নব্বইয়ের ঢাকায় বাচ্চারা স্কুলে টিফিনে খেত বোম্বে সুইটসের রিং চিপস, বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া ফুজি নুডলস, কিংবা ক্যান্টিন থেকে পাঁচ টাকায় কেনা বার্গার। নানাধরনের উন্নত মিল্ক চকোলেট, ক্যাডবেরীও ছিলো তখন বাচ্চাদের মেন্যুতে খুব জনপ্রিয়। সেসময় ঢাকায় মধ্যবিত্তদের কাছে আসে পিৎজ্জা, শর্মা, হেলভেসিয়া, মানে ফ্রাইড চিকেন। আর এর আগে বাইরে খেতে যাওয়া মানে ছিলো চায়নিজ কিংবা কাবাব। এরপর ঢাকার চায়নিজ রেষ্টুরেন্টগুলো সিচুয়ান ষ্টাইল, থাই আইটেম নিয়ে আসেন। যদিও আমি এখনো ঢাকার চায়নিজ, সিচুয়ান ষ্টাইল আর থাই রান্নার মধ্যে তেমন কোনো তফাৎ খুঁজে পাই না।
তো এরপর ডলসি ভিটার আইসক্রিম, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ এগুলো জনপ্রিয়তা পায়। ছোট ছোট আইসক্রিম পার্লার, ফাষ্টফুডের দোকান গজিয়ে ওঠার সময় সেটা। গুলশানে একটি ফাষ্টফুডের দোকান হলো তখন, নাম ‘হট হাট’। সেই সময়ের হট গার্লস আর মধ্যবয়স্করা যেতেন সেখানে। আর ধানমন্ডিতে ছিলো ‘খাই খাই’। ওয়েষ্টার্ন গ্রিলের জনপ্রিয়তাও তখন বেশ তুঙ্গে। উত্তরায় লেকের মধ্যে বোটিং শেষে কাবাব খাওয়ার ব্যবস্থা ছিলো। লিটার কোকের বোতল এবং লিটার বক্সের আইসক্রিম মধ্যবিত্তের ডাইনিং টেবিলে পাওয়া তখন অনেক স্বাভাবিক একটি ঘটনা। নিউমার্কেট গাউছিয়ার খাবারের দোকানের কল্যাণে অনেক মহিলারাই তখন বিফরোল, চিকেন প্যাটিস, জ্যামরোল, ভেজিটেবল রোল এগুলো বানানো শিখতে আগ্রহী হলেন। প্রায়ই নানান জায়গায় রান্নার কোর্স দেয়া শুরু হলো। আগ্রহী অনেক মহিলাই তখন এগুলো বানিয়ে খাবারের দোকানে সাপ্লাই দিয়ে সংসারের অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়েছেন।
তখনকার সময়ের নৌকা ও লঞ্চগুলোতে চড়ার সুখস্মৃতি বর্ণনা করতে পারছিনা। নব্বই দশকের লোকেরা অবশ্যই বুঝবেন। বাকিরা ছবি দেখে কিছুটা আন্দাজ করুন…
ক্রিকেট তখন খুবই জনপ্রিয় খেলা বাংলাদেশে। বিরানব্বই সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের খেলা টিভিতে দেখানো হচ্ছিলো। পাকিস্তানী খেলোয়ার ইনজামামুল হক সেসময় তার আনপ্রেডিকটেবল ব্যাটিংয়ের জন্য খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেন। মধ্যবিত্তের কাছে ভারত – পাকিস্তানের ক্রিকেট প্লেয়াররা সবসময়ই জনপ্রিয়তার দিক থেকে অষ্ট্রেলিয়ান-ইংলিশদের চাইতে এগিয়ে। তখন থেকেই বাংলাদেশের ক্রিকেটের দিকেও খেলোয়ারদের নজর পরতে থাকে।
৯৭ এর আইসিসি ট্রফি জয়ের মতো উৎসবমুখর মুহূর্ত বোধহয় দেশে কম এসেছে। এবং ৯৯ সালে বাংলাদেশ সর্বপ্রথম বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অংশগ্রহণ করে। ক্রিকেটের পরে ফুটবল তো ছিলই। আবাহনী আর মোহামেডান ক্রেজ তখনও মধ্যবিত্তের হৃদয়ে। আজকাল যেমন ক্রিকেট ছাড়া অন্য কোনো খেলা নিয়ে ঢাকায় আলোচনা হয় না, সেরকম দুরবস্থা তখনও ফুটবলের হয়নি।
আশির দশক থেকে অনেকদিন নিয়াজ মোর্শেদ বাংলাদেশের দাবাকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে রাখেন। সাঁতার আর শ্যুটিং নিয়েও তখন অনেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রাঙ্গনে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
বাংলাদেশের সিনেমার বেহাল দশাকে ঠিক করতে তখন কেউ কেউ আর্ট ফ্লিমের সাথে সাথে মূলধারার সিনেমাতেও আগ্রহ প্রকাশ করেন। এই আগ্রহের সূত্র ধরেই তখন জনপ্রিয় ভারতীয় সিনেমা ‘কেয়ামাত সে কেয়ামাত তাক’ এর বাংলা ভার্সণ তৈরি হয়, কেয়ামত থেকে কেয়ামত !
