১৬৯০ সালের দিকে কলকাতা শহরের গোড়াপত্তন করেন জব চার্নক নামে একজন নিম্মপদস্থ ব্যবসায়ী। ১৬৯৮ সালে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তৎকালীন জমিদার সাবর্ণ চৌধুরীর কাছ থেকে কিনে নেয় হুগলি নদীর তীরের তিন তিনটি গ্রাম; সুতানুটি, গোবিন্দপুর আর কলকাতা। কলকাতাকে তখন গ্রাম বলেই চিহ্নিত করা হত ! এরপর থেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতাকে আধুনিক শহর হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করলো। তাদের মূল লক্ষ্য ছিলো, কলকাতাকে প্রেসিডেন্সি শহর হিসেবে গড়ে তোলা। এর পাশাপাশি প্রয়োজনের তাগিদে গড়ে উঠতে থাকলো একের পর রাস্তা। রাস্তাগুলোর নামও বেশ অদ্ভুত ! কলকাতার এসব বিখ্যাত রাস্তার নামকরণের ইতিহাস নিয়েই ছারপোকা ম্যাগাজিন এর বিশেষ এই প্রতিবেদন। পড়ুন বিস্তারিত…
কলকাতার বিখ্যাত রাস্তাগুলোর নামকরণের ইতিহাস
বাগবাজার : কলকাতায় বাগবাজার স্থানটি অনেক পুরনো। কিন্তু এ স্থানের নামকরণের উৎস খুঁজতে গেলে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়। কেউ কেউ মনে করেন, ফার্সি শব্দ ‘বাগ’ অর্থাৎ বাগান এবং আরবি শব্দ ‘বাজার’ অর্থাৎ জিনিসপত্র বিক্রির জায়গা মিলেমিশে ‘বাগবাজার’ নামটি এসেছে। সেই তত্ত্ব অনুসারে ধরে নিতে হয়, ওই অঞ্চলে একটি বাগান ছিল এবং ছিল একটি বাজারও। প্রথমে খোঁজ করা যাক বাগানের।
কলকাতার পুরনো ইতিহাস থেকে দেখা যাচ্ছে, এখন যেখানে বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসব-এর পুজো হয় সেই জায়গায় ছিল এক বিশাল বাগান। বাগানের মালিক ক্যাপ্টেন পেরিনের নামানুসারে লোকে বলত ‘পেরিন সাহেবের বাগান’। খুব সাজানো সেই বাগান বিস্তৃত ছিল হুগলি নদী পর্যন্ত। নদীপথে সাহেব-মেমরা মাঝে মাঝে ওই বাগানে ফুর্তি করতে আসতেন। কিন্তু ‘চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়।’ পেরিন সাহেবের সুদিনও ফুরিয়ে গেল এক দিন। ঋণের দায় ওই বাগান নীলামে উঠল। ১৭৫২-এ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নীলামে বাগানটি ২৫০০ টাকায় কিনে নেন জন জেফানিয়া হলওয়েল। কিন্তু মাত্র তিন বছরের মধ্যে তিনি আবার বিক্রি করে দেন প্রথম ফোর্ট উইলিয়ম কেল্লার অধ্যক্ষ ক্যারোলাইন ফ্রেডরিখ স্কটকে। স্কট সাহেব সেখানে বারুদ বা গান পাউডার তৈরির কারখানা খুললেন। অল্পদিন পরে তিনি মারা গেলে ওই কারখানা-সহ বাগানের মালিকানা বর্তালো কোম্পানির উপরেই। কিছু কাল পরে বারুদ কারখানাটিও উঠে গেল।
চার্নক-পূর্ব যুগে তো বটেই তার পরেও দীর্ঘ কাল পুরো সুতানুটি অঞ্চলটাই ছিল বাজার এলাকা। শোভাবাজার, হাটখোলা অঞ্চলগুলির প্রসিদ্ধিই ছিল হাট-বাজারের জায়গা হিসেবে।
