শরীর জুড়ে বয়সের ছাপ। চোয়ালে এসে জড়ো হয়েছে চামড়ার বয়স্ক আস্তরণ। মাথার চুল অধিকাংশ কালের খেয়ায় নাম লিখিয়েছে অতীত হিসেবে, সে সাথে দাঁড় করিয়েছে বয়সী আবেশ। হাসিতে তারুণ্যসুলভ আবেদনের বদলে বৃদ্ধাত্ত্ব এক ঋণ।
গায়ের লাল সাদা জামার ডোরার ভাঁজে ভাঁজে বেঁচে থাকা ভালবাসা পুরনো হয়না কখনো।এই ভালবাসায় খুঁত নেই,নেই ম্লান হওয়ার মত আণুবীক্ষণিক ছিটেফোঁটা ও। বাঁ পায়ের সাথে চুম্বকের মত সেঁটে থাকা বল জাদুমন্ত্র নিবিষ্ট হয়ে গান গাইছে অবিরত! লোকটা সে গানের তালে তালে দৌড়াচ্ছে আর একে একে ছিটকে ফেলছে প্রতিপক্ষকে। নির্বিকার প্রতিপক্ষদের ভাবাবেগের অবয়বে বিমোহিত স্পন্দন যেন বারবার চিৎকার করে উঠে ” ঈশ্বর আমি সংবেশিত “!
এই সংবেশন শেষ হবার নয়।তবে এই সংবেশনে শৈল্পিক আকর্ষণটা মুখ্য না,একটু বেশ ভাবে যান্ত্রিক।তবে যান্ত্রিক বেথোফেন।এই যান্ত্রিক সুরে দোষ নেই,আছে নিরন্তর সম্মোহনী টান!
স্যার স্ট্যানলি ম্যাথুস
এই নামখানা সমগ্র স্ট্র্যাটফোর্ডশায়ারের ভার বইয়ে চলছে তার জন্মলগ্ন থেকে। তার কাছে স্ট্র্যাটফোর্ডশায়ার ঋণী,ঋণী স্ট্র্যাটফোর্ডের অলি গলি, মানুষজন, কাক পক্ষী, ধুলাবালি, বায়ুমণ্ডল !
… আর ?
স্টোক সিটি,ব্ল্যাকপুল এবং সবার উর্ধ্বে ফুটবল ! পটার্সদের লাল সাদা ডোরার মাঝে একটা বিশেষ ব্যাপার আছে। এই জামা সমগ্র স্ট্র্যাটফোর্ডশায়ারের শ্রমজীবীদের শ্রম, ভালবাসা, আবেগ জড়িয়ে একাকার হয়ে এক হয়ে আছে। এই লাল সাদা স্ট্যানলির গায়ে জড়িয়ে আরো কয়েক পরত বেশী আবেগ মাখিয়েছে, জড়িয়েছে ভালবাসা।
একবার ভাবুন তো, ৫০ বছর বয়সী একজন লোক তার গতি, ড্রিবলিং দিয়ে একে একে ছিটকে ফেলছে প্রতিপক্ষকে ! তার অর্ধবয়সী সুঠামদেহী ডিফেন্স সামলানো যুবকগুলো তাকে আটকানোর বদলে নিজেরাই আটকে থাকে তার যান্ত্রিক গানের মায়ায় !
১৯৩০ সালে যখন ঘরের ক্লাব স্টোকে যোগ দেন তখন তিনি সবে শৈশব ছেড়ে কৈশরে পা দিয়ে যৌবনের উন্মাত্ততার অপেক্ষায় ছিলেন। ছেলেকে বক্সার বানানো বাবার ইচ্ছেকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ফুটবলটাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন ১৫ বছর বয়সী স্ট্যানলি। শৈশবের প্রিয় ক্লাব পোর্ট ভেল হলেও ভাগ্য তাকে এনে ফেলেছিল পটার্সদের আস্তানায়! এই ভাগ্যচক্রের বেড়াজালে আটকে সেদিনকার স্ট্যানলি ম্যাথুস জন্ম দিয়েছেন ইতিহাসের, জন্ম দিয়েছিলেন কিংবদন্তীনামার!
তখনকার ইংলিশ জায়ান্ট উলভারহ্যাম্পটন, অ্যাস্টন ভিলা, ওয়েস্ট ব্রম তাকে দলে ভেড়ানোর জন্য মরিয়া হয়েছিল একপ্রকার।কিন্তু স্ট্যানলি অতটা অভিজাত না,কিছুটা দরিদ্র এবং আবেগী। ঘর ছেড়ে দূরে যাওয়ার ইচ্ছেটা এই পিছু টানেই আটকে ছিল!