মৌসুমী ও সালমান শাহ এর মত সুন্দর, স্মার্ট ও গুণী শিল্পীর অভিষেক হয় আমাদের দেশের চলচ্চিত্র শিল্পে। হাস্যকর মেকাপ, ড্রেসাপ, চুলের ষ্টাইলের পরিবর্তন ঘটাতে সাহায্য করেন এই দুই অভিনেতা অভিনেত্রী। প্রচুর মধ্যবিত্ত দর্শক সিনেমা হলে ফিরে যান এ ছবিটি দেখার জন্য। অনেক শিক্ষিত ছেলে মেয়ে সিনেমাকে পেশা হিসেবে নেয়ার চিন্তা করেন। মৌসুমী আর সালমান পরিণত হন সকল কিশোর কিশোরী, যুবক যুবতীর হার্টথ্রবে। ৯৬ সালে অপ্রকাশিত কোনো কারণে সালমান শাহ আত্মহত্যা করেন, তিনি তখন এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে তার মৃত্যুর দুঃখ সইতে না পেরে তার অনেক ভক্তরাও আত্মহত্যা করেন। সালমান মৌসুমীর পরেই ফেরদৌস রিয়াজ এদের অভিষেক ঘটে। বাংলা সিনেমা, যা প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিলো, তা শেষ থেকে আবার শুরুর দিকে হাঁটতে শুরু করে।
নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে ক্যাবল টিভির আগমন ঘটে। অনেকের বাসার ছাদেই তখন খুব সুন্দর বড় ডিশ এন্টিনা দেখা যেত। অনেক সময় ছাদে কাউকে এন্টিনা ঘোরাতেও দেখা যেত। তবে যাদের এন্টিনা ছিলো না, তাদের জন্য বিটিভির মাধ্যমে প্রথমে সিএনএন তার সম্প্রচার শুরু করে।
মধ্যবিত্তের জন্য আসে অন্যধরনের সমাধান। ভিডিও ক্লাবগুলো নিজেরা বিশাল ক্যাপাসিটির এন্টিনা কিনে বাসায় বাসায় মাসিক একটা মাসোহারা ঠিক করে ক্যাবল টিভির লাইন দিতে লাগলেন। এরপর ভারতীয় টিভি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল, ডিসকভারি, কার্টুন নেটওয়ার্ক সবই মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে চলে এলো।
এর প্রচন্ড প্রভাব পরলো মধ্যবিত্তের জীবন যাত্রায়, বিশেষ করে পোশাক শিল্পে। শাড়ির মার্কেট আর পোশাকের ডিজাইন ভারতীয় টিভিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে লাগলো। সাথে সাথে মধ্যবিত্ত মেয়েদের কাছে জিন্স, টিশার্ট, স্কার্ট, লংড্রেস অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেলো। যারা বাইরে যেতেন শপিং করতে তাদের বাদে মধ্যবিত্ত বাকি সবাই বঙ্গবাজার, দোজা ইত্যাদি মার্কেট থেকে তাদের চাহিদা মেটাতেন।
মুম্বাই টিভির কারণে হেয়ার স্টাইলে ডায়ানা-কাট, মাধুরী-কাট ছিল দেখার মত বেশি। আর ছেলেদের ক্ষেত্রে সামনে ছোট কিন্তু ঘাড় ছাড়িয়ে চুল রাখা, যা কিনা সঞ্জয় দত্তের স্টাইল ছিলো।
