পদার্থবিজ্ঞানী আইনস্টাইনকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিলো, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান ব্যক্তি হয়ে আপনার অনুভূতি কি? কেমন লাগে?’ প্রত্যুত্তরে উনি বলেছিলেন, ‘এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। আপনি নিকোলা টেসলা সাহেবকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। এ প্রশ্নের উত্তর উনিই বলতে পারবেন’ !
নিকোলা টেসলা (Nikola Tesla)
১৮৫৬ সালের ১ জুলাই ক্রোয়েশিয়ার একটি প্রত্যন্ত গ্রাম্য অঞ্চলে নিকোলা টেসলা জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মূলত একজন সার্বিয়ান-আমেরিকান। একাধারে একজন প্রকৌশলী, আবিষ্কারক এবং পদার্থবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত টেসলা মূলত দিক পরিবর্তী বা পর্যায়ক্রমিক বিদ্যুৎ প্রবাহে (Alternating Current) অবদান রাখার জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। টেসলা অবিবাহিত অবস্থায় মারা যান। তিনি তার জীবনের শেষ ১০টি বছর কাটান হোটেল নিউ ইয়র্কের ৩৩২৭ নম্বর রুমে। তার মরদেহ এই রুম থেকেই উদ্ধার করা হয় পরে। তার জীবনের উপর ভিত্তি করে বহু উপন্যাস লেখা আর সিনেমা বানানো হয়েছে। ১৯৬৩ সালে তড়িৎ চৌম্বক ক্ষেত্রের একক হিসেবে টেসলা‘কে এসআই ইউনিটে আন্তর্জাতিকভাবে চূড়ান্ত করা হয়।
নিকোলা টেসলা এর এসব আবিষ্কারের কথা তো সবারই জানা। চলুন আজকে জেনে নেয়া যাক নিকোলা টেসলা সম্পর্কিত বিচিত্র কিছু তথ্য, যা অনেকেরই একদম অজানা…
নিকোলা টেসলা সম্পর্কিত অজানা যত তথ্য
১. টেসলার জন্মকাহিনী : কথিত আছে, টেসলার জন্ম হয় প্রচণ্ড ঝড় ও বজ্রপাতের রাতে। এরকম ঘটনাকে অশুভ সংকেত মনে করে সেই সময়ে ধাত্রী টেসলাকে ‘অন্ধকারের সন্তান’ (Child Of Darkness) বলেন। কিন্তু এতে টেসলার মা অপমানিত বোধ করে এর বিরোধিতা করে বলেন, টেসলা হবে ‘আলোর সন্তান’(Child of Light); টেসলার মায়ের সেই ভবিষ্যৎ বানী যে কতটা কার্যকর ছিল তা নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না !
২. টেসলার দূরদৃষ্টি এবং বেতার ইন্টারনেট : টেসলা তার সব চমৎকার উদ্ভাবনী চিন্তা বাস্তবে রূপান্তর করে যেতে পারেননি। তিনি ওয়্যারলেস পাওয়ার ট্রান্সমিশন নিয়ে বহু গবেষণা করেন। সেই ১৯০১ সালেই তিনি এসবের কথা চিন্তা করেন যার সুফল আমরা এখন ভোগ করছি। তিনি রেডিও জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে ‘ডেথ-রে’(death-ray) নামক একটা কণার কথা চিন্তা করেন যার বাস্তব কোন রূপ তিনি দিয়ে যেতে পারেননি।
৩. টেসলার জাদুকরী স্মরণশক্তি : বিজ্ঞানী টেসলার স্মরণশক্তি এতটাই তীক্ষ্ণ ছিল যে তিনি একটা বই পড়লে তার প্রতিটি লাইন ও ছবি সহ বিশদভাবে মনে করতে পারতেন। তার প্রখর কল্পনা শক্তির কারণে ছোটবেলায় প্রায়ই ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখতেন।
৪. টেসলা যখন পরিবেশবাদী : টেসলা প্রাকৃতিক সম্পদের দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়া নিয়ে বেশ সোচ্চার ছিলেন এবং পুনরায় ব্যবহারযোগ্য জ্বালানীর সমর্থক ছিলেন। তাছাড়া তিনি কীভাবে প্রাকৃতিক শক্তি ব্যবহার করে জীবাশ্ম জ্বালানীর উপর থেকে চাপ কমানো যায় সেই বিষয়েও বহু গবেষণা করেছেন। এমনকি তিনি তার জিনের ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিম বীজ তৈরি করার মতোও সফল গবেষণাও তার রয়েছে।