১৯৩২-১৯৬৫! সুদীর্ঘ ৩৩ বছরের ক্যারিয়ারে খেলেছিলেন দুটি ক্লাবে। স্টোক সিটি এবং ব্ল্যাকপুল। স্টোকের হয়ে দুই মেয়াদে খেলেছিলেন স্ট্যানলি। ১৯৩২-১৯৪৭ এই ১৫ বছর এবং ১৯৬১-৬৫ এই ৪ বছর মিলিয়ে মোট ১৯ বছর গায়ে আটকিয়ে রেখেছিলেন পটার্সদের লাল সাদা। এর মাঝের ১৪ বছর ১৯৪৭-১৯৬১ খেলেছিলেন ল্যাঙ্কাশায়ারের ক্লাব ব্ল্যাকপুলের হয়ে।
ঘর ছাড়ার ইচ্ছে কখনোই ছিলোনা তার।কিন্তু ৩২ বছর বয়সী স্ট্যানলিকে কোচ ম্যাকগ্ররি এবং বোর্ড খেলার জন্য অনুপযোগী ভেবে তার ক্লাব ত্যাগের সিজনে একপ্রকার উপেক্ষাই করেছিল। বোর্ড, কোচের সাথে সম্পর্কের টানপোড়নে অবসরের সিদ্ধান্ত নিলেও ফুটবলটাকে ভালবেসে বুটজোড়া আর তুলে রাখতে পারেননি! সেই আনফিট স্ট্যানলিই ফুটবল মাঠে দাপিয়ে বেড়িয়েছিলেন ৫০ বছর পর্যন্ত!! ভাবা যায়,এই রাফ অ্যান্ড টাফ ইংলিশ ফুটবলে মাঠময় দাপিয়ে বাঘা বাঘা ডিফেন্ডারকে নাকানি চুবানি খাইয়েছেন এক বৃদ্ধ!!
স্ট্যানলি ম্যাথুস খেলতেন রাইট উইঙ্গে। তবে প্রথা ভেঙ্গে এই বয়স্ক বিচরণ করেছিলেন সমস্ত মাঠ। গোল করার চেয়ে গেম কন্ট্রোল, এক্সেল, বিল্ড আপে বেশী মনযোগী ছিলেন এই ইংরেজ। সুদীর্ঘ ৩৩ বছরের ক্যারিয়ারে দুই ক্লাবের হয়ে ম্যাচ খেলেছেন সহস্রাধিক।তবে অফিসিয়ালি খেলেছেন ৬৯৭ টি ম্যাচ। গোল করেছেন ৭১ টি। ইংল্যান্ডের জার্সি গায়ে ৫৪ ম্যাচ খেলে প্রতিপক্ষের জালে বল পাঠিয়েছিলেন ১১ বার। খেলেছিলেন ১৯৫৪ বিশ্বকাপ। কিন্তু এক অদ্ভুত কারনে ইংরেজ জামা গায়ে তার সাফল্য ছিল ‘না বোধক’!
নিজ ঘর স্টোকে তার ফিরে আসাটা বেশ নাটকীয়ই ছিলো। ধুঁকতে থাকা স্টোক তখন খেলছে দ্বিতীয় বিভাগে ! দুর্বল ম্যানেজমেন্ট এবং দুর্নীতি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়েছিল স্যার স্ট্যানলির রেখে যাওয়া পটার্সদের। ম্যাচের পর ম্যাচ দলের বাজে অবস্থা, অব্যবস্থাপনা সমর্থকদের একপ্রকার খুনই করে রেখেছিল। সিজন জুড়ে কাঙাল সমর্থকদের মাঠে অনুপস্থিতি দলের খেলাওয়াড়দের ও কয়েক ধাপ পিছিয়ে নিয়েছিল।
ঠিক তখনি দেবদূত হিসেবে ফিরে আসেন স্ট্যানলি ম্যাথুস ! সাপ্তাহিক ৫০ পাউন্ড চুক্তিতে টনি ওয়েডিংটন ঘরের ছেলেকে ঘরেই ফিরিয়ে আনেন। তার স্পর্শে আমূল বদলে যায় পটার্সদের অবস্থা! যে মাঠে সিজন জুড়ে মাত্র হাজার তিনেকের মত গড় উপস্থিতি ছিল সে মাঠে স্যার স্ট্যানলির দ্বিতীয় অভিষেকের দিন হাজির হয়েছিল প্রায় ৩৬ হাজার সমর্থক! সিজন জুড়ে এভাবেই অব্যাহত থাকে।
অব্যাহত থাকে ৪৬ বছর বয়সী আধবুড়ো স্ট্যানলির জাদু। সে সিজনেই স্টোককে লীগ টু চ্যাম্পিয়ন করে তাদের নিয়ে আসেন পুরনো ঠিকানায়!