অনেকসময় দেখা যেত, ৯২-৯৩ এর দিকে ছেলেরা জিন্স আর কেডসের সাথে ব্যাপকহারে চুলে রাহুল কাট প্রয়োগ শুরু করে। এসময় মেয়েদের প্রসাধনী ও রূপচর্চা একটা টপিক্যাল বিষয়ে পরিণত হয়। দশকের শেষদিকে চ্যানেল আই শুরু হলে কানিজ আলমাস আর ফারজানা শাকিল টিভিতে রুপচর্চার ব্যাপারে প্রচুর অনুষ্ঠান করেন।
ভারতীয় শাড়ি আর থ্রি-পিসের সাথে প্রতিযোগিতা করে তখন দেশীয় ফ্যাশন হাউজগুলো মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। ভারতীয় কাপড় মানেই স্ট্যাটাস আর স্টাইল, এ ধারনাটা তখন কিছুটা মার খায়। শুধু মেয়েদের জামা কাপড়ই নয়, ফ্যাশন হাউজগুলো তখন ছেলেদের জন্যও ভালো ভালো পাঞ্জাবী তৈরি করছে। তাদের তৈরি বিভিন্ন ফ্যাশনের গয়না, জুতো, ঘর সাজানোর জন্য বিভিন্ন রকমের কাঁথা স্টীচের, এপ্লিকের, বাটিকের চাদর, কুশন কভার তখন মধ্যবিত্তের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়। বিবিয়ানা, আড়ং, নিপুন, ভূষন, ভুবন, প্রবর্তনা এরা সেসময়ের উদাহরণ। বিভিন্ন ফ্যাশন ম্যাগাজিন গুলো তখন ঈদ উপলক্ষ্যে প্রতিযোগিতার আয়োজন করত। তাদের এই আয়োজন ও পুরস্কার বিতরণ ফ্যাশন হাউজগুলোর ঈদের বিক্রিকে অনেকটাই প্রভাবিত করত।
সেই ক্যাবল টিভির যুগেও হুমায়ূন আহমেদের ‘কোথাও কেউ নেই’ ধারাবাহিক নাটকটি মধ্যবিত্ত দর্শকদের প্রচন্ডভাবে আকর্ষণ করে। এই নাটকটি নিয়ে মিছিল পর্যন্ত হয় ঢাকায়। বাকের ভাইয়ের চরিত্রে আসাদুজ্জামান নূর আর মুনা চরিত্রের সুর্বণা মোস্তফা তখন ঢাকায় খুব জনপ্রিয়তা পান। পাড়ায় পাড়ায় বাকের ভাইদের মধ্যে লাল শার্ট পরার একটা প্রবনতা চোখে পরে, সাথে চোখে কালো রোদচশমা আর হাতে নানান ধরনের ব্রেসলেট।
নব্বইয়ের দশকে জাহিদ হাসান, শমী কায়সার, বিপাশা হায়াত, তৌকির নতুন প্রজন্মের প্রতীক ও আর্দশ ছিলেন। নোবেল, মাহফুজ, ফয়সালের বিজ্ঞাপন নিয়ে রীতিমত হৈ-হুল্লোড় শুরু হয়। তখনই হঠাৎ করে এক পর্বের নাটকের বদলে খন্ড নাটক বানানোর হিড়িক পরে। নাটক নিয়ে অকারণেই বাইরের লোকেশনে যাওয়া, নাটকে গান ঢুকিয়ে দেয়া এগুলোর শুরু হয়। ডিশের প্রভাবে বিটিভি তখন প্যাকেজ প্রোগ্রাম নামের রেডিমেড কিছু প্রোগ্রাম কিনতে শুরু করে। তবে সেসময় ঢাকায় খুব ভালো ভালো মঞ্চ নাটক হত। জাহিদ হাসান অভিনিত “বিচ্ছু” দেখার জন্য টিকিট পাওয়া মুশকিল ছিলো। হুমায়ূন আহমেদের লেখা “মহাপুরুষ”, তারিক আনামের পরিচালনায় “কঞ্জুস”, হাতহদাই, রক্তকরবী ইত্যাদি নাটকগুলো তখন মহিলা সমিতি আর গাইড হাউজে মঞ্চায়িত হত।
সেসময় টিভিতে ইংলিশ সিরিয়ালের পাশাপাশি এশিয়ান সিরিয়াল দেখানো শুরু হয়। এরমধ্যে অনেকগুলো খুবই দর্শক নন্দিত হয়েছিলো। একটির নাম খুব মনে পড়ছে “এগেইনষ্ট দ্যা উইন্ড”, এর হিরোর নাম ছিল সম্ভবত ‘ক্যানি’।