৫. মানবতাবাদী টেসলা : টেসলা কীভাবে মানুষের জীবন আরও উন্নত করা যায় সেই ব্যাপারে সব সময় সচেষ্ট ছিলেন। একজন প্রকৃত বিজ্ঞানীর মতো তিনি দিন-রাত শুধু গবেষণা নিয়েই পড়ে থাকতেন। তিনি কখনও আবিষ্কারের আর্থিক বা ব্যবসায়িক দিক নিয়ে ভাবতেন না। এ কারণে তার অনেক উদ্ভাবন এবং সামাজিক অবদান থাকা সত্ত্বেও শেষ জীবন তিনি চরম দারিদ্র্যের মাঝে কাটান।
৬. মার্কিন সরকার কর্তৃক টেসলার জিনিস বাজেয়াপ্ত : টেসলা মারা যাওয়ার পর অফিস অব এলিয়েন প্রপার্টি(The Office of Alien Property) তার সমস্ত ব্যবহার্য জিনিস এবং নথিপত্র বাজেয়াপ্ত করে। পরবর্তীতে এর বেশিরভাগই তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবং কিছু জিনিস বেলগ্রেডে টেসলা যাদুঘরে দান করা হয়। মজায় ব্যাপার হলো, টেসলা ১৯৪৩ সালে মারা গেলেও এখনও তার কিছু ব্যক্তিগত নথিপত্র মার্কিন সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত অবস্থায় আছে।
৭. টেসলার অনিদ্রা রোগ এবং অস্বাভাবিক আচ্ছন্নতা : টেসলা দাবী করতেন রাতে মাত্র ২ ঘণ্টা ঘুম ই তার জন্য যথেষ্ট। তবে এর কারণ অস্পষ্ট। তিনি আসলেই ২ ঘন্টা ঘুমাতেন কিংবা এর বেশি ঘুমাতে পারতেন কিনা, এ বিষয়ে সঠিক কিছু জানা যায়নি। টেসলা সংখ্যা ৩ এর ব্যাপারে অতিমাত্রায় আচ্ছন্ন ছিলেন। এবং রাতের খাবারের পূর্বে ১৮টি (৩ দ্বারা বিভাজ্য) রুমাল দ্বারা তার ডাইনিং রুম পরিষ্কার করতেন। এছাড়া তিনি বৃত্তাকার বস্তু, গহনা এবং চুল স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতেন।
৮. এডিসন এবং টেসলার কথিত শত্রুতা : টমাস আলভা এডিসনের সঙ্গে টেসলার শত্রুতার বিষয়টা কল্পনা করাটা হয়তো বেশ আনন্দদায়ক মনে হতে পারে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা এই যে, টেসলা তার এসি কারেন্ট ইন্ডাকশান মোটর এর স্বপ্ন বাস্তবায়নের ইচ্ছা ত্যাগের পূর্বেই তারা একে অপরকে ডিসি- কারেন্ট জেনারেটর ডিজাইনে সাহায্য করেছিলেন। সম্ভবত তাদের সম্পর্ককে ‘ব্যবসায়িক- প্রতিদ্বন্দ্বী’ হিসেবে বলা যেতে পারে।
৯. মার্ক টোয়েন কে বিপদে ফেলেন টেসলা : বিদ্যুৎ তৈরি করতে গিয়ে টেসলা একদিন এমন এক যন্ত্র আবিষ্কার করে ফেলেন, যেটি চালু করলেই ম্যানহাটনে তার বাসা এবং প্রতিবেশীদের বাসাও কেঁপে উঠতো। টেসলা ভাবলেন, তিনি সম্ভবত ‘ভূমিকম্প যন্ত্র’ আবিষ্কার করে ফেলেছেন। পরে দেখলেন, তিনি আসলে একটা উচ্চ কম্পাঙ্কের দোলক (High Frequency Oscillator) তৈরি করে ফেলেছেন। এই দোলক দিয়ে মার্ক টোয়েনকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতেও ফেলেছিলেন তিনি। একটা পার্টি শেষে টোয়েনকে ঐ দোলকের প্ল্যাটফর্মের উপর দাঁড়াতে বলে সেটি চালু করে দিলে প্রচণ্ড কম্পনে ১ মিনিটের মাঝেই টোয়েনের অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে যায়।
১০. টেসলা থেকে ওয়াইফাই : একটি ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে ক্যালিফোর্নিয়াতে প্রায় ১২৭,০০০ ডলার সংগ্রহ করে ২০১৩ সালের মে মাসে টেসলার ৭ ফুট উঁচু একটা মূর্তি বানানো হয়। কিন্তু কয়েক মাস পরেই ডিসেম্বরে মূর্তিটি টাইম ক্যাপসুলের মাধ্যমে ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং সেখানে ফ্রি ওয়াইফাই জোন বানানো হয়। অনেকে এ ঘটনাকে মজা করে বলে থাকে যে, টেসলা থেকে তাহলে আমাদের ওয়াই-ফাই জোনেরও ব্যবস্থা হয়ে গেলো।