকল সংবাদপত্রের প্রকাশনা বন্ধ থাকে। অন্যদিকে এদিন রাতে কারফিউ লঙ্ঘন করে হাজার হাজার মানুষ রাজধানীতে মিছিল সমাবেশ করে। এ সময় পুলিশ এবং বিডিআর-এর সঙ্গে ছাত্র জনতার সংঘর্ষ হয়। এরশাদের পতন না হওয়া পর্যন্ত সাংবাদিকরা ধর্মঘট পালন করার আন্দোলনের উত্তপ্ত সময়ে বাংলাদেশের মানুষ দেশের সঠিক চিত্র দেশের গণমাধ্যমগুলোর মাধ্যমে জানতে পারেনি। এ সময় এদেশের মানুষের প্রধানতম ভরসা ছিল বিবিসি এবং ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা সংবাদ।

২৮.১১.৯০

কারফিউ ভেঙে ঢাবি ছাত্রীদের লাঠি মিছিল

সামরিক স্বৈরাচারী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ গণআন্দোলন প্রতিহত করতে ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর (মঙ্গলবার) রাতে সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করায় বাংলাদেশের সঙ্গে বহিঃবিশ্বের প্রায় সব ধরনের যোগাযোগই বিছিন্ন করা হয়। ফলে পরদিন বুধবার (২৮ নভেম্বর) বাংলাদেশ বহিঃবিশ্ব থেকে বিছিন্ন হয়ে পরে। এ কারণে বিদেশী গণমাধ্যমগুলো এদিন বাংলাদেশ সম্পর্কে তেমন কোনো সংবাদ প্রকাশ করতে পারেনি। এদিকে জরুরি অবস্থা জারি করার আগেই ৩ জোটের পক্ষ থেকে বলা হয় , সরকার দেশে জরুরি অবস্থা জারি করতে পারে, তারা জনগণকে আহ্বাণ জানান, যদি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয় তবে যেন তার পর দিন থেকেই জনগণ অদির্নিষ্ট কালের জন্য হরতাল শুরু করে। এ কারণে এদিন (২৮ নভেম্বর) সারাদেশে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। অন্যদিকে জরুরি অবস্থা লংঘন করে এদিন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে একটি বিশাল মিছিল বের হয় । এ বিক্ষোভ মিছিলে লাঠি হাতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্রী অংশগ্রহন করে। বিশ্ববিদ্যালয় ও শহীদ মিনার চত্বরে দুটি বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় । এদিন ভোরে বিক্ষুব্ধ জনতা মালিবাগে রেলপথ অবরোধ। লাইনে গাড়ি রেখে ড্রাইভার পালিয়ে যায় । সারা দেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে । যাত্রাবাড়ী, পোস্তগোলা, নর্থসাউথ রোড, রামপুরা, মালিবাগ, পল্টন এলাকায় কারফিউ ভঙ্গ করে হাজার হাজার জনতার মিছিল করে । মালিবাগে গুলিতে ২ জন বিক্ষোভকারী নিহত হয় । সামরিক স্বৈরাচারী এরশাদে পতন না হওয়া পর্যন্ত ২৭ নভেম্বর থেকে সাংবাদিকরা ধর্মঘট পালন করার এদিন কোনো সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়নি। সংবাদপত্রের প্রকাশনা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তের প্রতি বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদ সমর্থন জানায়।

২৯.১১.৯০

জনতার সঙ্গে নিরাপত্তাবাহিনীর খণ্ডযুদ্ধ

গণআন্দোলন প্রতিহত করতে সামরিক স্বৈরাচারী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য জরুরি অবস্থা জারির পর দিন যতই গড়াতে থাকে গণআন্দোলন ক্রমেই তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। তবে ১৯৯০ সালের এ দিন (২৯ নভেম্বর) সকালে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার হয়। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ছাত্রশিক্ষক যৌথ সমাবেশে উপাচার্যসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক পদত্যাগের ঘোষণা দেন। আর চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের সকল শিক্ষক পদত্যাগ করেন। অন্যদিকে হাজার হাজার ডাক্তার প্রেসিডেন্ট এরশাদ পদত্যাগ না করা পর্যন্ত কর্মবিরতি পালন শুরু করেন।