নব্বইয়ের দশক থেকেই বিটিভি তাদের সারাদিনের সম্প্রচার কাজ শুরু করে। ঈদে একটানা তিনদিন ব্যাপী অনুষ্ঠান দেখানো তখন থেকেই শুরু হয়। টিভিতে বাংলায় ডাবিং করা সিরিয়াল প্রচারের সূচনা হয় এ দশকে। প্রথমে আসে সোর্ড অফ টিপু সুলতান। লাইন ধরে বিচিত্র বাংলায় ডাবড হয়ে আসতে থাকে ডার্ক জাস্টিস, আকবর দ্য গ্রেট, থিফ অফ বাগদাদ, সিন্দাবাদ, রবিন হুড ইত্যাদি।
সিন্দাবাদের মিভ আর রবিন হুডের মেরিঅ্যানের পোশাকের নেকলাইন বিটিভি-নির্ভর মধ্যবিত্ত চোখকে বড় ধরণের ঝাঁকুনি দেয়। তবে মূলত গৃহকর্মীদের কারণে সবাই যেটা দেখতে বাধ্য ছিলেন তার নাম অ্যারাবিয়ান নাইটস বা আলিফ লায়লা। জাপানি সিরিয়াল “ওশেন” তুমুল হিট ছিল তখন।
টেলিভিশন তখন মধ্যবিত্তজীবনে অনেক প্রভাব বিস্তার করে। অভিনেতা শাহরুখ খান থেকে ক্রিকেটার ইমরান খান, মাধুরী দীক্ষিত থেকে জেনিফার লোপেজ এর ছবি তখন নিউমার্কেটে ত্রিশ টাকা দরে বিক্রি হতে শুরু করে। কারো বাড়িতে গেলে কাউকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই কে তোমার পছন্দের হিরো কিংবা খেলোয়াড়। দেয়াল ভর্তি ভর্তি করে সাটা থাকত টম ক্রুজ কিংবা রিকি মার্টিন।
মধ্য নব্বইয়ে ওয়াকিটকির মতো বিশাল সাইজের মোবাইল ফোন তখন ঢাকার কিছু মধ্যবিত্তের হাতে ঘুরছে। যদিও নেটওয়ার্ক বা অন্যান্য সুযোগ সুবিধা তখন মোবাইলের জন্য খুবই অপ্রতুল কিন্তু অনেকটা শোঅফ বা স্ট্যাটাস সিম্বল হয়ে মোবাইল যন্ত্রটি কারো কারো হাতে ঘুরত। নব্বইয়ের শেষ দিকে অবশ্য অনেকেই মোবাইল ব্যবহার করতে শুরু করেন।
ভ্যালেইন্টাইন ডে, ফ্রেন্ডশিপ ডে, পহেলা ফাল্গুন এধরনের দিনগুলো উৎসব রূপে ঢাকায় নব্বই এর দশকেই জনপ্রিয়তা পায়। বাংলাদেশের একমাত্র ছুটি কাটানোর জায়গা কক্সবাজার সেসময় মধ্যবিত্তের কাছে ধরা দিলো। বিভিন্ন কারণে–অকারণে পরিবার পরিজন নিয়ে ঘট ঘট করে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে ছোটা ছিলো তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে।
নব্বই দশক থেকে ফ্ল্যাট কালচারের প্রচলণ শুরু হয়, মার্কেট কালচারেরও। নিজেদের বাড়িঘর ভেঙ্গে ফ্ল্যাট বানানো আর রাস্তার পাশে বাড়ি হলে তাকে মার্কেট বানানো। প্রথমে ফ্ল্যাট মধ্যবিত্তদের ব্যাপার থাকলেও পরে ধানমন্ডি, গুলশান, বনানীতে এটা মহামারীরুপ নেয়। ফ্ল্যাটের কল্যাণেই অনেক উচ্চ মধ্যবিত্ত তাদের আবাসস্থান পরিবর্তন করে গুলশান ধানমন্ডিতে নিজেদের আবাসিত করেন।