আপজন এর ম্যাপে (১৭৯৪) ওল্ড পাউডার মিল বাজার নামে একটি বাজারের উল্লেখ রয়েছে। পেরিনের বাগ (বাগান) আর পাশের বাজার মিলেই ‘বাগবাজার’ নামের উৎপত্তি বলে অনেকে মনে করেন। কেউ কেউ আবার বলেন (তথ্যসূত্র: সুকুমার সেন ) ওই অঞ্চলে হুগলি নদীর একটি বাঁক আছে। বাঁকের তীরে বসা বাজার থেকেও বাগবাজার নামের উৎপত্তি হয়ে থাকতে পারে।
শ্যামবাজার : বর্তমান শ্যামবাজার অঞ্চলে অতীতে একটি বিখ্যাত বাজার ছিল। জন জেফানিয়া হলওয়েল এই বাজারটিকে চার্লস বাজার নামে অভিহিত করেন। শেঠ ও বসাক পরিবারগুলি ছিল সুতানুটির আদি বাসিন্দা এবং শোভারাম বসাক ছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর কলকাতার এক বিশিষ্ট বাঙালি ধনী ব্যবসায়ী। শোভারাম বসাক তাঁর গৃহদেবতা শ্যামরায়ের (কৃষ্ণ) নামানুসারে এই অঞ্চলের বর্তমান নামকরণটি করেন।
গ্রে স্ট্রিট : কলকাতার প্রথম পাকা রাস্তা সাকুর্লার রোড। উত্তর কলকাতার এই লোয়ার সাকুর্লার রোড বা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডের উপরই আর একটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা গ্রে স্ট্রিট। গ্রে স্ট্রিট আদতে ইংল্যান্ডের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী চালর্স আর্ল গ্রে-র নামানুসারে তৈরি রাস্তা।
কলকাতার আদি ইতিহাসের পাশাপাশি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে এই রাস্তার নাম। আলিপুর বোমা মামলায়
১৯০৮ সালের ৮ মে ঋষি অরবিন্দ যে বাড়ি থেকে গ্রেফতার হন সে বাড়ি আজও রয়েছে এই গ্রে স্ট্রিটে। পরবর্তীকালে এই গ্রে স্ট্রিটের নাম হয়ে যায় অরবিন্দ সরণি।
হরি ঘোষ স্ট্রিট : গ্রে-স্ট্রিটের একটি বিখ্যাত রাস্তা ( বাই-লেন ) হল হরি ঘোষ স্ট্রিট। শ্রী হরিহর শেঠের নামাঙ্কিত এই রাস্তাটি খুবই পুরোনো। রাধারমণ মিত্র (কলিকাতা দর্পণ, প্রথম পর্ব, সুবর্ণরেখা, চতুর্থ মুদ্রণ ১৯৯৭, পৃ: ৭৫-৭৬) জানাচ্ছেন শ্রী হরি ঘোষ পেশাগত ভাবে ছিলেন মুঙ্গের দূর্গের দেওয়ান। এই দূর্গটি ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলে। শ্রীহরি ঘোষ বাংলা ছাড়াও ফার্সী ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন৷ ইস্ট-ইণ্ডিয়া কোম্পানীর হয়ে মুঙ্গের দুর্গের দেওয়ান হিসেবে কাজ করে তিনি বহু অর্থও উপার্জন করেন৷ অবসর নিয়ে কলকাতায় আসার পর তাঁর পৈত্রিক ভিটে শ্যামপুকুরের বাড়িতে না থেকে আলাদা করে বাড়ি তৈরি করেছিলেন। শ্রীহরি অসহায় মানুষদের নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিতেন। তাঁর বাড়ি সবসময় লোকজনের কোলাহলে মুখরিত থাকত। এই কোলাহলের জন্য আশেপাশের বাড়ি থেকে শ্রীহরি ঘোষের বাড়িকে উদ্দেশ্য করে বলা হত ‘হরি ঘোষের গোয়াল’।
এনার আরও একটি পরিচয় হলো – ইনি চিৎপুরের চিত্তেশ্বরী মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী মনোহর ঘোষের প্রপৌত্র।