এদিন পুনারায় কারফিউ জারী করা হলে জনতা কারফিউ লঙ্ঘন করে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করে। রাজধানীতে পুলিশ, বিডিআর-এর পাশাপাশি সামরিক বাহিনীর গাড়ির অবস্থান গ্রহণকরে। মালিবাগ, মৌচাক, রামপুরা এলাকায় জনতার সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর খণ্ডযুদ্ধে শাহজাহানপুরে ১ জন ও খিলগাওয়ে দুইজনের মৃত্যুবরণ করে। জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারে মার্কিন সরকারের আহ্বান জানিয়েছে। আর ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয় বাংলাদেশের আন্দোলনের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পতা নেই। অল ইন্ডিয়া রেডিও পররাষ্ট্র মন্ত্রকের একজন মুখপাত্রের উদ্বৃতি দিয়ে বলে যে, ভারত আশা করছে বাংলাদেশে শীঘ্রই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে এবং যত তারাতারি সম্ভব জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে।

৩০.১১.৯০

জনতার মিছিলের মুখে সৈন্যদের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা

৩০ নভেম্বর শুক্রবার জুমার নামাজের পর গত কয়েকদিন নিরাপত্তা বাহিনীর গুলীতে নিহতদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। মূল জমায়েত অনুষ্ঠিত হয় বায়তুল মোকারমের স্টেডিয়াম সংলগ্ন গেটে। ১১ লড়ি বোঝাই সৈনিক অবস্থান নেয়। আর পুলিশ অবস্থা নেয় উত্তর গেটে । বায়তুল মোকাররমে হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হয় । মুসুল্লিদের মসজিদে ঢুকতে সৈন্যরা বাধা দেয়। তবে বায়তুল মোকাররমের খতিবের হস্তক্ষেপে বিষয়টি নিস্পত্তি হয়। গায়েবানা জানাজা শেষে হাজার হাজার জনতার একটি বিশাল মিছিল রেব হয়। জনতার এই মিছিল ভঙ্গ করতে পুলিশ কাকরাইলে জনতার উপর গুলিবর্ষণ করে। জনতার জঙ্গী মিছিলের মুখে এদিন সৈনিকেরা নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে গায়েবানা জানাজায় অংশ নেন বিরোধী দলীয় নেতারা। এর আগে সকালে নারী সমাজের সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। রামপুরা ওয়াপদা রোডে বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর সময় গুলিতে মা নিহত। জরুরি অবস্থা এবং কারফিউ বলবৎ থাকা সত্তেও এদিন (৩০ নভেম্বর) ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটেসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জনগণ বিক্ষোভ সমাবেশ করে।

০১.১২.৯০

১২ বিক্ষোভকারী নিহত

১ ডিসেম্বর দেশে জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে হরতালে ব্যাপক সহিংসতা ঘটে। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের বহু লোক হতাহত হন। একমাত্র মিরপুরেই বিডিআরের গুলীতে ছাত্র, গার্মেন্টস শ্রমিক ও ইটভাঙ্গা শ্রমিকসহ নিহত হয় ৮ জন । আর চট্টগ্রামে কালুরঘাট এলাকায় শ্রমিকদের মিছিলে সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হয় ১ জন। খুলনায় এরশাদের কুশপুত্তলিকা বহনের সময় নিহত হয় রিকশাচালক মহারাজ (২০)। সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত হয় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সমাবেশ। সামরিক স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশে এদিন উত্তাল ছিলো রাজধানী ঢাকা। গণআন্দোলন প্রতিহত করতে এদিন চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে স্থাপন করা হয় সেনাক্যাম্প। খুলনায় সকাল ১১টায় বুলেটবিদ্ধ বিদ্ধ হয় ৩ বিক্ষোভকারী। দৌলতপুর-খালিশপুরে ব্যারিকেড গড়ে তোলে জনতা । পুলিশি হামলায় আহত হয় দেড় শতাধিক। গ্রেফতার করা হয় প্রায় একশজনকে।