ঢাকায় বিভিন্ন উপলক্ষ্যে তখন খুব ওপেন এয়ার কনসার্ট হত। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে নবীন বরণ উৎসব, ইডেনের নবীন বরণ উৎসব, পহেলা বৈশাখ ইত্যাদি উৎসবগুলো ছিলো মূখ্য। ছেলেদের কলেজে মেয়েদের যাওয়া মানা হলেও ছেলেরা মেয়েদের কলেজের কনসার্টের সময় আশেপাশে ঘুরঘুর করত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার ছিল, একবার বিএনপি থেকে নবীন বরণ দেয়া হত, একবার দেয়া হত আওয়ামীলীগ থেকে, আর একবার থাকত নিজস্ব বিভাগের তরফ থেকে। আওয়ামী আর বিএনপির মধ্যে আবার একটা প্রতিযোগিতা থাকত কারা কত দামী ব্যান্ডকে আনতে পারে। আমাদের সময় নিজস্ব নবীন বরণ ছাড়াও পরস্ব নবীন বরণের কনসার্ট উপভোগ করার একটা রেওয়াজ চালু ছিলো। সেই সুবাদে কোচিংমেট, কলেজমেট, স্কুলমেট, পাড়ামেট কে কোথায় ভর্তি হলো তার একটা খোঁজ পাওয়া যেত। ফ্রিতে নির্মল বিনোদনের এরচেয়ে উৎকৃষ্ট উপায় আমাদের তখন জানা ছিল না…
সংবাদপত্র জগতে বিষয়বৈচিত্র্য, রুচি সবকিছু মিলে ব্যাপক নতুনত্ব দেখতে পায় পাঠক। প্রিন্ট মিডিয়ায় কর্পোরেট পুঁজি বিনিয়োগের ব্যাপারটির সঙ্গেও আমাদের পরিচিতি ঘটে এই দশকে। পত্রপত্রিকার পাঠক সংগঠনগুলো সৃজনশীলতা চর্চা শুরু করেন।
সেসময় সারা ঢাকা শহর জুড়ে ব্যাঙ এর ছাতার মত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের পাশাপাশি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিও গজাতে শুরু করলো। বড়লোকের ছেলেমেয়েরা বিদেশি লেটেষ্ট মডেলের গাড়িতে চড়ে ব্যাংকক সিঙ্গাপুরি ব্র্যান্ডের সানগ্লাস চোখে দিয়ে সেখানে পড়াশোনা শুরু করে দিলো। আমাদের যাদের মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সামর্থ্য নেই, তারা ষোল থেকে বিশ হাজার ছাত্র ছাত্রীদের সাথে প্রতিযোগিতা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে উল্টা ভাব নেয়ার চেষ্টায় থাকতাম, ঢাকাতে যারা কৃতকার্য হয় না তারাই প্রাইভেটে পড়তে যায়। বলা তো যায় না রোজ বিশ টাকা রিকশা ভাড়া বাঁচানোর জন্য ইউনিভার্সিটির বাসে করে বাড়িতে চলে আসি আর সেই টাকায় টি।এস।সিতে দুপুরে একপিস ছোট মাংসের টুকরা দেয়া তেহারী আর কোক খেয়ে পাবলিক লাইব্রেরীতে গুলতানি করি। তখনই আন্ডারগ্রাডদের বিদেশে পড়তে যাওয়ার ট্রেন্ড শুরু হয়। আগে জানতাম লোকে পিএইচডি, এমএস, পোষ্ট ডক করতে বিদেশে পড়তে যায়। কিন্তু সাধারণ অনার্স, বিবিএ, কম্পিউটার সাইন্স মার্কা সাবজেক্টে অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা, লন্ডন, আমেরিকা নিদেন পক্ষে ইন্ডিয়া যাওয়ার চলও সেই নব্বইয়ের দশক থেকেই। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় এমসিকিউ পদ্ধতি চালু হয় বিরানব্বই সাল থেকে।