হাতিবাগান : গ্রে স্ট্রিটে রয়েছে প্রসিদ্ধ হাতিবাগান বাজার ও সুপ্রাচীন হাতিবাগান টোল। ১৭৫৬ সালে সিরাজদ্দৌলা কলকাতা আক্রমণ করেন। এই সময়ই নবাবের হাতিদেরকে রাখা হয়েছিল এই অঞ্চলেরই এক বাগানে ইতিহাসের সেই নাম নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে হাতিবাগান।
চিৎপুর : এখনকার কাশীপুর এলাকার গঙ্গার তীরের চিৎপুর অঞ্চলে অবস্থিত ‘আদি চিত্তেশ্বরী’ দুর্গামন্দির। কলকাতার বহু প্রাচীন রাস্তা গুলির মধ্যে চিৎপুর রোড উল্লেখযোগ্য। তখনও শহর ঠিক মতো গড়ে ওঠেনি, এখন যেখানে স্ট্যান্ড রোড, সেখান দিয়েই বইত হুগলি নদী। জঙ্গলাকীর্ণ ওই অঞ্চলে ছিল চিতু ডাকাতের আধিপত্য। কথিত আছে , ভাগীরথী-হুগলী নদীতে ভেসে আসা এক প্রকান্ড নিম গাছের গুঁড়ি দিয়ে চিতে ডাকাত এই জয়চন্ডী চিত্তেশ্বরী দুর্গা মুর্তি তৈরী করেন।
পরবর্তীকালে মনোহর ঘোষ নামে এক ব্যক্তি চিত্তেশ্বরী দুর্গার মন্দির তৈরি করে দেন। এই চিত্তেশ্বরী দুর্গার নামানুসারেই এঅঞ্চলের নাম চিৎপুর।
সোনাগাছি : রাতের রজনীগন্ধা আর সদ্যভাজা চপকাটলেটের সুবাসে ভরা রাতপরীদের এলাকা অর্থাৎ কলকাতার কুখ্যাত নিষিদ্ধপল্লী সোনাগাছির নাম হয় সোনাউল্লাহ গাজী নামক এক পীরবাবার নামানুসারে।
ওই অঞ্চলে তার মাজার ছিল বলে শোনা যায়। এই সোনা গাজীর মাজার নামের ব্যপারেও মতভেদ আছে। ঐ জায়গা মূলতঃ রাত্রিগমনের জন্য বেশী প্রসিদ্ধ, এর কাছাকাছি সমব্যবসায়ী স্ত্রীলোকদের অপর একটি পাড়া ছিলো বিডন স্ট্রীটের কাছে, যেখানে তুলনায় কম আয়ের মানুষ ও নিম্নবর্গীয়রা গমণ করতেন। দুই জায়গার নাম ছিলো যথাক্রমে সোনাগাছি আর রূপোগাছি – গমনকারী খদ্দেরদের আর্থিক বৈষম্যের প্রতি নির্দেশ করে।
গরানহাটা : গরান কাঠ নৌকা বোঝাই হয়ে এসে যেখানে বিক্রী ও গুদামজাত করা হত ওই জায়গা বর্তমানে গরানহাটা।
টেরিটি বাজার বা চায়নাটাউন : রবিঠাকুরের একটি কবিতায় বর্ণিত এই টেরিটি বাজারের আগের নাম ছিল আমড়াতলা। ১৭৮২-৮৩ সালে এডওয়ার্ড টিরেটা এই এলাকায় একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর নামানুসারে ওই এলাকার নাম হয়েযায় টেরিটি বাজার। চীনের লোকেরা এখানে বসতি গড়েছিলেন এবং এখনো এ এলাকার অধিকাংশ বাসিন্দারাই চীনের।
কুমোরটুলি : শোভাবাজার রাজবাড়িতে দূর্গাপূজার প্রচলন হলে একেবারে প্রথমদিকে একদল কুমোর কে কৃষ্ণনগর থেকে আনা হত মূর্তি গড়ার জন্য। তাদের রাজবাড়ির সন্নিকটে যে জায়গায় থাকার বন্দোবস্ত করা হয় সেই জায়গা বর্তমানে কুমোরটুলি নামে পরিচিত।
বনমালী সরকার স্ট্রিট : সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্রের কালজয়ী সৃষ্টি ঘনাদাকে মনে আছে নিশ্চই? ঘনাদা থাকতেন বনমালী সরকার স্ট্রিটের মেস বাড়িতে। যার নামে এই রাস্তা , সেই বনমালী সরকার পাটনার প্রথম দেওয়ান ছিলেন এবং পরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ‘ডেপুটি ট্রেডার’ পদে আসীন হন। ১৭৪০ থেকে ১৭৫০-এর মধ্যে কলকাতার কুমারটুলি এলাকায় তিনি একটি বিশাল বাসস্থান নির্মাণ করান।
