তখন মোবাইল সহজলভ্য ছিলো না। আমি নকিয়া ১১০০ মডেলের একটা ফোন চালাতাম। জিনিসটা ছিলো আমার কাছে জাদুর বাক্সের মত। এই ফোনে রিংটোন কম্পোজ করার একটা ফিচার ছিলো। স্কুল থেকে ফেরার পর একদিন দেখলাম, ফুটপাতের এক পত্রিকার দোকানে রিংটোন বানানোর বই বিক্রি করছে। দেরি না করে পরেরদিনই আমি আমার জমানো ৩০ টাকা ভেঙে বইটা কিনে ফেললাম। বাসায় এসে ফোন হাতে নিয়ে বসলাম। কম্পোজারে কোডগুলো বসাতে বসাতে কয়েকঘন্টার চেষ্টায় একটি রিংটোন বানিয়ে ফেললাম। পুরোটা কম্পলিট হবার পর যখন প্লে করলাম, আমি অবাক !
এটাই সেই গান, কিছুদিন আগে যেটা কোন এক চ্যানেলে একটা নাটকের মধ্যে দেখেছি। গানের কথাগুলো মুখস্ত রাখা সম্ভব হয়নি বলে গুনগুন করেই কাটিয়ে দিয়েছি। গানটা আর খুঁজে পাওয়া হয়নি। পেয়ে গেলাম সেদিন। বইয়ের পাতায় লেখা, “সে যে বসে আছে একা একা, রঙিন স্বপ্ন তার বুনতে” !
আমি যে তখন কিভাবে হাসছিলাম, কেমন অনুভূতি হচ্ছিলো, এটা বলে বুঝাতে পারবোনা। ভরদুপুরে সবার অগোচরে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পছন্দের মানুষটার বাসার সামনে গিয়ে পায়চারি করা, যেভাবেই হোক তাকে একনজর দেখে আসা, ঈশারায় তিন সেকেন্ডের আবেগ চালাচালি করা, আমাদের এই বলতে না পারা বিষয়গুলোর সবটাই ছিলো ওই নাটকে এবং নাটকের ওই গানটিতে…
বলছিলাম অফবিট নাটকের কথা। এই নাটকের মাধ্যমেই আমার তাহসানরাজ্যে ভ্রমণটা শুরু হয়। তারপর একে একে তাহসানের অনেকগুলো গান আমার শৈশবের বিলীন হওয়া আবেগের সঙ্গী হয়ে যায়। এখনো মনে পড়ে এক নীলপরী নীলাঞ্জনার কথা, যে এসেছিলো তাহসান অভিনিত এক নাটকের সাথে ! একটা নাটক, একটা নাম, নীলপরী নীলাঞ্জনা। রাতারাতি এই এক নামেই ফেসবুকে তৈরি হয় হাজার হাজার আইডি। সেই নীলপরী নীলাঞ্জনাদের আগমণ ও প্রস্থানে আমিও তাহসানের গানের সূরে ভেসেছি, “কেনো হঠাৎ তুমি এলে? কেনো নয় তবে পুরোটা জুড়ে” !
জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়টাতেও তাহসানের “উদ্দেশ্য নেই” আমাকে সঙ্গ দিয়েছে। উদ্দেশ্য না থাকার মাঝেই আমি উদ্দেশ্য খুঁজে নিয়েছিলাম। সেই পথ ধরেই আজও হেঁটে চলেছি…
তাহসান একজন ভালো মানুষ। তাহসান একজন ভালো লাগার মানুষ ! আর এই ভালো লাগার মানুষটাকে নিয়েই আজকে লিখতে বসেছি। জানা-অজানা যা কিছু আছে তাহসান সম্পর্কে, তা নিয়েই ছারপোকা ম্যাগাজিন এর বিশেষ এই প্রতিবেদন ! চলুন আর কথা না বাড়িয়ে সোজা ‘তাহসান’ প্রসঙ্গে চলে যাওয়া যাক…
তাহসান রহমান খান
বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের সেরা কয়েকজন গুণী শিল্পীর নাম নিতে গেলে সাবলীলভাবে যাদের নাম চলে আসে, তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হচ্ছেন তাহসান ! তিনি একাধারে একজন গায়ক, শিক্ষক, গীতিকার, সুরকার, গিটার বাদক, কী-বোর্ড বাদক, পরিচালক, অভিনেতা, মডেল এবং উপস্থাপক। বলাই বাহুল্য যে, প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই তিনি সমানভাবে জনপ্রিয় !