নব্বই দশকের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিলো ঢাকার জন্য “এরশাদ সরকারের পতন”। প্রতিবার ফাইনাল পরীক্ষার আগে এরকম একটা হরতাল, আন্দোলন, কার্ফিউ এর ঘটনা ঘটত। এটা শীতকালে স্বাভাবিক বলে আমরা তখন জানতাম। ঢাকায় বন্যা আর হরতালের কারণে স্কুলে বিরাট ছুটি পাওয়া যেত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আন্দোলন করবে, কেউ কেউ মারা যাবে, ছাত্ররা বাস পুড়িয়ে দিবে, এরশাদ মানুষের মিছিলে ট্রাক তুলে দিবে, তখন কিছুদিন স্কুল বন্ধ থাকবে, পরীক্ষার ডেট চেঞ্জ হবে, আব্বুরা বাসায় থাকবে আমরা ইচ্ছেম দুষ্টমি করতে পারবোনা, কিন্তু আব্বু বাসায় থাকা উপলক্ষ্যে ভিডিও ক্লাব থেকে ভালো ভালো সিনেমা আনা হবে, পড়তে হবে না কারণ পরীক্ষা অনিশ্চিত। আর আম্মু ভালো ভালো রান্না করবেন। যেকোনো সময় যেকোনো অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মেহমানও আসতে পারেন এই গলি, সেই গলির চিপা দিয়ে হরতালকারী আর পুলিশের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে। আব্বুরা হয়ত তাসের আড্ডা বসাবেন। সিটি কলেজের সামনে, কিংবা নিউমার্কেটের সামনে নীলক্ষেতে টোকাইদের দিয়ে নেতারা টায়ার পুড়াবেন। সেই পোড়া গন্ধ কলাবাগান, শুক্রাবাদ পর্যন্ত আসবে। আমরা সবাই ছাদে দৌড়ে যাবো, সেই সময় সাইরেন বাজিয়ে পুলিশ সেখানে যাবে যাতে সাইরেনের আওয়াজ পেয়ে টায়ার পুড়ানেওয়ালারা দৌড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে পারে। কিন্তু সেবার যে এরশাদ সত্যিই সত্যিই ক্ষমতা ত্যাগ করবেন, দুই নেত্রীকে গৃহবন্দী করা বাদ দিয়ে সেটা ছিলো অপ্রত্যাশিত। বাংলাদেশ একানব্বইতে সত্যি সত্যি স্বৈরাচারমুক্ত হলো, আসলেই কি? দৈনন্দিন জীবনে এরশাদ পরবর্তী সরকারদের সাথে আমি এরশাদ সরকারের খুব একটা অমিল পাই না, দুঃখিত।
আমরা যারা যুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্ম, যুদ্ধ – রায়ট যাদের কাছে ইতিহাসের বই, টিভির নাটক কিংবা সিনেমা মাত্র ছিল। তারা বিরানব্বইয়ে বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার কল্যাণে সেটা স্বচোখে দেখলাম। প্বার্শবর্তী দেশের তান্ডব আমাদের দেশকেও কিছুটা ছুঁয়ে গেলো। সারাদেশে কিংবা ঢাকায় কার্ফিউ ছিল তখন। বিটিভি সিএনএনের রায়টের সংবাদের সময় সেন্সর করে সিএনএন পযর্ন্ত অচল করে রাখত। ধর্মের নামে মানুষ মারা কোনো প্রাগৈতিহাসিক