ঠনঠনিয়া : কথিত আছে , সেই এলাকায় কয়েকটি বাড়িতে লোহার কাজ হত। দিন-রাত সেখান থেকে ‘ঠন-ঠন’ শব্দ আসত। সেই লোহা পেটানোর শব্দের থেকেই নাম ঠনঠনিয়া। আবার অনেকে বলেন , বহু পূর্বে ওই এলাকায় ডাকাতের উৎপাত ছিলো। ডাকাত আক্রমণের সম্ভাবনা দেখাদিলে , পল্লীবাসীবৃন্দকে সজাগ করতে ঠন ঠন করে মন্দিরের ঘন্টা বাজানো হতো , সেই থেকেই নাম ঠনঠনিয়া। আবার সুকুমার সেন তাঁর বইতে লিখেছেন এই অঞ্চলের জমি এমনই বন্ধ্যা ছিল যে কোদাল সাবোল দিয়ে মাটি খুঁড়তে গেলে ঠন ঠন করে আওয়াজ হতো। এর থেকেই নাম ঠনঠনিয়া।
বৈঠকখানা রোডের নামকরণ
১৭৮৪ সালের লেফট্যানেন্ট কর্নেল মার্ক উডের মানচিত্রে লালবাজার থেকে পূর্বদিকে তৎকালীন মারাঠা খাত (পরে সার্কুলার রোড এবং বর্তমানে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড) পর্যন্ত এলাকার নাম ছিল “বয়টাকোন্না স্ট্রিট” (Boytaconnah Street)। নামটির উৎপত্তি “বৈঠকখানা” নামটি থেকে। সেকালে এই অঞ্চলের একটি প্রাচীন বটগাছের নিচে ব্যবসায়ীরা তাদের মালপত্র নিয়ে বিশ্রাম করতে বসতেন। শোনা যায়, জব চার্নক যখন কলকাতাকে বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে নির্বাচিত করেন, তখন তিনিও এখানে আসতেন। সেই থেকেই জায়গাটির নাম হয় বৈঠকখানা। উডের মানচিত্রে বৈঠকখানা বটগাছটির উল্লেখও আছে। এর পূর্বদিকের এলাকাটি ছিল জলাভূমি। ১৭৯৪ সালে অ্যারোন আপজনের মানচিত্রেও বৈঠকখানার উল্লেখ আছে। তবে উক্ত মানচিত্রে যে স্থানটি দেখানো হয়েছে সেটি বর্তমান শিয়ালদহ স্টেশনের জায়গাটি। উডের মানচিত্রে কোনো বৈঠকখানা গাছের উল্লেখ না থেকলেও আপজনের মানচিত্রে আছে। বউবাজার বা অধুনা বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট থেকে মহাত্মা গান্ধী রোড পর্যন্ত এলাকার নাম এখনও বৈঠকখানা রোড। এই রাস্তার দক্ষিণ প্রান্তের বাজারটির নামও বৈঠকখানা বাজার।
বউবাজারের নামকরণ : পূর্বতন ডালহৌসী স্কোয়ার (অধুনা বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ) থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত এই রাস্তাটি প্রসারিত ছিল। পরে এই রাস্তার নাম হয় বউবাজার স্ট্রিট। ‘বউবাজার’ শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে দুটি মত রয়েছে। একটি মত অনুসারে, মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী বিশ্বনাথ মতিলাল তাঁর বাঙালি পুত্রবধূকে একটি বাজার লিখে দেন, সেই বাজারটিই ‘বহুবাজার’ (হিন্দিতে ‘বহু’ শব্দের অর্থ ‘পুত্রবধূ’) এবং পরে তা বিকৃত হয়ে ‘বউবাজার’ নাম