০২.১২.৯০

এরশাদের পতনের প্রতিধ্বনি

দেশবাসীর বিক্ষোভের আগুনে ৯০ সালের এই দিনে (২ ডিসেম্বর) সর্বত্রই এরশাদের পতনের আওয়াজ প্রতিধ্বতি হয়। আর এরই ধারাধাবাহিকতায় পরদিন (৩ ডিসেম্বর) এরশাদ শর্তসাপেক্ষে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। এরশাদের এই ছলচাতুরির প্রেক্ষিতে গণআন্দোলন আরো তীব্র আকার ধারণ করে । অন্যদিকে ৩ জোট ৪ ডিসেম্বর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য হরতালে ডাক দেয়। নি:শর্ত পদত্যাগের ঘোষণার দু’দিন আগে অর্থাৎ ১৯৯০ এই দিনে (২ ডিসেম্বর) বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিক্ষোভ সমাবেশে সারা দেশ ছিল উত্তাল। ঢাকার বিজয়নগর, পুরানা পল্টন, মতিঝিল, গুলিস্তান, তোপখানা রোড, কাকরাইল পদযাত্রায় ছিল লাখ লাখ মানুষ। সবাই এরশাদের পদত্যাগের দাবিতে শ্লোগান দেয়। একই সঙ্গে জনতা এরশাদের বিচারের দাবি জানায়।

শিল্পীরা বিভিন্ন সমাবেশে নাটক থেকে পাঠ, সংগীতানুষ্ঠান আর আবৃত্তিতে অংশ নেন। অজস্র লোক রাস্তা বন্ধ করে এসব প্রতিবাদী অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। এসব অনুষ্ঠানের উপজীব্য ছিল অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আর গণঅভ্যুত্থানকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে দিয়ে এগিয়ে নেওয়া। রাস্তায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, ছাত্র ঐক্য আর অন্যান্য সংগঠনের অনেকগুলো পথসভা হয়। প্রেসক্লাবের সামনে, দৈনিক বাংলা মোড়ে, গুলিস্থানের সামনে, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ আর গোলাপশাহ মাজারের কাছে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ সমাবেশ করে। অন্যদিকে চট্টগ্রামের চন্দনাইশে জনতা উপজেলা অফিস ভাংচুর করে এবং ৪ দিনের মধ্যে উপজেলা চেয়ারম্যানদের পদত্যাগের প্রতিশ্রুতি আদায় করে। সকালে সদরঘাটে ছাত্রজনতার মিছিলের উপর নিরাপত্তা বাহিনী গুলি চালায়, এতে অন্তত ৫ জন আহত হয়। ১ ডিসেম্বর মিরপুরের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সেখানে হরতাল পালিত হয় এবং গায়েবানা জানাজা শেষে ৫ জনের দাফন সম্পন্ন হয় ।

০৩.১২.৯০

বিক্ষুব্ধ নগরী ভয়াল গর্জন

জনতার বিক্ষোভের উত্তাপ সইতে না পেরে ১৯৯০ সালের এদিন (৩ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় সামরিক স্বৈরাচারী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচনের ১৫ দিন আগে পদত্যাগ করার প্রস্তাব দেন। এরশাদের এ প্রস্তাবে দেশের রাজনীতি নাটকীয় মোড় নেয় । ২৭ নভেম্বর (১৯৯০) জরুরি অবস্থা জারির ৭ দিন পর সামরিক স্বৈরাচারী এরশাদের এ প্রস্তাব তাঁর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অবস্থানের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সূচিত করে। এ সত্তেও তিনজোটের অন্যতম প্রধান শরিকরা এরশাদের এ প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেন। একই সঙ্গে তারা তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী এরশাদকে অবিলম্বে পদত্যাগ করার কথা বলেন।

এদিন এরশাদের পদত্যাগের দাবীতে উত্তাল ছিলো গোটা দেশ। শহর, নগর, গঞ্জ, গ্রাম সর্বত্রই মানুষ এরশাদের পদত্যাগের দাবিতে ফেটে পড়ে। সকালে মতিঝিলের সেনাকল্যান সংস্থার ভবনে বোমা নিক্ষেপ করে বিক্ষুব্ধ জনতা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভকারীদের মিছিলে গুলি চালায় নিরাপত্তা বাহিনী। এতে বেশ কয়েকজন আহত হয়। এদিন বিক্ষুব্ধ জনতা মন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীর বাড়িতে হামলা চালায় এবং ফায়ার সার্ভিসের কার্যালে আগুন লাগিয়ে দেয়।