ঘটনা নয়। এটা এখনো ঘটে জানলাম তখন নতুন করে। খালেদা জিয়ার আমল তখন, তিনি আগের দিনের সাদা সূতি শাড়ি বদলে নতুন ফ্রেঞ্চ ফ্যাশনে টিভিতে আসেন সাথে একটা ম্যাচিং ওড়না। খালেদা জিয়ার এই ওড়না ফ্যাশন তখন মধ্যবিত্ত খালাম্মাদের আক্রান্ত করে ফেললো। ম্যাডামের মত ফ্রেঞ্চ না পাক তাতে কি, সূতি, সিল্ক, ম্যাচিং, কন্ট্রাষ্ট যে ধরনেরই হোক ওড়না তাদের শাড়ির ওপর শোভা পেতে লাগলো। সেই সময় আনন্দ বিচিত্রা একটি জরিপ চালায় তারকাদের মধ্যে, কাকে তারা সবচেয়ে সুবেশী মনে করেন। ষোলজন সম্ভবত খালেদা জিয়ার নাম নেন, এই ষোলজনের মধ্যে তারকা সুর্বনা ও চম্পা ছিলেন সম্ভবত যারা খালেদা জিয়াকে সবচেয়ে সুবেশী মনে করতেন। ৯১ সালের (সম্ভবতঃ) সবচেয়ে আলোচনাকারী ঘটনা ছিলো শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে “ঘাতক দালাল নিমূর্ল কমিটি” গঠন করে গণআদালতের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করা। আন্দোলন তৈরী করা…
এই দশকেই যায় যায় দিন সাপ্তাহিকের নির্বাচিত কলামের লেখিকা তাসলিমা নাসরিনকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। তিনি বির্তকিত ছিলেন তার ব্যক্তিগত জীবন, এবং তার লেখার জন্য। আজো তার নির্বাসন জীবনের অবসান ঘটেনি। মৌলবাদী শক্তিকে রুখার বদলে সব সরকারই তাদের সাথে আঁতাত রাখেন। একজন নিরস্ত্র ভদ্রমহিলা যিনি লেখিকা, তাকে লেখা দিয়ে বধার বদলে শক্তিশালী পুরুষরা সবাই লাঠিসোটা দা নিয়ে ঢাকা কাঁপিয়ে মিছিল করেছেন। আমাদের অসহায় পুলিশ বাহিনী তাকিয়ে তাকিয়ে তা দেখেছে, কিছুই করতে পারেনি। সারাবিশ্ব এই বর্বর দৃশ্যটি দেখেছেন। কিন্তু আজো তিনি যা যা বলেছেন তার বিপক্ষে কোনো যুক্তি নিয়ে এসে তার লেখাকে কেউ খন্ডন করেনি।
৯৮ সালে ভয়াবহ বন্যায় সারাদেশ ডুবে যায়। সারা বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমে বাংলাদেশ আবার তার অসহায়তার জন্য কভারেজ পায়। নব্বইয়ের দশকে কম্পিউটার মধ্যবিত্তের ঘরে আসে। গেম খেলা চলত তখন ভীষনভাবে। অনেক শৌখিন ব্যবহারকারী তখন উচ্চমূল্যে অন্তর্জাল ব্যবহার করতেন। অর্ন্তজাল ব্যবহারের মধ্যে একটা জিনিস তখন প্রচন্ড জনপ্রিয় ছিল তা হলো চ্যাটিং। এমএসএন কিংবা ইয়াহুর মাধ্যমে চ্যাটিং…
প্রিয় নব্বই দশক এভাবেই শেষ হয়। আর আমরা হারিয়ে ফেলি সুন্দর একটি সময়কে। একটা দেশ গড়ে ওঠার সময়। একটা সমাজকে সাজানোর সময়। এই বিবর্তনের সাক্ষী কেবল আমরা নব্বই দশকের ছেলেমেয়েরাই !
নব্বই দশকের ঢাকা নিয়ে একজন নিউইয়র্ক প্রবাসী তানবীরা’র স্মৃতিচারণ…