নেয়। তবে ঐতিহাসিকেরা এই ব্যবসায়ীর পরিচয় নির্ধারণে অসমর্থ হয়েছেন। তাই দ্বিতীয় মতে, এই অঞ্চলে বহু বাজার ছিল এবং সেই সব বাজারে বহু জিনিসপত্র বিক্রি হত। সেই থেকেই এই বাজারটি প্রথমে ‘বহুবাজার’ ও পরে তা বিকৃত হয়ে ‘বউবাজার’ নাম নেয়। প্রথম মত অনুসারে, উক্ত বাজারটি ছিল ৮৪ এ এলাকায় অধুনা নির্মলচন্দ্র স্ট্রিটের মোড়ে। দ্বিতীয় মতে যে বাজারগুলির কথা বলা হয়েছে সেগুলির অবস্থান ছিল ১৫৫-৫৮ এলাকায়।
পরে বউবাজার স্ট্রিটের নামকরণ করা হয় বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট (স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপিনবিহারী গাঙ্গুলির (১৮৮৭-১৯৫৪) নামানুসারে। ইনি ২৪ বছর ব্রিটিশ জেলে অতিবাহিত করেন। পরে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন)। যদিও এলাকার নামটি বউবাজারই থেকে যায়। বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট থেকে মহাত্মা গান্ধী রোড পর্যন্ত এলাকার নাম এখনও বৈঠকখানা রোড।
হাড় কাটা গলি : বউবাজারের সোনার দোকানে জড়োয়ার গয়না বানানোর জন্য হীরে কাটাই এর কাজ হতো যে অঞ্চলে সেই এলাকা লোকমুখে হীরাকাটা গলি এবং কালে কালে অপভ্রংশ হয়ে হাড় কাটা গলি নামে পরিচিত হয়েছে।
আবার স্বামী বিবেকানন্দের ভাই মহেন্দ্র নাথ দত্ত তাঁর লেখা ‘কলিকাতার কথা ও কাহিনী ‘ বইতে লিখেছেন এই অঞ্চলে এক ধরণের কারিগর বসবাস করতেন যারা পশুর হাড় থেকে শৌখিন জামার বোতাম , চিরুনি প্রভৃতি তৈরী করতে পারদর্শী ছিলেন। তার থেকেই নাম ‘হাড় কাটা গলি ‘।
বো ব্যারাক : অমৃতলাল বসুর আত্মস্মৃতিতে বিবরণ পাওয়া যায় বউবাজার অঞ্চলে বর্তমান লালবাজারের উল্টোদিকে বা পাশে সেনা ছাউনি ছিল। সেই সেনা ছাউনির জন্যই নাম Bow barracks।
উল্টোডাঙ্গা : এখানে খালের পাশে নৌকা বা ডিঙি উল্টো করে আলকাতরা লাগানো হত। তার থেকে উল্টোডিঙি অপভ্রংশ উল্টোডাঙ্গা ।
ওই দিকটা কলকাতার পূর্ব দিক। খাল দিয়ে ভাগ হয়েছে। এই খাল খুব সম্ভব বিদ্যাধরী। এখন খাল মজে হেজে গেছে। ডিঙি উল্টে রাখা একটা রেওয়াজ ছিল যাতে এপার ওপার করতে পারে লোকজন। এখানে অনেকদিন পর্যন্ত বড়ো নৌকা চলাচল করতে দেখা যেত। তখন ওটা বালুমাঠ। তবে বাঁশ বা কাঠের ব্যবসার অন্য এক ইতিহাস এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। কিন্তু তা ধরে নামের ইতিহাস জানা যায় না।
লালদীঘি : জব চার্নকের আগমনের পূর্বেই ডিহি কলিকাতা গ্রামে লালদিঘির অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। লালদিঘির নিকটেই সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের একটি কাছারি ও গৃহদেবতা শ্যামরায়ের মন্দিরটি অবস্থিত ছিল। অনুমান করা হয়, দোলযাত্রা উপলক্ষে রং খেলার পর এই দিঘির জল লাল হয়ে উঠত বলে দিঘিটি লালদিঘি নামে পরিচিত হয়। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উক্ত কাছারিবাড়িটি প্রথমে ভাড়া ও পরে ক্রয় করে নিয়েছিলেন।