দলগত সাফল্য তার ক্যারিয়ারে নগন্য হলেও ব্যক্তিগত ভাবে স্ট্যানলি ম্যাথুস স্বয়ংসম্পূর্ণ :
ব্যালন ডি’অর ইতিহাসের প্রথম এবং সবচেয়ে বয়স্ক বিজেতা স্যার স্ট্যানলি। ১৯৫৬ সালে চালু হওয়া ব্যালন ডি’অরের প্রথম সংস্করণ বগলদাবা করেছিলেন ৪১ বছর বয়সী এই ভদ্রলোক। স্ট্যানলি তখন খেলতেন ব্ল্যাকপুলে। এছাড়াও তিনি ইতিহাস গড়েছেন ফুটবল রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন প্লেয়ার অব দ্য ইয়ারের পুরস্কার সবচেয়ে বয়স্ক ফুটবলার হিসেবে জিতে। ১৯৬৩ সালে দ্বিতীয় বারের মত পুরস্কারটি ঘরে তোলার সময় তার বয়স ছিল ৪৮! প্রথমবার জিতেছিলেন ১৯৪৮ সালে।সেবার ছিলেন ল্যাঙ্কাশায়ারে!জায়গা করে নিয়েছেন পিএফএ টিম অব দ্য সেঞ্চুরিতে। ফুটবলে তার অবদানের জন্য নাইটহুড খেতাব পান ১৯৬৭ সালে।
দলীয়ভাবে তার সাফল্য বলতে গেলে ব্ল্যাকপুলের হয়ে ১ বার এফএ কাপ চ্যাম্পিয়ন (১৯৫৩), ২ বার রানার্স আপ (১৯৪৮,১৯৫১)। আর স্টোকের হয় দুইবার লীগ টু (সেকন্ড ডিভিশন) চ্যাম্পিয়ন (১৯৩২-৩৩, ১৯৬২-৬৩)
সাফল্য দিয়ে কিংবা সংখ্যাতাত্ত্বিক বিবেচনায় তাকে হয়ত বেশ সাধারণ ই মনে হবে,তবে সব কিছু ছাপিয়ে স্যার স্ট্যানলি হয়ে আছেন অনন্যসাধারণ; ঐশ্বরিক ভাবে অনন্যসাধারণ! সুদীর্ঘ ৩৩ বছরের ক্যারিয়ারে সাক্ষী হয়েছিলেন অনেক কিছুর,কিন্তু সাক্ষী করে গিয়েছেন হাজারো কিছুর!
ঘর ছেড়ে এক যুগের বেশী সময় দূরে থাকলেও স্ট্র্যাটফোর্ডের সম্রাট হিসেবে ছিলেন,আছেন এবং কালের বিবর্তনে একজন স্ট্যানলি ম্যাথুজ হয়ে থাকবেনও।
এই স্ট্যানলিকে হটিয়ে স্ট্র্যাটফোর্ডশায়ারের বুকে দ্বিতীয় কোন কিংবদন্তীর আবির্ভাব ব্যতিক্রমধর্মী হতে পারলেও পারবেনা স্ট্যানলির মহত্ত্বকে ছাপিয়ে স্ট্র্যাটফোর্ডের একচ্ছত্র অধিপতি হতে ! তাকে নিয়ে লিখলে হাজারটা কিংবদন্তীনামা হবে। কিন্তু পুরোবেনা স্তুতিবাক্য, পুরোবেনা গ্রেটনেস! সাহস হয়না।সংক্ষেপেই পরিমার্জিত ভাবে ভদ্রলোককে স্মরণ করতে হয়। উপায় নেই…
২০০০ সালে ৮৫ বছর বয়সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে ইহলোক ছেড়ে পরলোকে পাড়ি জমালেও রেখে গিয়েছেন ইতিহাসনামা। এই ইতিহাস নামায় স্পষ্টাক্ষরে খোদাই করা আছে ” মৃত্যুর ওপারে চিরঞ্জীব তুমি”!
ভাল থাকবেন স্যার ‘স্ট্যানলি ম্যাথুজ’।