ব্যক্তিজীবনে তাহসান
রাজধানী ঢাকায় ১৯৭৯ সালের ১৮ অক্টোবর তাহসান জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মাধ্যমিক পাস করেন ১৯৯৬ সালে সেন্ট যোসেফ হাই স্কুল থেকে এবং ১৯৯৮ সালে নটরডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। এরপর তাহসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হন। সেখান থেকে মার্কেটিং এর উপর অনার্স এবং ফিন্যান্স এর উপর মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। ২০০৬ সালে তিনি বিয়ে করেন সমসাময়িক মডেল ও অভিনেত্রী রাফিয়াথ রশীদ মিথিলাকে। ২০০৮ সালে তাহসান ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটা কার্লসন স্কুল অব ম্যানেজমেন্টে ব্র্যান্ড ম্যানেজমেন্টের উপর পড়তে যান এবং দু’বছর পর মাস্টার অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ডিগ্রী অর্জন করে দেশে ফিরে আসেন। ২০১৩ সালের ৩০শে এপ্রিল তাহসান-মিথিলা দম্পতির কোলে আসে তাদের একমাত্র কন্যা আইরা তাহরিম খান। ২০১৭ সালের ২০মে তাহসান তার স্ত্রী মিথিলার সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘোষণা দেন।
তাহসানের কর্মজীবন ও পথচলা
২০০৩-০৪ সালে তাহসান ইউনিলিভার কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন। এরপর ২০০৬ সাল থেকে ইউএস যাবার আগ অব্দি তিনি ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক পদে কাজ করেছেন। ২০১০ এর জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত তিনি ইউএসের ইউনিভার্সিটি অফ মিনেসোটার ইন্সটিটিউট ফর রিসার্চ ইন মার্কেটিং এ গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। এরপর দেশে ফিরে এসে ২০১০ এর মে থেকে শুরু করে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল অার্টসে শিক্ষকতা করেন। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরেই তিনি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।
মিডিয়ায় তাহসান
মিডিয়া জগতে তাহসান মূলত সঙ্গীতশিল্পী হিসেবেই প্রথম পরিচিত হন। ব্যক্তি তাহসানের মূল আর্কষণও সঙ্গীতের প্রতি। তার সঙ্গীতের হাতেখড়ি হয় ছায়ানট থেকে। সেখানে প্রায় ছয় বছর তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের উপর দীক্ষিত হন। এরপর ১৯৯৮ সালে তার মত আরো কয়েকজন সঙ্গীতপ্রিয় যুবককে সাথে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেন তাদের প্রথম ব্যান্ডদল “ব্ল্যাক”। খুব দ্রুত তাদের ব্যান্ড জনপ্রিয়তা অর্জন করে নেয়ার পর হঠাৎ করেই তাহসান ব্ল্যাক থেকে বের হয়ে নিজস্ব ধারার গানে মনোনিবেশ করেন। ব্ল্যাক থেকে বের হয়ে যাওয়া সম্পর্কে তাহসান বলেন, “ব্ল্যাক ব্যান্ডের সবাই এখনো আমার ভালো বন্ধু। আসলে ওরা অল্টারনেটিভ রক ধাঁচের গান করতে চায়। আর আমি স্লো ব্যালেড ধাঁচের গান করি। তাই আমি ওদের ইচ্ছাকেই সম্মান জানিয়েছি। নিজের ইচ্ছাকে জোর করে চাপিয়ে দিতে চাইনি।”
ব্ল্যাক পরবর্তী সময়ে তাহসান বেশ কয়েকটি একক এ্যলবাম প্রকাশ করেন, যার প্রত্যেকটাই তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। এরপর ২০১২ সালে তিনি “তাহসান অ্যান্ড দ্য সুফিজ” নামে নতুন আরেকটি ব্যান্ড গঠন করেন। ‘কৃতদাসের আবাস’ নামে বাংলামোটরে তাহসানের নিজস্ব স্টুডিও রয়েছে।
এপর্যন্ত তাহসানের সর্বমোট আটটি একক অ্যালবাম প্রকাশ পেয়েছে এবং মিশ্র অ্যালবাম ও নাটক কিংবা সিনেমার প্লে-ব্যাকে অসংখ্যবার তিনি কন্ঠ দিয়েছেন।
২০০৪ সালের ‘অফবিট’ নাটকের মাধ্যমে অভিনয় জগতে পা রাখেন তাহসান। প্রথম নাটকে অভাবনীয় সাফল্য পাবার পরও কোনো এক অজ্ঞাত কারনে তাকে আর অভিনয় জগতে দেখা যায়নি অনেকদিন। তারপর হঠাৎ করেই ২০১১ সালে আবারো অভিনয় করেন তাহসান, এবারের নাটকের নাম ‘মধুরেন সমাপয়েৎ’। এরপর একে একে তিনি এখন পর্যন্ত প্রায় ষাটটি নাটকে অভিনয়ে করেছেন। বর্তমানে টিভি নাটকের সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পীদের একজন তাহসান। বিভিন্ন অকেশনে তাহসানের নাটক মানেই যেন হটকেক !
এসবের মাঝেই বিভিন্ন সময়ে তাহসান বেশ কয়েকটি রিয়েলিটি শো, অ্যাওয়ার্ড ফাংশন এবং কনসার্টে উপস্থাপনা করেছেন। বিচারকের কাজ করেছেন বেশ কয়েকটি রিয়েলিটি শো-তে।
বাংলাদেশের মিডিয়া জগতে তাহসান এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। বহুগুণে গুণান্বিত এই শিল্পীর ভবিষ্যতের পথ হোক আরো মসৃণ এবং তার সুনাম ছড়িয়ে যাক দেশ হতে দেশান্তরে। ছারপোকা পরিবার তার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল কামনা করছে…
(আগামী ৮ই মার্চ ২০১৯ তারিখ তাহসান অভিনিত ‘যদি একদিন’ চলচ্চিত্র মুক্তি পেতে যাচ্ছে। শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইলো এই সিনেমাটির জন্য…)