অবশ্য লালদিঘির নামকরণ নিয়ে অন্য কাহিনিও প্রচলিত আছে। কেউ কেউ বলেন, পার্শ্ববর্তী ওল্ড মিশন চার্চের লাল রংটি এই দিঘির জলে প্রতিবিম্বিত হত বলে দিঘিটি লালদিঘি নামে পরিচিত হয়।
অন্যমতে, জনৈক লালচাঁদ বসাক এই দিঘিটি খনন করিয়েছিলেন। তাঁর নামানুসারেই দিঘিটির নাম হয় লালদিঘি। নব্যভারত-এ প্রাণকৃষ্ণ দত্ত এই দিঘির অন্য একটি ইতিহাসের বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর মতে, গোবিন্দপুরের মুকুন্দরাম শেঠ বা তাঁর পুত্রেরা এই দিঘি খনন করিয়ে থাকবেন। এই দিঘির ধারে তাঁর কাছারি অবস্থিত ছিল। দোলের দিন রংখেলার পর দিঘির জল লাল হয়ে যেত বলে দিঘির নামকরণ হয় লালদিঘি।
চৌরঙ্গী : সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ায় আজকের ময়দান ও এসপ্ল্যানেড ছিল ব্যাঘ্র-সংকুল জঙ্গল। এখানে সে সময় ছিল তিনটি ছোটো ছোটো গ্রাম – চৌরঙ্গী, বিরজি ও কোলিম্বা। শোনা যায়, ‘চৌরঙ্গী নাথ’ নামে নাথ সম্প্রদায়ের এক সন্ন্যাসীর বাস ছিল ওই অঞ্চলে। তাঁর নাম থেকেই নাকি অঞ্চলের নাম হয় ‘চৌরঙ্গী’।
মলঙ্গা লেন : এই অঞ্চলে নুন তৈরি হত অ নুনের গোলা ছিল। নুনের কারবারিদের “মালঙ্গী” বলা হত। সেই থেকে এই অঞ্চলের নাম মলঙ্গা।
শাঁখারিটোলা : শঙ্খ থেকে শাঁখা বানানর কারিগররা বাস করতেন বলে শাঁখারিটোলা ।
পার্শীবাগান : রুস্তমজী কাওয়াসজীর বাগান বাড়ি ছিল বলে আজ ওই অঞ্চলের নাম পার্শীবাগান।
সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার : আগে নাম ছিল “নেবুতলার মাঠ”। তারও আগে নামছিল “সেন্ট জেমস স্কোয়ার”। একদম পূর্বে নাম ছিল হুজুরিমল ট্যাঙ্ক। পাঞ্জাবি ব্যবসায়ী ৫৫ বিঘার অপর পুকুর খনন করেন। লোকে বলতেন হুজুরিমল ট্যাঙ্ক বা পাদ্মপুকুর। পরে পুকুর ভরাট করে হয় মুচিপাড়া থানা আর কেরানিবাগান। পরে এই কেরানিবাগানের নামহয় নেবুতলা বা লেবুতলার মাঠ। আজ তা শহীদ সন্তোষ মিত্রর নামে সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার । হুজুরিমলের পুকুর বুজিয়ে তৈরী হয় বাগান। এই বাগানে কম্পানীর পর্তুগীজ কেরানিরা বাস করতেন। সেই থেকে এর নাম হয় কেরানিবাগান।
ন্যাড়া গীর্জা : সেন্ট জেমস স্কোয়ার বা ন্যাড়া গির্জার মাঠ – ১৮১৪ সালে কলকাতার প্রথম বিশপ টমাস ফ্যানশ মিডল্টন থিক আজ যেখানে রাজরাজেশ্বরী স্কুল অ শশিভূষণ দে স্কুল সেইখানে ছিল সেন্ট জেমস গির্জা। চুড়াটি নির্মাণ করা সম্ভব হয় নি (মতান্তরে বাজ পড়ে ভেঙ্গে জায়)তাই লকে এটিকে ন্যাড়া গির্জা অ পার্শ্ববর্তী মাঠকে ন্যাড়া গির্জার মাঠ বলতেন। পরে গির্জাটি লোয়ার সার্কুলার রোডে স্থানান্তরিত করা হয়।