০৪.১২.৯০

গভীর রাতে এরশাদের পদত্যাগ। দেশব্যাপী বিজয় উল্লাস

নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের শেষ দিন ৪ ডিসেম্বর তারিখে জনতার বিক্ষোভ সমাবেশে সারা দেশ ছিলো উত্তাল। দেশের মানুষের গন্তব্য ছিলো রাজপথ। ছাত্র জনতা এদিন হয়ে ওঠে দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। সামরিক স্বৈরাচারী এরশাদ অস্তিত্ব এদিন ছিলো বাহুল্যমাত্র। রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তায় এদিন ট্রাকে পুলিশের দল ছিলো বটে। তবে তারাও উৎফুল্ল জনতার সঙ্গে মেতেছিল রসিকতায়। রমনা পার্কে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সেনা সদস্য থাকলেও সারাদিন রাস্তায় কোনো সেনা সদস্যের দেখা মেলেনি। ঢাকার বিজয় নগর, পুরানা পল্টন, মতিঝিল, গুলিস্তান, তোপখানা রোড ও কাকরাইলে ছিল লাখ লাখ মানুষের মিছিল। বিক্ষুব্ধ জনতার মুখে ছিল এরশাদের পদত্যাগ এবং বিচার দাবির শ্লোগান। এদিন বাংলাদেশ সচিবালয়সহ সকল সরকারী, আধা সরকারী স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মচারী কর্মকর্তারাও গণঅভ্যুত্থানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেন।

বেশ নাটকীয়ভাবে বিটিভি’র রাত ১০টার ইংরেজি সংবাদের মাঝে সম্প্রচার করা হয় এরশাদের পদত্যাগ এবং তিন জোটের মনোনীত তত্ত্ববধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘোষণা। এ ঘোষণার পরই গভীর রাতে সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন শহর ও নগরে হাজার হাজার মানুষ কারফিউ উপেক্ষা করে রাস্তায় রাস্তায় বিজয় উৎসবে মেতে ওঠে।

০৫.১২.৯০

দেশব্যাপী বিজয় উৎসব পালন

৪ ডিসেম্বর রাতে সামরিক স্বৈরাচারী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পদত্যাগের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর থেকে কারফিউ এবং জরুরি অবস্থার বিধি নিষেধ অমান্য করে জনতা রাস্তায় রাস্তায় বিজয় মিছিল, উল্লাস আর নৃত্য শুরু করে। আর এদিন (৫ ডিসেম্বর) ঢাকাসহ সারা দেশের সর্বত্রই চলে উল্লাস আর বিজয় উদযাপন। স্বৈরাচারের পতনের আনন্দ আর আন্দোলনে নিহতদের বেদনার স্মৃতি এদিন ভোর থেকেই সারা দেশে এক অভিনব ও বিচিত্র শব্দচিত্রের জন্ম দেয়। অগণিত মানুষের মিছিলে মুখরিত হয়ে ওঠে রাজধানী ঢাকা। ছাত্রদের মিছিল, শ্রমিকদের মিছিল, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, ৫ দলীয় ঐক্যজোট, ঐক্য প্রক্রিয়া, কমিউনিস্ট পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি সবই অজস্র মিছিল বের করে। তারা স্বৈরাচার বিরোধী শ্লোগান দেয় এবং হেলে দুলে নেচে গেয়ে আনন্দ প্রকাশ করে। মিছিলকারীরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি বহন করে। অধিকাংশ মিছিলেই দলীয় পতাকার পরিবর্তে ছিল জাতীয় পতাকা।

সংস্কৃতিকর্মীরা পরিবেশন করেন কবিতা আবৃত্তি, সংগীত আর নাটক। পুরোনো পল্টনের মোড়ে অন্তত ১৫ হাজার লোক রাস্তায় বসে সব অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। শামসুর রাহমান স্বরিচত কবিতা পাঠক করেন এরশাদ বিরোধী সংগ্রামে নিহতদের স্মৃতিতে। রাজনৈতিক দলগুলোর অনুরোধে এদিন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ উপরাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণে সম্মত হন।

০৬.১২.৯০

এরশাদের বিদায়, শাহাবুদ্দিন আহমদের দায়িত্ব গ্রহণ

১৯৯০ সালের এই দিনে (৬ ডিসেম্বর) সামরিক স্বৈরাচারি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করেন এবং বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের এই দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে ৯০-এর ঐতিহাসিক গণআন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে। ফলে ২৭ নভেম্বর এরশাদের জারুরি আইন জারির প্রতিবাদের সাংবাদিকদের ধর্মঘটে ১০ দিন বন্ধ থাকার পর সারাদেশে এদিন থেকে সংবাদপত্র পুনঃপ্রকাশিত হয়।