সেন্ট জেমস গীর্জা ছিল পূর্বতন সেন্ট জেমস স্কোয়ার এ। গীর্জা টির চূড়া ভাঙা ছিল । তাই লোকমুখে ন্যাড়া গীর্জা । বয়স্ক মানুষের মুখে মুখে এই নামই চলত। এ পাড়ার বৃদ্ধ মানুষ জন আজও ন্যাড়া গির্জার বাজার ই বলেন লেবুতলার বাজার কে।
লেবুতলা : জনৈক্য ভুবন পাল ওখানে একটি বাজার বসান যা ভুবনপালের বাজার বা ন্যাড়া গির্জার বাজার বা নেবুতলার বাজার নামে পরিচিত। অসংখ্য লেবুগাছ থাকায় এই কেরানিবাগানের নাম হয় লেবুতলা বা নেবুতলা।
এন্টালি বা ইন্টালী : পূর্ব নাম ‘ডিহি ইটালি”। হেঁতাল গাছের বন থাকায় হেন্তালি সেখান থেকে ইটালি,ইন্টালী ও এন্টালি। মতান্তরে , ওই এলাকায় ইট ও টালির ব্যবসা থাকায় নাম হয় ইটালি।
টালিগঞ্জ : মেজর উইলিয়াম টলি নামে সাহেব ১৭৭৫-৭৬ সালে কলকাতার সঙ্গে অসম ও পূর্ববঙ্গের যোগসূত্র হিসাবে একটি নালা খনন ও ড্রেজ করার কাজ শুরু করেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি টলি সাহেবকে এই নালা দিয়ে যাতায়াতকারী নৌকাগুলি থেকে টোল আদায় ও নালার ধারে একটি গঞ্জ বা বাজার স্থাপনের অনুমতি দিয়েছিল। ১৭৭৬ সালে এই প্রকল্পটি সম্পন্ন হয় এবং পরের বছরেই এটি সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এই টালির নালাটি টলি সাহেবের নামেই টালির নালা (ইংরেজিতে টলি’জ ক্যানেল) হিসেবে পরিচিতি পায়। সাহেবের প্রতিষ্ঠিত বাজারটি টালিগঞ্জ নামে পরিচিত হয়। নালার পূর্ব পাড়ে বর্তমান টালিগঞ্জ রোডের কাছেই কোথাও এই বাজারটি অবস্থিত ছিল। পরবর্তীকালে টালির নালার দুধারে একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চল টালিগঞ্জ নামে অভিহিত হয়ে থাকে।
বালিগঞ্জ : 1758 সালে ইংরেজরা মীরজাফর এর কাছ থেকে ডিহি পঞ্চান্ন গ্রাম কিনেছিল। বালিগঞ্জ তার মধ্যে ছিল। এখানে বালি বিক্রির বাজার ছিল বলে আনুমানিক 1800 সাল থেকে এই অঞ্চল বালিগঞ্জ নামেই পরিচিত। এই পঞ্চান্ন গ্রাম এর এক অংশ এখনো পঞ্চান্ন গ্রাম নামেই আছে।
পোস্তা : পোস্তা অঞ্চলের নামকরণ করা হয় হুগলি নদীর পোস্তা ঘাটের নামানুসারে। সেকালে এই অঞ্চলটি বাঙালি ব্যবসায়ী ও ব্যাংকারদের বসতি অঞ্চল ছিল। এঁদের ঐশ্বর্য ও সম্পদ ছিল বাংলার ইতিহাসে কিংবদন্তি। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন লক্ষ্মীকান্ত ধর ওরফে নুকু ধর। তিনি হুগলি জনপদের পতনের পর সেখান থেকে সুতানুটিতে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। কথিত আছে, তিনি ইংরেজ শাসকদের মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য নয় লক্ষ টাকা ধার দিয়েছিলেন। তিনি রবার্ট ক্লাইভকে নিয়মিত টাকা ধার দিতেন। জানা যায়, নবকৃষ্ণ দেব তাঁর কাছে চাকুরিপ্রার্থী হয়ে এলে, তিনিই নবকৃষ্ণ দেবের সঙ্গে ইংরেজদের পরিচয় করিয়ে দেন এবং তারা তাঁকে চাকুরি দেন।
নুকু ধরের দৌহিত্র সুখময় রায় তাঁর দাদামশায়ের সম্পত্তির অধিকারী হয়েছিলেন। কারণ, তাঁর মা ছিলেন নুকু ধরের একমাত্র সন্তান এবং তিনি ছিলেন তাঁর দাদামশায়ের একমাত্র দৌহিত্র। ইংরেজরা নুকু ধরকে ‘রাজা’ উপাধি দিতে গেলে, নুকু ধর তাঁর দৌহিত্রকে সেই উপাধি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। সেই অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সুখময় রায় রাজা উপাধি পান এবং পোস্তা রাজবাড়ি স্থাপন করেন। যদিও বর্তমানে শহরের উন্নয়ন ও রাস্তা নির্মাণের জন্য এই রাজবাড়ির কিয়দংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। তিনটি প্রাচীন বাড়ি এখনও এখানে রয়েছে। এগুলি হল: রাজবাড়ি, লালবাড়ি ও ঠাকুরবাড়ি।
বরাহনগর / বরানগর : প্রাচীন জনপদ বরানগরের নাম নিয়ে বেশ কয়েকটা প্রচলিত মতবাদ আছে । জনশ্রুতি অনুসারে , এখানে বরাহমিহিরের মানমন্দির ছিল , তার থেকে বরাহনগর। অনেকে বলেন – বরাহনগর চারিদিকে শূকরের উৎপাত ছিল সেই থেকেই বরাহনগর নাম। হরিসাধন মুখোপাধ্যায় (কলিকাতা সেকালের ও একালের পৃষ্ঠা ২১৭-১৮) স্ট্রেনসাম মাস্টার-এর রোজনামচা উদ্ধৃত করে লিখেছেন যে এই সাহেব যখন ১৬৭৬-৭৭৭ সালে বরাহনগরে আসেন তখন সেখানে ডাচদের একটি মাংস জারণের কারখানা ছিল। এই কারখানা থেকেই জায়গার নাম সম্ভবত বরাহনগর এবং তার থেকেই বরানগর হয়েছে।
আবার চৈতন্যদেব পুরী যাওয়ার পথে এখানে আসেন, যার বর্তমান নাম পাঠবাড়ী আশ্রম । সেই সময়তেই বরাহনগর নামটা পাওয়া যাচ্ছে । সুতরাং , শুকরের মাংসের কারখানা তত্ব বা শুকরের আধিক্য তত্ব বাতিল । অন্য একটি প্ৰচলিত মত অনুসারে, নগরের বাইরে বলে বেরনগর থেকে বরানগর । তবে এই মতবাদ খুব একটা নির্ভরযোগ্য নয় কারণ ১৫০০-১৬০০ সময়ের আশেপাশে ‘ নগর’ বলে কিছুই পাওয়া যায়না ।
দমদম : দমদম নামের উৎস নিয়ে আরও একটা তত্ব আছে। অনেকের মতে ফার্সী (এক জায়গায় দেখলাম আরবি) দমদমা, যার অর্থ উঁচু ঢিবি, তার থেকে দমদম নামটা এসেছে। ক্লাইভ হাউসের পাশে যে উঁচু ঢিবি আছে, সেখানে ASI -এর খননকার্য থেকে গঙ্গাহৃদি সভ্যতার সমসাময়িক নিদর্শন পাওয়া গেছে। O’Malley এর Gazetteer of 24 Parganas বলছে যে, ক্লাইভের আসার আগে থেকেই ক্লাইভ হাউস ছিল। দমদমের অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি তো অনেক পরের ঘটনা। সেই জন্যই সমস্ত পুরোনো বইতে ‘দমদমা’ লেখা আছে দমদম নয়।
কলুটোলা : কলু সম্প্রদায়ের বাস ছিল তাই কলুটোলা।
পোগিয়াপট্টি : কেউ বলেন “পাগড়ীর” ব্যবসা ছিল বলে ওই নাম,আবার কেউ বলেন “পাদুকার” ব্যবসা ছিল বলে ওই নাম।
মোগলবাগান : নারকেলডাঙা রোডের ওপর পড়ে, কোনো একজন মুঘল ভদ্রমহিলা থাকতেন, যিনি নিজেকে আর্মেনিয়ান সেনাপতি “গারগিন খান”-এর আত্মীয়া বলে দাবী করতেন।